fbpx
Romel Rahman Writer Bangladesh

রোমেল রহমানের দুইটা গল্প

ক‍্যাপসিকাম

বাজারে আলুর কেজি চালের চেয়ে বেশি। অন্যসব সব্জির ধারেকাছে ঘেঁষতে হয় হিসেব করে, মাছ মাংসের গায়ে আগুন! এরকম অবস্থায় নিয়ামত বাজারের এক সব্জিওয়ালার সঙ্গে গেঞ্জাম লাগিয়ে দিলো! ধারে গিয়ে দেখা গেলো, একটা ক্যাপসিকাম নিয়েছে সে যেটার দাম উঠেছে ১০০টাকা! নিয়ামত মাথায় হাত দিয়ে সরাসরি গালাগাল শুরু করে দিয়েছে আগের সরকার থেকে এখনকার সরকার সবার নামে দলের নামে! আল্লাহকে দুষছে তাকে দুনিয়ায় পাঠানোর জন্যে! নিজের মা বাপকে ঝাঁঝরা করে ফেলেছে ভৎসনা ছুড়ে! মাঝখানে সব্জিওয়ালাকেও গালি দিয়ে বলেছে, এরচেয়ে বিষ বিক্রি কর, এক শিশি খেয়ে তোদের মুক্তি দিই! বেতনের টাকা তো টাকা মনে হয় না! মাংসের গন্ধ শুঁকলে বমি চলে আসে! থু! সব্জিওয়ালা বলেছে, না নিলে নিয়েন না খামাখা মার্কেটে হাউকাউ লাগান ক্যান? কিন্তু নিয়ামতও কম যায় না, সে ক্যাপসিকাম নেবেই! এবং কম দামে নেবে! সব্জিওয়ালা বলে দিয়েছে, ১০২ টাকা হইসে ওজনে, ১০০/- না পারলে নিয়েন না! সবার কপালে সব জিনিস নাই এই জামানায়! কিন্তু নিয়ামত বলে যাচ্ছে, এটা ৮০/- হলেও বেশি হয়! এইরকম ঠেলাঠেলির পর ৯০/- দিয়ে ক্যাপসিকাম কিনে সে যখন বাজার থেকে রাস্তায়, পাড়ার একজন গিয়ে বল্ল, মানুষ ভাত খেতে হিমসিম খাচ্ছে আর তুমি এই জিনিস নিচ্ছ? এতে তো পেট ভরবে না! তার উপর যেরকম কুস্তি করে জিনিসটা কিনলে, এরকম দরকষাকষির লোক তো তুমি না! ঘটনা কি? নিয়ামত মুচকি হেসে বলে, তা ঠিক এরকম লোক আমি না! আসলে সিদ্ধন্ত নিয়ে ফেলেছি জমা টাকাপয়সা যা আছে আর বেতন কড়ি যা পাই সব খেয়ে শেষ করে যাবো! মেপে খেতে খুব লজ্জা হয়! জীবনে কখনো বাজারে গিয়ে টাল খাইনি! আজকাল খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, কাউকে বলাও যায় না! বলতে গেলে, তত্ত্ব কপচায়! চুরি করতে পারছি না বলেই বিপদ! লুটতে পারলে আর এইদিন দেখা লাগতো না! কিন্তু সেটাও পারবো না! মহল্লার লোকটা বল্ল, ক্যাপসিকাম খাবে কে? নিয়ামত মুচকি হেসে বেরিয়ে যায়! 

বাড়ি ফিরে নিয়ামত তার বালিকা কন্যার হাতে ক্যাপসিকাম তুলে দেয়! মেয়েটা আজকে প্রথম তাওয়া পিৎজা বানাচ্ছে, ভীষণ উত্তেজিত সে! সব জিনিসপাতি জোগাড় হয়েছে একটু একটু করে, বাকি ছিলো ক্যাপসিকাম! সেটাও চলে এসেছে। ময়দার ডো বানিয়ে রেখেছে এখন বেলে ফেলা যাক! পিৎজা তৈরি শুরু করার সময় এখন। মেয়ের মা মুখ কালো করে দূরে দাড়িয়ে দেখছে! মেয়েটা জানেই না তার বাবার দুমাস বেতন হয়নি! সাম্নের মাসেও হবে না! রাজনৈতিক অবস্থা যা দাড়িয়েছে তাতে কোম্পানি গুটিয়ে নেয়ার চান্স আছে। সামনের মাস থেকে মেয়েটার মাস্টার বাদ দিতে হবে! এম্নিতে এক মাসের বকেয়া পড়ে গেছে। মহিলা তার ভাইদের কাছে চেয়েচিন্তে হতাশ হয়েছে, ওদেরও একই অবস্থা! ভাত খেতে গিয়েই পয়সা ফুরিয়ে যাচ্ছে সবার! সেদিন রাতে দুটো তাওয়া পিৎজা বানিয়ে মেয়েটা তার পুরানা ফোনে ছবি তুল্ল! এক্টার তলা সামান্য ঝলসে গেছিলো,  তাতে সমস্যা নেই ছবিতে তো আর নিচের অংশ উঠবে না! তারপর সে ফেইসবুকে আপলোড করতে গিয়ে বলে বস্লো, ধুস আমার তো নেট প্যাকেজ শেষ!  এমন ফকিন্নি অবাস্থা! এই বাক্য শেষ হতেই ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো তার মা! ফলে পুরা ব্যাপারটা ঘেঁটে গেলো! হতভম্ব মেয়ে দৌড়ে ঘরে চলে গেলো পিৎজা রেখে! নিয়ামত পাথর মূর্তি হয়ে বসে রইলো।  অনেক্ষণ পর শুধু বল্ল, একটু আনন্দও ঠিকঠাক মতো করার ক্ষমতা নাই আমার মেয়েটার,আফসোস! কেন জন্ম দিলাম? নিয়ামতের স্ত্রী চোখ মুছে আলমারি খুলে ১০০/- বের করে দিয়ে বল্ল, যাও মোবাইল রিচার্জের দোকানে গিয়া ওরে একটা ছোট ইন্টারনেট প্যাকেজ ভইরা দাও, ছবিটা ছাড়ুক ফেসবুকে! বন্ধুদের দেখানোর ইচ্ছাটা পুরা হোক। সেদিন অনেক রাত হয়ে যায় মেয়ের রাগ ভাঙ্গিয়ে পিৎজা পার্টি করতে! ততোক্ষণে পিৎজা ঠান্ডা হয়ে গেছে! নিয়ামত খেতে গিয়ে বল্ল, হেব্বি টেস্ট হইসে রে মা! দোকান দিয়ে ফেলা! সবুজ রঙ্গের ক্যাপসিকাম দাঁতের নিচে পড়তেই নিয়ামত বল্ল, হলুদ আর লাল ক্যাপসিকামে কি আলাদা স্বাদ মা? মেয়ে হেসে কুচিকুচি! বালিকা মেয়ে বলে ওঠে, বাবা যে কি বোকা না মা! হলুদ কাচামরিচ আর লাল কাঁচামরিচে কি আলাদা স্বাদ? 

পরদিন সকালে পানি দিতে আসা বুয়া কলিংবেলে টিপে দরজা গুঁতিয়ে যখন কারো সাড়া পেলো না। তখন পাশের বাসার লোকেরা জড়ো হয়ে পুলিশকে ফোন দিলো। পুলিশ এসে দেখলো বমিতে ভেসে যাওয়া মেঝের উপ্রে পরিবারের তিনজন মরে পড়ে আছে, অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তিনজনের মাথার জায়গায় আস্ত একেকটা ক্যাপসিকাম!  একজনের হলুদ ক্যাপসিকাম মাথা, একজনের লাল আর অন্যজনের সবুজ ক্যাপসিকাম মাথা! টেবিলে এক টুকরো ঝলসানো পিৎজা!

২২ অক্টোবর, ২০২৪।

‘The circle of the Lustful: Paolo and Francesca, 1827’. উইলিয়াম ব্লেইকের আঁকা। সিরিজ: দান্তে’স ডিভাইন কমেডি। ক্রেডিট: রোসেনওয়াল্ড কালেকশন (Rosenwald Collection). ন‍্যাশনাল গ‍্যালারি অব আর্টের পাবলিক ডোমেইন থেকে সংগৃহিত।

গাজরের হালুয়া

হাড়ির ভাতে কুকুর মুখ দেয়ায় ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্মী হাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলো স্থির! কুকুরটা আরাম করে খাচ্ছে, খাক; খেয়ে যখন ফেলেছেই তাড়া দিয়ে লাভ কি! তার এই এক মরার ঘুমের রোগ আছে, যখন তখন নেতিয়ে যাওয়া! বিয়ের মণ্ডপেও এমন হল, ঠাকুর মশাই মন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন আর চারদিকের জটলা, হল্লার মধ্যেও লক্ষ্মী হাই তুলতে লাগলো!

কুকুর হাড়ির ভাত খেতে খেতে রতন এসে ঢুকল ঘরে। পুরো দৃশ্য দেখে লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে বল্ল, ‘খাবো কি তালি? জম্মের খিদে লাগিলো!’ লক্ষ্মীর আবার ঘুম ঘুম পায় ফলে সে শান্ত স্বরে বলে, ‘গাজর খাও গ্যে!’ ফলে বউ পিটানো তরিকার মানুষ না হওয়ায় রতন খুব ভালো ছেলের মতন এক বালতি জল নিয়ে উঠোন লাগোয়া গাজরের ক্ষেতের দিকে এগিয়ে গেলো! এ বচ্ছর ফুলকপি আর গাজর লাগিয়েছে রতন! শহরের মেমসাহেবদের মধ্যে নাকি গাজরের হালুয়া বানানোর চল উঠেছে গেলো বচ্ছর থেকে! বাজার থেকে এসব শুনে এসে এবার এক ক্ষেত গাজর লাগিয়েছে রতন! ফলে সেই ক্ষেতে নেমে গিয়ে একেকটা গাজর তুলে বালতির জলে ধুয়ে সে খেতে শুরু করে! কিন্তু তার পেট ভরে না, ফলে সে গাজর তুলে ধুয়ে খেতেই থাকে! অন্যদিকে লক্ষ্মী আবার ঘুমিয়ে গেছে!

কুকুরটাও হাড়ির পাশেই তলিয়ে গেছে! ঘুমিয়ে লক্ষ্মী একটা স্বপ্ন দেখতে থাকে যেখানে, সে পুকুরের মতন বিরাট এক কড়াইয়ে গাজরের হালুয়া রান্না করছে আর তার চাকর হিসেবে ঘি, চিনি, গাজর কুচি এগিয়ে দিচ্ছে তার স্বামী রতন! এই পর্যন্ত দেখেই সে লাফিয়ে ওঠে! উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখে তার মানুষটা ঠিকই গাজর খেয়ে যাচ্ছে! লক্ষ্মীর মায়া মায়া লাগে! মনে মনে সে ঠিক করে লোকটাকে গাজরের হালুয়া বানিয়ে দেবে! সেদিন রাত্রে লোকটা জাপটাজাপটির মধ্যেই জিজ্ঞেস করলো, ‘ হ্যে লক্ষ্মী গাজরের হাইলো বানায় খিরাম কইরে?’ বাপের জম্মে এই বস্তু না খাওয়ায় বিপাকে পড়েও লক্ষ্মী কায়দা করে রেসিপিটা কাটিয়ে যায় চোপা দিয়ে, ‘ক্যান খাতি ইচ্ছে হচ্ছে নিকি?’ রতন বলে, ‘টেঁস্‌ কইরে দ্যাখতাম কিরাম খাতি, তাই! হ্যো কি আমাগের খাবার?’ ফলে পরদিন গ্রামের নানান জনাকে জিজ্ঞেস করে, গাজরের হালুয়া বানানোর, ফর্মুলা বের করে লক্ষ্মী!

কুকুরটা এসে লক্ষ্মীর পাশে দাঁড়ায়! সেও দেখতে থাকে ক্ষেতের মধ্যে রতনের গাজর খাওয়া! ফলে লক্ষ্মী আবার টের পায় তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে! একবার ঠিক করে মানুষটাকে ডাকবে! পরে ভেবেচিন্তে দেখে, কাছে আস্লেই গায়ের মধ্যে ঢুকবে তারচেয়ে গাজর খেতে থাকুক আপাতত! ফলে লক্ষ্মী ঘরে গিয়ে আরেকটা ঘুম দেয় এবং পরেরদিন ভোরবেলা উঠে দেখে তার স্বামী রতন তার পাশে নেই! লক্ষ্মী ব্যস্ত পায়ে ক্ষেতে এসে দেখে, ক্ষেতের মধ্যে একটা মানুষের সাইজের গাজর চিত হয়ে পড়ে আছে, আর ক্ষেতের অর্ধেকের বেশি গাজর নেই! ফলে লক্ষ্মী বিনিবিন সুরে কাঁদতে থাকে, আর বিলাপের সুরে বলতে থাকে, ‘মনের দুক্ষি গাজর হইয়ে গেইল্যে তা আমারে নিইল্যে না ক্যান?!’

অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর, স্বামীর সঙ্গে গাজর হবার বাসনায়, লক্ষ্মী ক্ষেতের বাকি গাজর গুলো খেতে শুরু করে! পরদিন দেখা যায়, কুকুরটা দুটো মস্ত গাজর পাহারা দিচ্ছে ক্ষেতের ফাঁকা জমিনে বসে! কিন্তু পুলিশ সহ কৃষি অধিদপ্তরের লোকজন এসে গাজর দুটিকে ট্রাকে তুলে রাজধানীর দিকে পাঠিয়ে দেয়! জানা যায়, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর হালুয়া খাওয়ার জন্য গাজর দুটিকে কৃষি অধিদপ্তরের ‘চাষার কব্জি, সতেজ সব্জি’ শিরোনাম প্রকল্পের সাফল্য স্মারক উপহার হিসেবে পাঠানো হয়! এবং কুকুরটাকে চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয় কৃষিবন্ধু হিসেবে প্রদর্শন করার জন্য!

২১ ডিসেম্বর ২০২১

ছবি: লেখক থেকে প্রাপ্ত।

রোমেল রহমান নিজের সম্পর্কে এইভাবে বলেন:

রোমেল রহমান:

কবি।

নিয়মিত লেখেন বাংলাভাষার বিভিন্ন পত্রিকা এবং ওয়েবজিনে। মঞ্চ ও পথনাটক রচনা করে যাচ্ছেন, যা দেশ ও দেশের বাইরে মঞ্চস্থ হয়। চিত্রনাট্য রচনার সঙ্গে যুক্ত আছেন। সময় কাটাতে গল্প লেখেন; তার গল্প PEN Bangladesh সাহিত্য পুরস্কার ২০২০ পেয়েছে। 

বসবাস : খুলনা, বাংলাদেশ।

romelabc@gmail.com 

গ্রন্থ :

কবিতা: বিনিদ্র ক্যারাভান, আরোগ্যবিতান 

গল্প/গদ্য: মহামারী দিনের প্যারাবল, প্রোপাগান্ডা বাঘ, 

নাটক: চম্পাকলি লেন ও অন্যান্য নাটক