আলোকচিত্রি আমিরুল রাজিব, গত বছরের সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে ২ দফায় গিয়ে ২২ দিন ছিলেন মিয়ানমার-বাংলাদেশের সীমানা রেখার জেলাগুলাতে। নদী-সমুদ্র-জঙ্গল, গুলি-আগুন-মাইনের ফাঁদ থেকে মরতে-মরতে, বাঁচতে-বাঁচতে নিজ দেশে বেআইনী নাগরিক রোহিঙ্গাদের এদেশে আসা দেখেছেন,উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে ক্যাম্প বাসিন্দা হতে দেখেছেন। নিজের চোখ দিয়ে এবং ক্যামেরার লেন্সে। সেইসব ছবি তোলা, দেখাদেখি আর বুঝাবুঝি নিয়ে রাজিবের সঙ্গে এই কথাবার্তা।
: তো রাজিব, রোহিঙ্গারা তো তাদের দেশের সেনা বাহিনী দ্বারা ষষ্ঠ বারের মতো উৎখাত হৈল, গ্লোবাল মিডিয়াগুলা বলতেসে, রোহিঙ্গাদের ওপর এবারের সন্ত্রাস, সাম্প্রতিক কালের ভয়াবহতম। আপনি ক্যামন দেখলেন-মানে ক্যামন ছবি পাইলেন? আপনারে তো দেখলাম ফেইসবুকে একটা লাইভ ভিডিওতে-ঘুনধুম বর্ডার থেকে, রোহিঙ্গাদের গ্রামে আগুন জ্বলতেসে, এইরকম ভিডিও।
: আমি ধরেন ওইরকম স্টোরি আকারে বলতে পারবো কি-না জানি না। তবে ওইখানে, ছবি তুলতে তুলতে মনে হৈসে, একটা রাষ্ট্র এমন ক্ষমতাধর হৈতে পারে যে অন্য রাষ্ট্র, মিডিয়া কাউকেই এক্সেস না দিয়া একদম একটা ক্লোজড-ডোর ম্যাসাকার, ক্লোজড-ডোর জেনোসাইড চালাইলো রোহিঙ্গাদের ওপর!
আমি সত্যি বলি, ওইখানে সো-কল্ড সাংবাদিকতা করতে যাই নাই . . . স্যুডো-জার্নালিস্ট; আই এম নট
: হুম . . .
: আমি সত্যি বলি, ওইখানে সো-কল্ড সাংবাদিকতা করতে যাই নাই যে ডেড লাইন মিস হৈয়া যাবে, না বুইজ্জাই, না শুইন্যাই ছবি-খবর পাঠায়া দিতে হবে নিউজরুমে। স্যুডো-জার্নালিস্ট; আই এম নট । আমি কারো জন্যই অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে যাই নাই। আমি আমার মতো ঘুরসি, দেখসি, কথা বলসি। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের বান্দারবান সাইডের তমব্রু বর্ডার, ঘুনধুম বর্ডার, নাইক্ষ্যংছড়ির কোনারপাড়া, উখিয়ার আঞ্জুমান পাড়ায়, টেকনাফের দিকে যাওয়ার পথে মিয়ানমার-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ রোড, যেটা ঘুনধুম বর্ডারে মিলছে সেখানে, বালু খালি, পালংখালি, হ্নীলা, এইসব পয়েন্ট দিয়া রোহিঙ্গাদের আসা দেখসি।
মাইন বিস্ফোরণে পায়ের দুই পাশ উড়ে গেছে গিয়া এরকম যেমন দেখসি, আবার দেখসি স্প্লিন্টার আইসা বুকে গাঁথসে, প্রায় ২৫ পার্সেন্টের মতো আগুনে পুইড়া গেছে-এরকমও দেখসি। বাচ্চা দেখসি মাথা ফেটে গেছে, বা একটা বাচ্চাকে দেখসি গায়ে কোপ খাওয়া। তো এরকম বিভিন্ন ধরনের আহত রোহিঙ্গা দেখসি।
সেকেন্ডবার আমি যখন গেসি, মানে অক্টোবরে, তখন দেখলাম যে, একটা রোহিঙ্গা ওয়ার্ড খুলসে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে।কিন্তু সেটা শুধুমাত্র সার্জারি ইউনিট। বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন মানে, ওরা বহুত জায়গা থেকে, ওরা শুধু মাত্র মংদু না, বুথিদং, রাচিদং, আপার মংদু, বুঝছেন, মানে রাখাইন স্টেটের দূর দূরান্ত থেকে আসছে আর কী!
ফার্স্ট ফায়ারিংয়েই নারী এবং শিশুরা পালায়া যাইতে থাকে। আর পুরুষ, সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে থাকে। ৫ জন তখন ওইখানেই ছটফট করতে থাকে এবং ওরা ওইখানে মারা যায়। অনেকেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দৌড়াইতে থাকে।
মানে, কয়েকটা গল্প, মানে ধরেন নিদারুন!
যাদের একদম ডাইরেক্টলি চোখের সামনে দুই ছেলেরে জব কৈরা দিসে বা নিজের কোলের বাচ্চাকে টেনে নিয়ে আগুনে ফেলে দিসে, এরা ছাড়া কাউকে আমি বিলাপ করতে দেখি নাই। মানে মাইনে যে পা বিস্ফোরন হৈসে বা স্প্লিন্টার ঢুকে গলার ভিত্রে গাইথা আছে, আওয়াজ করতে পারতেসে না, ওরে যখন আপনি কিছু বলতেসেন, রোহিঙ্গারা একটা জিনিষ ব্যবহার করে, সেইটা হৈল চোখ। রোহিঙ্গাদের চোখ হচ্ছে অস্বাভাবিক সুন্দর। আমি এরকম সুন্দর চোখের মানুষ পৃথিবীতে দেখি নাই। রোহিঙ্গাদের চোখ হচ্ছে খুবই বুদ্ধিদীপ্ত। খুবই গভীর। এবং রোহিঙ্গারা জাস্ট আপনার চোখে চোখ ফালায়া তাকায়া থাকবে। মানে এইগুলা হচ্ছে আমার একদম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ক্যাম্পে, বর্ডার এরিয়ায়, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের নিয়া। পুরান রোহিঙ্গা. . . পুরান রোহিঙ্গারা হচ্ছে ভিক্ষা করে। কারণ হচ্ছে ওরা অলরেডি ভিক্ষাতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত, বুঝছেন।
আমি একটা গ্রামের ১১ জন নারী-পুরুষকে ইন্টারভ্যু করসি।
:কি নাম গ্রামটার?
:ওইটার নাম হচ্ছে কাউসিবং। বান্দরবানের ঘুনধুম বর্ডার পয়েন্টের উল্টা দিকে, মায়ানমার সাইডে।
ফয়সাল নামে ওই গ্রামের একজনের সাথে কথা বলসি। ৫ ঘন্টা ধরে। ও আরো ১০/১১ জনকে জড়ো করলো।ওদের কাছে পুরা ডিটেইল শুনসি। ওরা একদম অতিরঞ্জন কথা বলে না-এইটুকু আমি ধরতে পারসি। তো, প্রথমে কাউসিবংয়ের ঘটনাটা বলি।
ওই গ্রামে, ওরা শুনতেসিল, রাতের বেলা গোলাগুলি হচ্ছে এবং বেশ ভারী গোলাগুলি হচ্ছে, হ্যা। ওরা বুঝতে পারতেসিল, রেগুল্যার দিন থেকে জিনিষটা আলাদা। মধ্য রাতেই ওদের গ্রামে আর্মি চলে আসে। এসে এক ধরনের কর্ডন তৈরি করসে। কাউসিবং গ্রামের সাথে আরো ৩/৪ টা গ্রামের সীমানা আছে। ওরা বল্লো, ওদের গ্রামগুলা একটু হিলি, হিলি মানে উঁচু নিচু আছে একটু, খাল আছে, বুঝছেন, বাংলাদেশের সাইডের মতো এদের ল্যান্ডস্কেপ না। ওদের ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে অনেক পানি এলাকা আছে। ওইসময় ছিল ভোর বেলা, আলো ফোটার আগে আগেই গ্রামের সব পুরুষ হচ্ছে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে পালায় গেছে, বুঝছেন। এরকম উঁচু নিচু জায়গার মধ্যে পালায় গেছে। এটা হচ্ছে নিয়মিত জিনিষ। যখন গ্রামের মধ্যে আর্মি অ্যাটাক করে, তখন পুরুষরা এরকম পালায়া যায় গ্রামের মধ্যে। তো, ওরা তখন করছে কী, প্রথমবারের মতো ওরা দেখলো, আগেও হৈত, নারীদের লাঞ্চিত করতো। কিন্তু এবার গ্রাম এবং ওইটার এডজাসিং গ্রামের পাড়া থেকে প্রায় দেড়শ থেকে ১৮০ জন মহিলা বাচ্চাসহ আর্মি একজায়গায় জড়ো করসে। এবং ওরা বুঝতে পারতেসিল জিনিষটা নরমাল না এবং এটা ওদের খুব গায়ে লাগতেসিল। কারণ, এরমধ্যে ওদের মসজিদে ঢুকে কোরান জ্বালায়া দিসে এবং মসজিদে হিসু করে দিসে, বুঝছেন।
:ও! হুম।
:এই ঘটনার পরে যখন দেখতেসিল অতিরঞ্জিত পর্যায়ে যাচ্ছে, তখন ওরা আরো ৪/৫ গ্রামের পুরুষরা মিলে মুখে শ্লোগান দিতে দিতে বের হয়ে আসে, বুঝছেন। বের হয়ে আইসা যখন আর্মির দিকে যাবে, ধরেন ৫০০ মিটার থাকতেই, আর্মি ওদেরকে গুলি করা শুরু করে।
ফার্স্ট ফায়ারিংয়েই নারী এবং শিশুরা পালায়া যাইতে থাকে। আর পুরুষ, সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে থাকে। ৫ জন তখন ওইখানেই ছটফট করতে থাকে এবং ওরা ওইখানে মারা যায়। অনেকেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দৌড়াইতে থাকে। ওইসময় কাউসিবং এলাকায় গ্রামের লোকগুলা, তারা তাদের বাড়ি ছেড়ে পালায়া যায়। এবং আর্মিও গুলি করতে করতে চলে যায়।
ফয়সাল হচ্ছে এমন ছেলে, যখন আগুন লাগায়া দেয় তখন সে মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করে লোকেশনের নাম, তারিখ, সময় বইলা। আমি কইসি, তুমি এটা করসো ক্যানো? বলে, প্রথম বাংলাদেশে যখন আসছি, লোকজনেরে যখন বলসি ঘটনা, ভিডিও দেখাইসি, কেউই বিশ্বাস করে না।
ফয়সাল এবং অন্যান্য গ্রামবাসির মতে, কিছু লোক ছাড়া বাদবাকী সবাই বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে দৌড়াইতে থাকে। যারা বুঝতে পারে আর্মি পালায়া গেছে, তারা বাড়িতে গিয়া বস্তা-মস্তা নিয়া কিছু কাপড়-চোপড়, খাবার-দাবার নিয়া দৌড়াইতে থাকে। এই হচ্ছে আর কি।
অনেক লোকের মধ্যে আমি এই টেনডেন্সি দেখসি, ওরা আবার ফেরত গেছে ওদের বাড়ি দেখতে। আমার কাছে অবাক লাগসে যে, ওরা এত দু:সাহসী! পোড়া বাড়ি দেখার জন্য আবার গেছে! ওরা বিশ্বাস করতে পারতেসিল না ওদের বাড়ি পুড়ে গেছে। ফয়সাল আমাকে বারবার বলতেসিলযে, ভাই ভাই, আমি ভাবসিলাম আমার বাড়িটা জ্বালাবে না। এবং এই ছেলেটার চোখে আমি এক ফোঁটা কান্না দেখসি শুধু ওইসময়ই।
আমি বলসি, আপনি কী দেখসেন?
বলে, বাড়ি জ্বালায় দিসে।
আমি বলসি, পুরাটা না অর্ধেক?
তারপর আমার দিকে তাকায়া সে কেন্দে দিসে বুঝছেন।অর্থাৎ, তার চোখ দিয়া পানি বের হয়ে গেছে। আর একটা ফোঁটা সে কান্দে নাই। এবং তার গলাতেও কোন কান্নার ইয়া ছিল না। তার চোখ দিয়া এক ফোঁটা পানি বের হৈসে এবং সে মুছে ফেলসে, বুঝছেন।
এই ফয়সাল আবার ইন্টারেস্টিং। ফয়সাল হচ্ছে এমন ছেলে, যখন আগুন লাগায়া দেয় তখন সে মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করে লোকেশনের নাম, তারিখ, সময় বইলা। আমি কইসি, তুমি এটা করসো ক্যানো? বলে, প্রথম বাংলাদেশে যখন আসছি, লোকজনেরে যখন বলসি ঘটনা, ভিডিও দেখাইসি, কেউই বিশ্বাস করে না। কয় কে করসে না করসে। তখন একটা বুদ্ধি বাইর করসি, যে এভাবে কইরা নিজের নাম ঠিকানা রাখবো, তাইলে তো আর লোকজন মিথ্যুক বলতে পারবে না। আমারে বলে কি, এই আপনি যখন ভিডিও করবেন , আপনার নাম বলবেন, নাইলে কিন্তু মানুষে বিশ্বাস করবে না। ও আমারে এরকম বুদ্ধি দিচ্ছে।
আর একটা হচ্ছে, ও হোয়াটসঅ্যাপ চিনে।
ফয়সাল আর ফয়সালের ভাইরে একবার ধইরা আর্মি অনেক টর্চার করসে, মোবাইল ফোন ব্যবহার করার কারণে। এরপর থেকে ওরা করে কি, ফোনগুলা মাটির নিচে পুইতা রাখে।
: আচ্ছা ওরা কি বাংলায় কথা বলে? ওদের কথা আপনি বুঝছেন ক্যামনে?
ওরা হচ্ছে হেইভিলি চিটাগংয়ের একসেন্টে কথা বলে। অনেকের জন্য বুঝা মুশকিল। আমার জন্য না। আমার ছোটবেলা আব্বার চাকরির কারণে চট্টগ্রামে কাটছে। আমার নিজের বাড়ি হৈল ফেনী। আমি ওই ভাষার টোন জানি, বুঝি। ওরা এম্নিতে ওদের ভাষায় কথা বলে। কিন্তু ওই ভাষায় কথা বলতে থাকলে আশে-পাশের লোকজন বলে কী, অ্যাই বাংলায় বলো বাংলায় বলো। মানে চিটাগংয়ের টোনে কথাকেই ওরা বাংলা বলে। ওদের ওইখানে প্রত্যেকটা গ্রামের দুইটা নাম আছে। একটা হচ্ছে বার্মিজ নাম, আরেকটা হচ্ছে রোহিঙ্গা নাম।
আর ওরা তীক্ষ্ণভাবে তাকায়া থাকে। এবং আপনি যেটা দেখবেন, প্রতিটা চোখ আপনার দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকায়া আছে
এইবার আপনাকে নূর আশার ছবি তোলার কাহিনী বলবো। ওর সাথে আমার দেখা হয় কোনার পাড়া ক্যাম্পে। ওইখানে আরো অনেক নারীদের সাথে দেখা হয়, যাদের শরীরে, মনের ভিত্রে আটকায়া আছে মিলিটারি ব্রুটালিটি।
: ওই ছবিটা অদ্ভুদ হৈসে। ওর চোখের দিকে তাকায়া আমার চোখ আটকায়া ছিল। জন বার্জারের “ওয়েস অফ সিয়িং” পড়তেসিলাম রিসেন্টলি। ওই বইয়ে আমি আমাদের একাত্তরের শরণার্থীদের ছবি দেখসিলাম। ওইটা সানডে টাইমস ম্যাগাজিনকে রেফার করে ছবি দেখা এবং বুঝা আর কনজুমারের রিসিপসন বুঝাইতে ব্যবহার করসিলেন বার্জার। আপনার তোলা নূর আশার ছবি দেইখা, ওর মুখের কালো কাপড়, চোখ, নাক থেকে যেনো ওই বইয়ের ইমেজ আর তার ভিতরকার ইম্প্রেশন রিফ্লেক্ট করলো।
:কাপড়ের কথা যেটা বলতেসিলাম। ওরা রাখাইন কস্টিউম পরে। সেইম। রাখাইন-বুদ্ধিষ্টরা যা পরে, এরাও তাই পরে। ওই থামি পরে, ব্লাউজ পরে উপরে। ঘরে ঢুকলেই ওরা বোরকা খুলে ফেলে। এক হচ্ছে, ওরা পুরান কিছু পরে না। আর ওরা খুবই পরিচ্ছন্ন। ওদের সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।
আর ওরা তীক্ষ্ণভাবে তাকায়া থাকে। এবং আপনি যেটা দেখবেন, প্রতিটা চোখ আপনার দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকায়া আছে, বুঝছেন। এটা আমি মোর অর লেস হসপিটালে দেখসি, ক্যাম্পগুলাতে দেখসি। আউটার এরিয়াতে দেখসি, বর্ডার এরিয়াতে দেখসি। তাকায়া থাকা ছাড়া আর কোন ভাষা নাই।
আর হচ্ছে, একই জায়গায় কত লম্বা সময় ধরে বসে থাকা যায়, এরা হচ্ছে তার নমুনা। এক জায়গায় ধরেন বসে আছে, বসে আছে, বসেই আছে। আমি ৩ বার গাড়ি নিয়া গেসি, দেড় দিনের মতো, ওখানেই, এক জায়গাতেই বসে আছে। কারণ, ওরা তখন কই যাবে! অনেক বৃষ্টি হৈসে, কাদা আর তখনো কোন মেইক শিফট ক্যাম্পও তৈরি হয় নাই। খুব সামান্য নড়াচড়া করে, আমি এরকম দেখসি।
:অনেক বাচ্চা নাকি একা একা চলে আসছে?
:হ্যা। ওরা হারায়া গেছে। ওদের বাপ বা মা, বা দুইজনকেই মেরে ফেলসে মিলিটারিরা।
তবে জানেন, আমি আমার এত বছরের কাজের অভিজ্ঞতায় চিন্তা করতে পারি না, মানুষ মানুষের সাথে এরকম করতে পারে! মানুষের প্রতি মানুষের ক্ষোভ থাকতে পারে, ঘৃণা থাকতে পারে, কিন্তু এইটা কী ধরনের বিহেভিয়ার!
ওর বুকের মধ্যে হচ্ছে ছুরির দাগ। ওর ভ্যাজাইনার মধ্যে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাইসে।
কোনার পাড়ায় চার-পাঁচটা মহিলা একজায়গায় বসেছিল। একটা মহিলা, আমি জানি না কেন, তো আমাকে ধরে খুব কানতেসিল। ওর ঘটনা বলতেসিল। ওরে রেইপ করতে চাইছিল। বুকের দুধ খাওয়া একটা ছোট ছেলে ছিল। ওরা যখন তাকে রেইপ করতে পারে নাই, তখন ওর কোলের বাচ্চাটারে সামনের আগুনে ফালায়া দিসে।ওর বাড়ির মধ্যে আর কি। বলতেসিল আর কানতেসিল। তারপরে সে আমার হাত নিয়ে তার বুকে ধরসে। আমি দেখলাম কি, আমার হাতটা ওর বুকে ডলতেসিল, মহিলারা তো বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায় যে সময়, তখন তো দুধ জমতে থাকে বুকে, না খাওয়ালে তো সমস্যা হয়। আমার মনে হৈতেসিল, তার বুকের মধ্যে একটা ইটের টুকরা। এত শক্ত! আমারে খালি বার বার বলতেসে যে, “বাজি দেখছনি”। “বাজি দেখছনি”, মানে তুমি ফিল করতে পারতেস, মানে ওর ভাষায় বুঝাইতে পারতেসে না, বুঝছেন! চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি বাইর হৈতেসিল।
তারপর নূর আশার যখন ছবি তুলতে গেসি, ওইখানে ১৪/১৫ জন রেইপ ভিক্টিম ছিল। আমি যেইটা করসি, ওদেরকে সব গ্রামবাসি থেকে আলাদা করে, এমন একটা জায়গায় আসতে বলসি, যাতে অন্য কেউ তাদের আইডেন্টিফাই না করতে পারে।
তো সবাই যখন কথা বলতেসিল, বিলাপ করতেসিল, নূর আশা একটা চেয়ারে বইসা ছিল। ও কিচ্ছু বলতেসিল না। ও পুরা কালো রংয়ের ড্রেস পরা ছিল। বোরকা না। কালো সুতি একটা শাড়ির মতো, আর কালো ওড়না পরা, তাকায় আছে, বুঝছেন। এবং ঘামতেসে। এবং ওর চোখ দিয়া পানি পড়তেসে। ও কিছু বলতেসিল না।
রেইপ ভিক্টিমের নাম লুকায়া রাখার কৌশল অবলম্বন না কৈরা আমরা বরং আমাদের দেখার ভঙ্গি পাল্টানোর চেষ্টা করি, সেইটা বেশি দরকার, লুকালুকি খেলার চাইতে।
নূর আশার বয়স ২৫’র মতো। ওর বাচ্চা হৈল ৫টা। তো ওকে যখন, ওর ছোট বাচ্চাটাকে বিছানার ওপর ফেলসে, ওর বুকের ভেতর ছুরি ধরে ওরে ফ্লোরের মধ্যে শোয়াইসে, বুঝছেন! তারপরে ওকে ওইখানে ১০ থেকে ১৫ জন আর্মি মিলে রেইপ করসে। এবং নূর আশা বসতে পারতেসিল না। আর ও যে বইসা আছে, মিনিমাম দেড় হাত গ্যাপ ওর এক পা থেকে আরেক পায়ের। আর ও কানতেসে। ওর বুকের মধ্যে হচ্ছে ছুরির দাগ। ওর ভ্যাজাইনার মধ্যে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাইসে।
আমার খালি একটা জিনিষ মনে হৈতেসিল, আমাদের মিডিয়ার না কিছু প্রবলেম আছে। সোকল্ড মিডিয়া এথিকস প্রবলেম। রেইপ ভিক্টিমের নাম উচ্চারণ করতে, দেখাইতে তো কোন প্রবলেম আমি দেখি না। এই রেইপ ভিক্টিমের নাম লুকায়া রাখার “সিভিল সোসাইটি” প্র্যাক্টিস বরং রেপিস্টকে বাঁচাইসে আর রেইপ ভিক্টিম নারীর ভোগান্তিকে অসম্মান্বিত করসে, ভোগাইসে বেশি। রেইপ ভিক্টিমের নাম লুকায়া রাখার কৌশল অবলম্বন না কৈরা আমরা বরং আমাদের দেখার ভঙ্গি পাল্টানোর চেষ্টা করি, সেইটা বেশি দরকার, লুকালুকি খেলার চাইতে।
আপনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সিঙ্গেল ফ্যামিলি পাবেন না, যার বাপ মরে নাই, ভাই মরে নাই, বোন মরে নাই, মা মরে নাই, ছেলে-মেয়ে মরে নাই, রেইপড হয় নাই। না পাইবেন না। গায়ে কাটা দাগ নাই, বাড়ি পোড়ায় নাই, মানে কেউ এসবের বাইরে না। তো আমরা ৫/৬ লাখ লোকের হিসাব করতেসি, আসছে কি-না। বা ১০ লাখ লোক আসছে কি-না। নাম্বারের মধ্যে আটকায়া আছি। অথচ, প্রত্যেকটা নাম্বারের পেছনে যে এত গল্প, এত ভায়োলেন্স, এত ভয়, এইগুলার ডিটেইলসে আমরা যাই না। দেখতে চাই না। দেখাইতে চাই না।
আমাকে একটা লোক, একটা বান্দাও বলে নাই আর্সার কথা।আমি বহুত রকমের হিন্টস দিয়া, চাতুরি কৈরা, বহুভাবে জিজ্ঞেস করসি বুঝছেন, কেউ বলতে পারে নাই, যে আর্সা নামে কিছু আছে। . . . অনেকে আবার এটাও বলসে, এটা বার্মিজ আর্মি. এটা মোটেও আমাদের কেউ না।
: এই যে এত আর্সার (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) কথা দেখা যায় মিডিয়াতে, ওরা নাকি মায়ানমারের মিলিটারির বিরুদ্ধে ফাইট করতেসে নিজেদের গোষ্ঠী হিসাবে স্বীকৃতির জন্য, রাইটসের জন্য, এই ব্যাপারটা নিয়া কি আলাপ হৈসে কারো সাথে? বা আপনার কি মনে হৈসে?
: একদম সাধারণ মহিলা থেকে জোয়ান, বুড়া পুরুষ- সবাইরে আমি আর্সার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করসি। ওরা শুনসে, কিন্তু ওরা কেউ হচ্ছে আর্সা দেখে নাই।
আমাকে একটা লোক, একটা বান্দাও বলে নাই আর্সার কথা।আমি বহুত রকমের হিন্টস দিয়া, চাতুরি কৈরা, বহুভাবে জিজ্ঞেস করসি বুঝছেন, কেউ বলতে পারে নাই, যে আর্সা নামে কিছু আছে। আর্সায় ওদের গ্রাম থেকে কেউ আছে বা আর্সাকে ওরা দেখসে অস্ত্র নিয়া পার হৈতে বা গ্রামে আসছে খাওয়া খাইতে, এরকম কিচ্ছু বলে নাই। এবং অনেকে আবার এটাও বলসে, এটা বার্মিজ আর্মি. এটা মোটেও আমাদের কেউ না। সরাসরি এ কথা বলসে। এটা ওরা আমাদের শায়েস্তা করার জন্য মিথ্যা কথা বানাইসে। একদম এভাবে বলসে।
: ওরা কি ফেরত যাইতে চায় আর?
:ওদের অনেক লোককে আমি জিজ্ঞেস করসি, আপনারা কি বাড়ি ফেরত যাইতে চান!? এই কথাটা জিজ্ঞেস করলেই না, ওরা ক্যামন একটা দৃষ্টি দেয়, তারপর ওরা বলে কি, যাবো তো। ওটা তো আমার বাড়ি, আমি যাবো।কিন্তু যদি সরকারে কাগজ দেয় আর আমাদের অত্যাচার না করে, তাইলে আমরা যাবো। মেজরিটি অব দ্য লোকজন বলছে, ওরা বাড়িতে যাবে, ওরা এইখানে থাকতে চায় না। ওরা চলে যাইতে চায়। ওদের দেশে যাইতে চায়। ওরা বলে, তোমাদের এদিকে জায়গা কম, আমাদের ওইদিকে জায়গা বেশি, আমাদের অনেক ধানি জমি আছে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়া আমিরুল রাজিবের ফটো স্টোরি