শামীমা বিনতে রহমান
গত বছর মানে ২০২১ সালের সামারে করোনাকালীন কঠিন নিয়ন্ত্রণ ট্যুরিজম-বাণিজ্যের কারণে শিথিল হওয়ায় আমি এবং আমার শিক্ষক, পোস্টকলোনিয়াল স্টাডিজের এসোসিয়েট প্রফেসর একটা ঝুলে থাকা আড্ডা দিতে তালিনের কেজিবি মিউজিয়ামের ২৩ তলার টপফ্লোর রেস্টুরেন্টে বসি। কেজিবি, সোভিয়েত ইউনিয়নকালে যেটা দেশটির প্রধান সিকিউরিটি এজেন্সি ছিল, সেটা এখন জাদুঘর, ট্যুরিস্টদের প্রধান আকর্ষনও। তালিন রাজধানীর স্বাধীন দেশ এস্তোনিয়া স্বাধীন হয় ১৯৯১ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের সাথে-সাথে ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে এবং তখন আমার শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং তার কাছে কেজিবি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন একই জিনিষ, প্রচন্ড ভয়ের, আতঙ্কের। ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে অর্ন্তভূক্তি ও ন্যাটোর সদস্যদেশ হওয়ায় এবং সে অনুযায়ি গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার চর্চা করায় পিরেট পাইকার, আমার শিক্ষক মনে করেন, তিনি তার শৈশব-কৈশরের জীবনের চাইতে এখন অনেক ভালো আছেন। এই দেশে এখন কেজিবি নাই, কেজিবি দেখার একটা মিউজিয়াম আছে, বলে হাসতে হাসতে অন্য এক প্রসঙ্গে জাম্প করে বল্লেন, ‘একটা ব্যাপার খেয়াল করসো? ইরেনা যে কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট হিসাবে অ্যাপ্লাই করলো, আমার কাছ থেকে রেফারেন্স নিলো, এবং তার চাকরি হয় নাই ক্যানো জানো! ও অথরিটিকে বলছে যে ও রাশান ভাষা পারে না। কী আজব!! আমি জানি ও রাশান ভাষায় লিখতে, পড়তে পারে খুবই ভালো। ইউক্রেনিয়ানরা রাশান পারে না, এটা অ্যাটলিস্ট ইস্টার্ন ইউরোপে কেউ বিশ্বাস করবে না। বিষয় হচ্ছে, ও জানে, কিন্তু সে এটা স্বীকার করবে না। কারণ সে মনে করে রাশান ভাষা একটা আধিপত্যের ভাষা। অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য ডে ভাষা জানাটা একটা স্কিল!’
এই যে পুতিন বলে যাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন একই পিপল, এটা কীসের ভিত্তিতে বলছে? এটা বলছে কারণ ইউক্রেনের অনেক লোক রাশান ভাষায় কথা বলে এবং ইউক্রেন একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিল। কিন্তু সেটা পাস্ট। এখন ইউক্রেনে লেখকরা ইউক্রেনিয়ান ভাষায় সাহিত্য করছে, থিয়েটার করছে, আর্ট করছে। ২০১৪ সালে যে ময়দান, ইউরোময়দান আন্দোলন হৈসিল, সেই আন্দোলনে তখন শুধু রাশানপন্থী সরকারের পতন হয় নাই, একটা নতুন ইউক্রেনের জন্ম হৈসে, যে ইউক্রেন রাশিয়ার খবরদারি, নিয়ন্ত্রণ মানে না
ইরেনা পাভলস্কোভা, আমার সহপাঠী এবং কবি এবং অ্যাক্টিভিস্ট রাশান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনিয়ান প্রতিরোধের; রাশান ভাষাকে শুধু আধিপত্য বিস্তারকারী ভাষাই মনে করে না, সে মনে করে এটা রাশিয়ার আগ্রাসনের অস্ত্রও। সম্প্রতি সর্বশেষ আমরা যখন আড্ডা দেই, সে বলছিল,’এই যে পুতিন বলে যাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন একই পিপল, এটা কিসের ভিত্তিতে বলছে? এটা বলছে কারণ ইউক্রেনের অনেক লোক রাশান ভাষায় কথা বলে এবং ইউক্রেন একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিল। কিন্তু সেটা পাস্ট। এখন ইউক্রেনে লেখকরা ইউক্রেনিয়ান ভাষায় সাহিত্য করছে, থিয়েটার করছে, আর্ট করছে। ২০১৪ সালে যে ময়দান, ইউরোময়দান আন্দোলন হৈসিল, সেই আন্দোলনে তখন শুধু রাশানপন্থী সরকারের পতন হয় নাই, একটা নতুন ইউক্রেনের জন্ম হৈসে, যে ইউক্রেন রাশিয়ার খবরদারি, নিয়ন্ত্রণ মানে না।’
সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনের মধ্যে জন্ম নেয়া পিরেটের কাছে কেজিবি যেমন গুম আর নির্যাতনের জন্য আতঙ্কের, স্বাধীন ইউক্রেনে জন্ম নেয়া ইরেনার কাছে রাশিয়া এক দখলবাজ, যুদ্ধবাজের প্রতিচ্ছবি। ইরেনা বলতে থাকে, ‘১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে বেরিয়ে স্বাধীন হওয়া বেশিরভাগ দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হৈতে পারছে, ন্যাটোর সদস্য হৈতে পারছে, আমরা পারি নাই। তারা নিজেদের সম্পদ নিজেরা ব্যবহার করে উন্নতি করছে, ভালো চাকরি করছে, মর্যাদাবান হচ্ছে আর আমরা ইউরোপে থেকেই কোনার মধ্যে সবচে গরীব হয়ে আছি। রাশিয়া আমাদের সবচে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর ক্রিমিয়া কেড়ে নিছে, ডনবাসে যুদ্ধ চালায়া রাখছে সে ২০১৪ থেকেই। আগে তো এই যুদ্ধ এক কোনায় ছিল, ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে তো সেটা পুরা দেশেই। মানসিক, শারীরিক সবভাবেই পুতিন আমাদের ভেঙ্গে দিচ্ছে।’
কেন তিনি ভোর বেলাতেই যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন, সেই প্রশ্নটা কেউ তুলতেই পারেন। কেন মধ্যরাত নয় বা অন্য কোন সময়? প্রসঙ্গত: ৮ ঘন্টার টাইম জোনের ফারাকে কোল্ড ওয়ার সময়কার ‘সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড’সোভিয়েত ইউনিয়ন যার ভূত হিসাবে থেকে যাওয়া রাশিয়ার প্রতিপক্ষ ‘ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড’ খ্যাত ন্যাটোর বিগ ব্রাদার আমেরিকায় তখন ২৩ ফেব্রুয়ারির সান্ধ্য আড্ডার সময়, রাত ৮-৯টা। ওয়েস্টার্ন এবং গ্লোবাল মিডিয়ার হেডলাইন হওয়ার জন্য সময়টা যথেষ্ঠ খাপসই।
২৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ভোরে ভ্লাদিমির পুতিন ঘুমন্ত ইউক্রেনিয়ানদের উপর দেশটির তিন দিক থেকে স্থল, জল, আকাশ পথে যুদ্ধ করে ঢুকে পড়ার নির্দেশ দেন তার বাহিনীদের।
কেন তিনি ভোর বেলাতেই যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন, সেই প্রশ্নটা কেউ তুলতেই পারেন। কেন মধ্যরাত নয় বা অন্য কোন সময়? প্রসঙ্গত: ৮ ঘন্টার টাইম জোনের ফারাকে কোল্ড ওয়ার সময়কার ‘সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড’ সোভিয়েত ইউনিয়ন যার ভূত হিসাবে থেকে যাওয়া রাশিয়ার প্রতিপক্ষ ‘ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড’ খ্যাত ন্যাটোর বিগ ব্রাদার আমেরিকায় তখন ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা। ওয়েস্টার্ন এবং গ্লোবাল মিডিয়া এবং এদের মাধ্যমে লোকালে ছড়িয়ে পড়ার জন্য সময়টা যথেষ্ঠ খাপসই।
যুদ্ধ এখন চলছে। এই লেখা লেখালেখি করার সময় যুদ্ধের অষ্টম দিন চলছে। এরমধ্যে, তথাকথিত রাজনীতির কোন প্রথাগত চর্চা না করা, দুর্নীতিবিরোধী কমেডি নাটক করে সোস্যাল মিডিয়ায় বিপুল জনপ্রিয়তা থেকে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে ২০১৯ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়া ভলোদিমির জেলেনস্কির কাছে পরিস্কার হয়ে পড়েছে যে, যুদ্ধটা তাদেরই করতে হবে। ন্যাটো নামক বড়লোক আত্মীয়স্বজন, ভাই-ব্রাদাররা যে আশ্বাস-বিশ্বাস দিয়েছিলেন, তা পুরাই বাখোয়াজ, তাদের একলাই যুদ্ধ করতে হচ্ছে (Sing, the Independent)। যারা জীবনে একবার হলেও সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল বা ব্যক্তিগতভাবে ব্যক্তিগত আর্মস ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আছে, সবাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে।
রাশিয়া কেন একটা নির্বাচিত সরকার দ্বারা পরিচালিত, স্বাধীন একটা দেশের ওপর যুদ্ধ চাপায় দিল? রাশিয়া কেন যুদ্ধটা শুরু করলো? কৌশলগতভাবে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ইউক্রেনিয়ান অংশ ক্রিমিয়া, যেটা কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী এলাকা, যেখান থেকে নৌপথে অস্ত্র এবং মালামাল পরিবহন, সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ, এবং এশিয়ার দেশগুলাতে খবরদারি করার মোক্ষম জায়গা, সেই জায়গা ২০১৪ সালে দখলে আনার পর, এবং ডনবাসের ডনয়েটস্ক ও লুহানস্ককে ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া বা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার পরও রাশিয়া কী চায় ইউক্রেনের কাছ থেকে? বিষয়টা কী?
পৃথিবীর আর কোথাওকার কোন উত্তাপ এখন আর জায়গা পাচ্ছে না গ্লোবাল মিডিয়া স্ক্রিনে। ইসরাইলি সৈন্যরা যে প্যালেস্টাইনের ১২ বছরের এক মেয়েকে নির্যাতন করছিল, সেই খবর ইনস্টাগ্রামের পপুলার ফ্রন্টের হ্যান্ডলেই কেবল দেখতে পাই ১ মার্চ। ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোয়িচ পুতিনের রাশিয়ার একটা আগ্রাসন, একটা যুদ্ধের জন্যই যেন ওয়েস্ট এবং গ্লোবাল মিডিয়ার অপেক্ষা ছিল। প্রকাশ্যে মিডিয়া ব্যবসা আর অন্তরালে আর্মসের ব্যবসা এখন জমজমাট হয়ে উঠেছে, যার পরিস্কার আভাসটাই যেন ছিল গত বছরের নভেম্বরে রাশিয়ার যুদ্ধ করা নিয়ে অ্যামেরিকার ভবিষ্যত বানীর মধ্যে।
গ্লোবাল মিডিয়ায় অ্যামেরিকার বদৌলতে যেভাবে শুরু যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতি
২০২০ বছরটা যেমন শুরু হয় করোনাভাইরাসের হামলায় টপাটপ মৃত্যুর খবর এবং ভাইরাস দ্রুত ছড়ায় পড়ার ভয়ের খবর দিয়ে, গ্লোবালি এবং লোকালি; ২০২২ সালও শুরু হয়েছিল রাশিয়া ইউক্রেন হামলা করার জন্য সীমান্তে সৈন্য এবং সমরাস্ত্র মোতায়েন করেছে বলে অ্যামেরিকার ধারণা জোরেশোরে মিডিয়ায় সম্প্রচার হওয়ার মাধ্যমে, যদিও দুই ঘটনাই শুরু হয়েছিল তার আগের বছর থেকে। কিন্তু লক্ষ্যনীয় হলো, লোকাল মিডিয়া নয়, প্রথম সম্প্রচারের উৎস গ্লোবাল মিডিয়া এবং তারপর ডিস্ট্রিবিউটেড হয়েছে লোকাল মিডিয়ায়। কীভাবে?
যুদ্ধের দামামা বাজার খবর বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা, ন্যুয়র্কটাইমস, ফক্স নিউজ, দ্য গার্ডিয়ান সবাই অ্যামেরিকার স্পেস টেকনোলজি কোম্পানি ম্যাক্সার টেকনোলজিকে সোর্স হিসাবে বলেছে ম্যাক্সার টেকনোলজির স্যাটেলাইট ইমেজে ২০২১ সালের নভেম্বরে ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় ১ লাখ সৈন্য, ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য সমরাস্ত্র মোতায়েন রাখতে দেখা গেছে রাশিয়ায়।
ম্যাক্সার টেকনোলজিকে উদ্বৃত করে সিএনএন বলেছে, স্যাটেলাইট চিত্র দেখাচ্ছে রাশিয়া স্বয়ংক্রিয় বন্ধুক, ট্যাংক, ইনফেন্ট্রি ফাইটিং ভেহিক্যালস বসিয়েছে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে ১৮৬ মাইল দূরে (Lister, CNN)।
গ্লোবাল মিডিয়া এই খবর যথেষ্ঠ উত্তেজনার সাথে পরিবেশন করে। খবরে রাশিয়া, ন্যাটো, অ্যামেরিকা এবং ইউক্রেন শব্দগুলার সাথে হামলা, আক্রমন, যুদ্ধাস্ত্র, সৈন্য, বর্ডার শব্দগুলা বার বার ব্যবহৃত হতে থাকে।
১১ নভেম্বর আ্যামেরকিা ইউরোপীয়ান ইউনিয়নকে এই বলে সতর্ক করে যে রাশিয়া ইউক্রেন হামলা করে ফেলতে পারে (Nardelli, Jacobs, Wardhams. Bloomberg) । অ্যামেরিকার এই সতর্কতার পর, ন্যাটোর মহাসচিব জেন্স স্টোলটেনবার্গ বল্লেন, ‘আমরা যা দেখছি তা হলো একটা উল্লেখযোগ্য, বৃহৎ রাশিয়ান সামরিক সন্নিবেশ। আমরা দেখতে পাচ্ছি সৈন্যদের ঘনত্ব অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। এবং আমরা জানি যে এ ধরনের সামরিক সক্ষমতা রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আক্রমনাত্মক হামলাতে ব্যবহার করতে চায়। (Amiel, Euronews)
ন্যাটোর মহাসচিব এবং এর বিগ ব্রাদার অ্যামেরিকা তাদের ধারণা এবং জানা দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের উদ্দেশ্য প্রকাশ করতে থাকেন। এবং মিডিয়ায় তৈরি হতে থাকে যুদ্ধের ন্যারেটিভ। এসব শব্দ উৎপাদন-প্রতিউৎপাদনে ইউক্রেন শব্দটা কম উচ্চারিত হতে থাকে, বরং রাশিয়া বনাম অ্যামেরিকা – ন্যাটো যুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ হিসাবে আসতে থাকে।
ময়দান তৈরি হওয়ার পর যুদ্ধের সম্ভাব্য মাসও বেরিয়ে আসে অ্যামেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উৎকন্ঠায়। কেউ যদি বাইডেনকে জ্যোতিষি ভাবেন, ভাবতেই পারেন, কারণ তিনি ফেব্রুয়ারি মাসই বলেছিলেন। ২৮ জানুয়ারির খবরে বিবিসি’র হেডলাইন ছিল: ‘ইউক্রেন সঙ্কট: আগামি মাসে রাশিয়া হামলা করতে পারে বলে বাইডেনের সতকর্তা জারি
ডিসেম্বরের ৭ তারিখে ইউক্রেন হামলা করলে রাশিয়াকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় ফেলা হবে বলে হুমকি দেয় অ্যামেরিকা। (Biden Warns, France 24)। অর্থাৎ, হামলা হলে শাস্তি কী হতে পারে সেটাও চাউর হয়।
ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে রাশিয়া জাতিসংঘ এবং এর সদস্যদের কাছে নিরাপত্তা বিষয়ক তার কিছু দাবির খসড়া জমা দেয়। এর মাধ্যমে রাশিয়া যেন আসলে পরিস্কার করলো, সে কী চায় এবং কার কাছে চায়। যেন রাশিয়া ইউক্রেন হামলা করবে বলে যে ধারণা অ্যামেরিরকা তৈরি করছে, সেগুলাকে ভিত্তি দেয়া। এতে রাশিয়া তার পুরানো শর্ত এবং দাবি আবার উচ্চারণ করে, ‘ন্যাটো ইউক্রেনকে কখনোই সদস্যপদ দেবে না এবং অন্যকোন সাবেক-সোভিয়েত দেশকেও দেবে না এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে নিয়োজিত রাখা ন্যাটোর সৈন্য এবং সমরাস্ত্র প্রত্যাহার করতে হবে। (Russia Demands, Aljazeera)’।
রাশিয়া তার সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সময়কার সীমানার দিকে (পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ) নির্দিষ্ট আঙ্গুল তুলে তার পুরানোতে জেগে উঠার আকাঙ্খা হাজির করে যুদ্ধ-যুদ্ধ ময়দানে। ময়দান তৈরি হওয়ার পর যুদ্ধের সম্ভাব্য মাসও বেরিয়ে আসে অ্যামেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উৎকন্ঠায়। কেউ যদি বাইডেনকে জ্যোতিষি ভাবেন, ভাবতেই পারেন, কারণ তিনি ফেব্রুয়ারি মাসই বলেছিলেন। ২৮ জানুয়ারির খবরে বিবিসি’র হেডলাইন ছিল: ‘ইউক্রেন সঙ্কট: আগামি মাসে রাশিয়া হামলা করতে পারে বলে বাইডেনের সতকর্তা জারি’(Ukraine Crisis, BBC)।
যুদ্ধের কারণ, প্রেক্ষাপট এবং অ্যামেরিকান কোম্পানির স্যাটেলাইট ইমেজের ভিত্তিতে ন্যাটো বা পশ্চিমা জোট বা ‘ওয়েস্ট’য়ের বিগ ব্রাদার অ্যামেরিকার ভবিষ্যতবানী ফলতে ফেব্রুয়ারির তিন সপ্তাহ ব্যয় হয়। ফেব্রুয়ারির ঠিক ২১ তারিখ পুতিন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের লাইভে আসেন জাতির উদ্দেশ্যে কথা বলার জন্য। যুদ্ধ শুরু করার তিন দিন আগে। সেখানে ‘ওয়েস্ট’ বা পশ্চিমা জোটকে পোকার ফেইস বানায়ে তিনি যুদ্ধ শুরুর কোন ঘোষণা দেন না, বরং ডনবাসের ডনয়েটস্ক এবং লুহানস্ককে পূর্ব ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন হিসাবে স্বীকৃতি দেন।
অ্যামেরিকা যেমন আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে গত দুই দশক ধরে নানারকম যুদ্ধ চালানোর সময় যেমন ‘অ্যামেরকিা’ এবং ‘আমাদের নিজেদের লোকদের রক্ষা করার’ কথা বলে যুদ্ধ করেছে, পুতিনও সেরকমই বল্লেন। ন্যাটোর বস অ্যামেরিকার বিস্তর সমালোচনা করে পুতিন অ্যামেরিকার মতোই জায়েজ করলেন ‘রাশিয়া এবং আমাদের লোকদের রক্ষা করার জন্য এ ছাড়া আর কোন উপায় বাকী নেই।’
ওই লাইভ টেলিভাইজড অনুষ্ঠানে তিনি তার চোখ, ভ্রু, ঠোঁট ঘুরায়ে, খয়েরি রঙের টাইয়ে আঙ্গুল চালিয়ে সরকারের গোয়েন্দা প্রধানকে চাপে ফেলে মনোজাগতিক খেলাও খেলেন। এইরকম খেলা খেলার জন্য বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বাম ঘরানার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা পুতিনের প্রতি গোপন ভালোবাসার উচ্ছাস প্রকাশ করেন, কিন্তু কার্যত: এটা পুতিনের একটা সামন্তীয় এক্সপ্রেশন।
স্কাই নিউজ (Russian President addresses the nation, Sky news) সম্প্রচারিত লাইভে দেখা যায়, রাশান ফরেন ইন্টিলিজেন্স সার্ভিসের প্রধান সের্গেই ন্যারিস্কিন কথা বলতে ডায়াসে এসেছেন এবং পুতিন তার ডানদিকে আরেকটি একক চেয়ারে বসে শুনছিলেন। সের্গেই কথা বলা শুরু করার পরই পুতিন তাকে বলেন পরিস্কারভাবে কথা বলতে। সের্গেই তখন বলেন,
সের্গেই: স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাবকে আমি সমর্থন করবো
পুতিন: সমর্থন করবেন নাকি সমর্থন করেন? পরিস্কারভাবে বলেন সের্গেই
সের্গেই: আমি সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছি। ডনয়েটস্ক এবং লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিক রাশিয়ান ফেডারেশন ভূক্ত হওয়ার প্রস্তাব আমি সমর্থন করি।
পুতিন: (একটা পুতিনীয় হাসি দিয়ে) আমরা এটা নিয়ে কথা বলি নাই, এটা আমরা আলোচনাও করি নাই। আমরা আলোচনা করেছি তাদের স্বাধীনতার বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেব কি-না
সের্গেই: হ্যা, আমি তাদের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব সমর্থন করি।
পুতিন: গুড, এখন প্লিজ বসেন। ধন্যবাদ
এই যে চাপের মুখে রেখে তার সরকারের একটা এক্সিকিউটিভ বডির একজন প্রধানকে একটা এলোমেলোর মধ্যে ফেলে দিলেন, এটা পুতিন। চাপে ফেলে সের্গেইর চাপিষ্ঠ মগজ নিয়ে খেলাধুলা করতে করতে পুতিন সেদিনও এমন ধারনাই দিচ্ছিলেন, তিনি শুধু ডনয়েটস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন পিপলস রিপাবলিক হিসাবে স্বীকৃতি জানিয়েছেন, এর বেশি কিছু নয়। অর্থাৎ, যুদ্ধ নয়।
যুদ্ধ রাশিয়ার উদ্দেশ্য নয় বার বার পুতিন বলে আসলেও, ২৪ তারিখ ভোরে তিনি বাইডেনের ভবিষ্যতবানী ফলিয়ে দিয়ে ফেব্রুয়ারিতেই যুদ্ধটা শুরু করে দিলেন।
অ্যামেরিকা যেমন আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে গত দুই দশক ধরে নানারকম যুদ্ধ চালানোর সময় যেমন ‘অ্যামেরিকা এবং ‘আমাদের নিজেদের লোকদের রক্ষা করার’ কথা বলে যুদ্ধ করেছে, পুতিনও সেরকমই বল্লেন। ন্যাটোর বস অ্যামেরিকার বিস্তর সমালোচনা করে, পুতিন অ্যমেরিকার মতোই জায়েজ করলেন ‘রাশিয়া এবং আমাদের লোকদের রক্ষা করার জন্য এ ছাড়া আর কোন উপায় বাকী নেই (No Other Option, Al jazeera)’।
এবং লক্ষ্য হিসাবে অ্যামেরিকা যেমন ইরাকে (২০০৩), লিবিয়ায় (২০১১) তখনকার ক্ষমতাসীনদের অপসারণ করেছিলেন, পুতিনও তেমনি যুদ্ধের ঘোষণা হিসাবে ইউক্রেনের বর্তমান সরকারের পতনকে লক্ষ্য হিসাবে নির্দিষ্ট করেন, ইউক্রেন দখল নয়।
১৯৯১ সালে স্বাধীন হবার পর ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত ভ্লাদিমির পুতিনকে বেশি একটা মাথা ঘামাতে হয় নাই ইউক্রেন নিয়ে। কিন্তু ২০১৪ সালের ইউরোময়দান আন্দোলন এবং সে আন্দোলনে রাশানপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোয়িচের পতন ঘটলে রাশিয়া তার পন্থী লোক হারায় ইউক্রেনিয়ায়। পুতিন দখলবাজ হয়ে ওঠেন। কৌশলগতভাবে ইউক্রেনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, ক্রিমিয়া দখল করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন।
পুতিন কেন ইউক্রেনের বর্তামন সরকার উৎখাত করতে চান?
এর প্রথম এবং প্রধান উত্তর হলো ২০১৪ সালের ইউক্রেনিয়ানদের ইউরময়দান আন্দোলন, যাতে ১০৩ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়ে পুতিনকে স্পস্ট বার্তা দিয়েছিল, তারা রাশিয়া নয়, ইউরোপের সাথে থাকতে চায় জোটবদ্ধ হয়ে।
১৯৯১ সালে স্বাধীন হবার পর ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত ভ্লাদিমির পুতিনকে বেশি একটা মাথা ঘামাতে হয় নাই ইউক্রেন নিয়ে। কিন্তু ২০১৪ সালের ইউরোময়দান আন্দোলন এবং সে আন্দোলনে রাশানপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোয়িচের পতন ঘটলে রাশিয়া তার পন্থী লোক হারায় ইউক্রেনিয়ায়। পুতিন দখলবাজ হয়ে ওঠেন। কৌশলগতভাবে ইউক্রেনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ক্রিমিয়া দখল করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন।
২১ ফেব্রুয়ারি ইয়ানুকোয়িচের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই পুতিন ২১-২২ ফেব্রুয়ারি, দুই দিন-রাত ব্যাপী নিরাপত্তা বাহিনী বা ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের উচ্চ পদস্থদের সাথে বৈঠক শেষে সিদ্ধান্ত জানালেন’ ‘আমাদের অবশ্যই ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার কাছে ফিরায়ে আনার জন্য কাজ শুরু করতে হবে’(Vladimir Putin describes secret meeting), The Guardian।
এর ৫ দিন পরই, ২৭ ফেব্রুয়ারি সৈন্য পাঠায় রাশিয়া এবং ১৬ মার্চ গণভোটের মাধ্যমে (শতকরা ৯০ ভাগ ইউক্রেনিয়ান তখন ভোট বয়কট করেছিল) ক্রিমিয়াকে ইউক্রেন থেকে দখলে নেয়। সোভিয়েত রাশিয়ায় একটা লম্বা সময় ধরে অংশ ছিল ক্রিমিয়া কিন্তু ইউক্রেনের স্বাধীনতার পর সেটা ইউক্রেনের অংশই ছিল।
এবং সর্বোপরি, গত বছর জেলেনস্কি রাশান ভাষার তিনটি সংবাদ চ্যানেল বন্ধ করে দেন রাশান প্রোপাগান্ডা চালানোর অভিযোগে। এই তিন চ্যানেলের মালিক ছিলেন ব্যবসায়ী ও ইউক্রেনের সংসদ সদস্য ভিক্টর মেদভেদচুক। তার আসলে বড় পরিচয় তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
নিজের লোক ইউক্রেনিয়ান সরকার থেকে পতিত হবার পর পুতিন আরো একটা বিষয় শুরু করে ইউক্রেনের ভেতর রাশিয়াকে জারি রাখলেন। সেটা হলো পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাসের ডনয়েটস্ক এবং লুহানস্কে পিপিলস রিপাবলিক গঠন করে ইউক্রেনিয়ান আর্মির সাথে যুদ্ধ শুরু করা। সেই ২০১৪ সালেই। রাশানভাষাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে এপ্রিল মাস থেকে দুই সীমান্তবর্তী এলাকায় রাশানভাষীদের সংগঠিত করা হয় স্বাধীন ভূখন্ডের দাবিতে। ইউক্রেন আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীন এলাকা হিসাবে টিকিয়ে রাখার জন্য রাশিয়া সেখানে যুদ্ধাস্ত্রের সরবরাহ ছাড়াও যুদ্ধে অভিজ্ঞদেরও নিয়োজিত করেছিল।
২০১৪’র জুলাই মাসে প্রকাশিত রয়টার্সের এক প্রতিবেদন বলছে, ক্রেমলিন বার বার অস্বীকার করলেও রাশিয়ার যুক্ততা একদম পরিস্কার বোঝা যায় (Baczynska and Vasovic, Reuters)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সেই সময় আলেকজান্দার বরোদি, যিনি বতর্মানে রাশিয়ার ফেডারেল অ্যাসেম্বলির সদস্য এবং ২০১৪ সালে দখলে নেয়া ক্রিমিয়ার প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছিলেন, তিনি ডনয়েটস্ক রিপাবলিকের স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী হন। তার উপপ্রধানমন্ত্রী হিসাবে যুক্ত করেন ভ্লাদিমির আন্টেয়্যুফেইয়েভকে যার জর্জিয়া এবং মালডোভার রাশানভাষীদের পক্ষে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ডনয়েটস্ক পিপলস রিপাবলিক বা ডিপিআরের সশস্ত্র গ্রুপের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন রাশিয়ান সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের ইগর গিরকিন। তখন পুতিন বলেছিলেন, ইউক্রেন দখল করতে নয়, রাশানভাষী জনগণকে রক্ষা করতে সেখানে সশস্ত্র সেনাবহর পাঠানো হয়েছিল (Fisher, Vox)
ডনবাস এলাকায় রাশিয়ার সশস্ত্র অবস্থান রাখার পরও পুতিন ইউক্রেন নিয়ে স্বস্থিতে ছিলেন না। ইউরোময়দান আন্দোলনের পর ২০১৪’র নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসেন রাশিয়া বিরোধী পেত্রো পোরোশেঙ্কো। তিনি রুশপন্থী সাবেক ইউক্রেনিয়ান প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোয়িচ ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশ হবার জন্য যে চুক্তি করেন নি, তিনি তা করেন ক্ষমতায় এসেই। সেটা অর্থনৈতিক চুক্তি, অর্থাৎ ওই চুক্তির ফলে ইউক্রেন ইইউ’র সহযোগি সদস্য দেশ হয়, পূর্ণ নয়। ইইউতে ইউক্রেনের এতটুকু পরিবর্তনই পুতিনের মাথাব্যথার জন্য যথেষ্ঠ ছিল।
কিন্তু পোরোশেঙ্কো সরকারের দুর্নীতি, অর্থনীতির বেহাল দশার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে না পারার বাস্তবতায়ও রাশানপন্থী কোন রাজনীতিবিদ তার প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠতে পারেন নি পরবর্তী ২০১৯’র নির্বাচনে। বরং কমেডিয়ান ও অভিনেতা ভলোদিমির জেলোনস্কির দুর্নীতি বিরোধী স্যাটায়ার টিভি সিরিজ দ্য সারভেন্ট অব দ্য পিপল এতো জনপ্রিয়তা দিল তাকে যে তিনি ওই টিভি সিরিজের নামেই দল গড়লেন এবং পোরোশেঙ্কোকে হারিয়ে আরেক রাশিয়া বিরোধী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে রাশিয়ানপন্থী রাজনৈতিক দল অপজিশন প্লাটফরম ফর লাইফ বা ওপিএফএল প্রার্থী উরি বয়কো পায় মাত্র ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ ভোট (Election, CEC)
২০১৯ এ ক্ষমতায় আসার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ইউক্রেনকে সহযোগি সদস্য থেকে পূর্ণ সদস্য করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে জোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন এবং সর্বোপরি, গত বছর জেলেনস্কি রাশান ভাষার তিনটি সংবাদ চ্যানেল বন্ধ করে দেন রাশান প্রোপাগান্ডা চালানোর অভিযোগে। এই তিন চ্যানেলের মালিক ছিলেন ব্যবসায়ী ও ইউক্রেনের সংসদ সদস্য ভিক্টর মেদভেদচুক। তার আসলে বড় পরিচয় তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
এ ঘটনায় পুতিন প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হন এবং জেলেনস্কি সরকারকে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’, ‘নাজী’ এবং ‘রাশান ঘৃণাকারী’ হিসাবে গালাগালি করেন (Guest, RT)।
জেলেনস্কি সরকারের এসব কর্মকাণ্ড পুতিনকে বিপন্ন করে তোলে। পুতিন আশঙ্কা করতে থাকেন রাশান বিরোধী সরকার ক্ষমতায় থাকা মানেই ইউক্রেন ন্যাটোর হাতে চলে যাবে। আর পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর হাতে যাওয়া মানেই সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ সীমানাগুলোও প্রায় নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাওয়া।
গণমাধ্যম যেখানে রাশিয়ার ইউক্রেনের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়াটা সাবেক কোল্ড ওয়ারের পক্ষ-প্রতিপক্ষ রোমান্সে পুতিন বনাম অ্যমেরিকা বা রাশিয়া বনাম ন্যাটো ওরফে আ্যামেরিকার মধ্যে ফ্রেইমড করে যুদ্ধের ন্যারেটিভ প্রচার করছে, সেখানে ইউক্রেনের জনগণের চাওয়া দৃশ্যত উধাও। দৃশ্যপটে তবুও প্রশ্ন ওঠে, রাশিয়া কেন ইউক্রেন ছাড়তে চায় না? বা এলিট সামরিক জোট ন্যাটো কেন রাশিয়া বিরোধী জোটকে সমর্থন করে ইউক্রেন চায়?
নরওয়ের পর ইউরোপে সবচে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস সংরক্ষিত আছে ইউক্রেনে, ১.০৯ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার। . . . ইউক্রেন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ইউক্রেনের মাটির নীচে সংরক্ষিত গ্যাসের ওপর রাশিয়া পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ হারাবে। অন্যদিকে, জার্মানীসহ ন্যাটো দেশগুলাও চায়, গ্যাস নিয়ে রাশিয়ার কর্তৃত্ব বন্ধ করতে, সেক্ষেত্রে ইউক্রেন একটা মোক্ষম জায়গা রাশিয়াকে প্রতিস্থাপিত করার।
গরীব ইউক্রেন কেন রাশিয়া – ন্যাটোর টার্গেট
পৃথিবীর দেশে-দেশে চোখ ফেলে তাকালে দেখা যায় প্রাকৃতিক সম্পদে সবচে সমৃদ্ধশালী দেশগুলাই বড়লোক দেশের ডিপ্লোম্যাটিক মারপ্যাচে গরীব থেকে গরীবতর হয়ে যায় আর বড়লোক দেশের ব্যবসায়ীদের মানি-মেশিন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো বা ডিআরসি। আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল-গ্যাসের মজুদ ছাড়াও কয়লা, হীরা, স্বর্ণ, কপার, টিনের খনি থাকার পরও পৃথিবীর দ্বিতীয় গরিবতম দেশ হিসাবেই তালিকাভূক্ত হয়ে থাকছে।
ইউক্রেনও গরীব। বর্তমানে ইউরোপের সবচে দরিদ্র দেশ (মাথাপিছু ৩ হাজার ৫৪০ ডলার) এটি। অথচ, এসব র্যাঙ্কিং থেকে চোখ সরালেই চোখে পড়ে ইউক্রেনের সমৃদ্ধি।
নরওয়ের পর ইউরোপে সবচে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস সংরক্ষিত আছে ইউক্রেনে, ১.০৯ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার। কিন্তু এই গ্যাস এখনো উত্তোলন শুরু হয় নি, কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন সময়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ি গ্যাস উত্তোলন শুরু হয় সাইবেরিয়া থেকে, সেটা এখনও চলছে এবং এখানকার গ্যাসই রাশিয়া থেকে ইউরোপে রপ্তানী হচ্ছে। ইউক্রেনকেও নিজে দেশে গ্যাস থাকার পরও রাশিয়া থেকে কিনে খেতে হচ্ছে। ইউক্রেন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ইউক্রেনের মাটির নীচে সংরক্ষিত গ্যাসের ওপর রাশিয়া পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ হারাবে। অন্যদিকে, জার্মানীসহ ন্যাটো দেশগুলাও চায়, গ্যাস নিয়ে রাশিয়ার কর্তৃত্ব বন্ধ করতে, সেক্ষেত্রে ইউক্রেন একটা মোক্ষম জায়গা রাশিয়াকে প্রতিস্থাপিত করার।
এসবের চেয়ে সবচে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে দুটি খনিজ সম্পদ ইউক্রেনর আছে তা আগামীর পৃথিবীর জন্য সবচে চাহিদা সম্পন্ন, একইসঙ্গে পরিবেশবাদী হয়ে ওঠা বড়লোক দেশের গাড়ি এবং মহাকাশ অভিযানের জন্য জরুরী। এগুলার একটা হলো টিটেনিয়াম, গোটা দুনিয়ার মোট পরিমানের ২০ শতাংশ ইউক্রেনেই আছে, যেটা উড়োজাহাজ এবং মহাকাশযান নির্মানের প্রধান উপাদান। আরেকটি হলো লিথিয়াম, যা হালের বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির অন্যতম প্রধান উপাদান।
বীজ থেকে তৈরি তেল, অনেক দেশের প্রধান খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত গম এবং ভুট্টারও প্রধান যোগানদাতা ইউক্রেন, প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। লোহা এবং কয়লার রয়েছে বিশাল সব খনি।
এসবের চেয়ে সবচে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে দুটি খনিজ সম্পদ ইউক্রেনর আছে তা আগামীর পৃথিবীর জন্য সবচে চাহিদা সম্পন্ন, একইসঙ্গে পরিবেশবাদী হয়ে ওঠা বড়লোক দেশের গাড়ি এবং মহাকাশ অভিযানের জন্য জরুরী। এগুলার একটা হলো টিটেনিয়াম, গোটা দুনিয়ার মোট পরিমানের ২০ শতাংশ ইউক্রেনেই আছে, যেটা উড়োজাহাজ এবং মহাকাশযান নির্মানের প্রধান উপাদান। আরেকটি হলো লিথিয়াম, যা হালের বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির অন্যতম প্রধান উপাদান।
ন্যুইয়র্ক টাইমস বলছে, ‘ইউক্রেনের গবেষকদের দাবী অনুযায়ী সেখানে প্রায় ৫ লাখ টন লিথিয়াম আছে আর তাই যদি হয়, তাহলে এটিই হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান লিথিয়ামের মজুদ (Tabuchi, The New York Times)’
এসব ঈর্ষনীয় সম্পদ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকুক ইউরোপের এলিট দেশগুলার জন্য যেমন অস্থিরতার বিষয়, ইউক্রেন হারিয়ে পুতিনও তা কোনভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না।
স্বপ্নের তো সমস্যা নাই, সমস্যা হচ্ছে সংকীর্ন হয়ে, সামন্তীয় মানসিকতায় সমাজতন্ত্রের লেবেল লাগায়ে সাম্রাজ্য বিস্তার আর কতৃর্ত্ব ফলানোর খায়েশে চোখে ঠুলি পরে বর্তমানের বাস্তবতা দেখতে না পাওয়া। পুতিন দেখতে পাচ্ছেন না স্বাধীন, মর্যাদাপূর্ণ দেশ হিসাবে গড়ে ওঠার ইউক্রেনিয়ানদের স্পৃহা, তাদের আকাঙ্খা, তাদের স্বপ্ন।
রাশিয়া ইউক্রেন আরো এক কারণে হারাতে চায় না, কারণ ইউক্রেন হলো ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে যে তিনটি স্যোসালিস্ট রিপাবলিক মিলে ইউএসএসআর বা সোভিয়েত স্যোসালিস্ট রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করে, রাশিয়া এবং বেলারুশ ছাড়া অন্যটি হলো ইউক্রেন।
পুতিন বারবার এলিট ন্যাটোকে যেসব শর্ত দিচ্ছে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য না করার জন্য, সেসব শর্ত বিবেচনা করলে ইউরোপের মানচিত্র আবার বদলে যায় আর বদলে যা হয় তা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সময়কার মতো। আর তার জন্য কোনভাবেই ইউক্রেনকে হাতছাড়া করতে চায় না এর স্বপ্নদ্রষ্টা ভ্লাদিমির পুতিন যিনি ১৯৯৯ সাল থেকে কখনো ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট, কখনো প্রধানমন্ত্রী, কখনো পূর্ণমাত্রার প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাশিয়ার ক্ষমতায় আছেন।
স্বপ্নের তো সমস্যা নাই, সমস্যা হচ্ছে সংকীর্ন হয়ে, সামন্তীয় মানসিকতায় সমাজতন্ত্রের লেবেল লাগায়ে সাম্রাজ্য বিস্তার আর কতৃর্ত্ব ফলানোর খায়েশে চোখে ঠুলি পরে বর্তমানের বাস্তবতা দেখতে না পাওয়া। পুতিন দেখতে পাচ্ছেন না স্বাধীন, মর্যাদাপূর্ণ দেশ হিসাবে গড়ে ওঠার ইউক্রেনিয়ানদের স্পৃহা, তাদের আকাঙ্খা, তাদের স্বপ্ন।
গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠার দুনিয়াদারীর খেলায় ভ্লাদিমির পুতিন গুরুত্বহীন না হয়ে পড়ার জন্যই ঘুরিয়ে বেড়াচ্ছেন আব্বাগিরির ছড়ি যাতে প্রতিফলিত হচ্ছে একানব্বইয়ের গর্ভাচেভ আমলের অগাস্ট ক্যু।
ইউক্রেনের ওপর পুতিনের আব্বাগিরি দেখা যায় তার বিভিন্ন ভাষা ব্যবহারে। যুদ্ধ শুরু করে দেয়ার দ্বিতীয় দিনই তিনি যোদ্ধা ইউক্রেনিয়ানদের বলতে থাকেন ‘গ্যাঙস অব ড্রাগ এডিক্টেড। এর আগে তো তিনি সারাক্ষণই ইউক্রেনের ইউরোময়দান আন্দোলনকারীদের ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’ এবং ‘নব্য-নাজী’ হিসাবে গালাগালি করেছেন।
পুতিনের আব্বাগিরি এবং একানব্বইয়ে অগাস্ট ক্যু’র চেতনা পারবে কি ইউক্রেনকে দাবায়ে রাখতে?
আব্বাগিরি ব্যাপারটা তো আসলে তাই-ই — যৌথ পরিবার বা একক পরিবার যাই-ই হৌক, পরিবার প্রধান, ক্ষমতার উৎস, পুংদন্ডের ধারক এবং বাহক হিসাবে আব্বারা পরিবারের সকল সদস্যদের বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া, দেয়া এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আব্বাগিরি করে বেড়ান। শাস্তি এবং ভালোবাসা দুইটাই তার সিস্টেম অনুযায়ি বরাদ্দ হবে এবং তার সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণে যাওয়া যাবে না, এবং পরিস্থিতি অনুযায়ি গায়ের জোর খাটিয়ে ক্ষমতা রাখতে হবে। একই ধরনের ক্ষমতার চর্চাকারী চেয়ারে যদি নারী থাকেন, তাহলে সেইটা আম্মাগিরি, যেইটা বাংলাদেশে চলছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আলাপের বিষয় পুতিনের আব্বাগিরি, তাই অন্য আলাপ আপাতত: সীমানার ওইপারে থাকুক।
ইউক্রেনের ওপর পুতিনের আব্বাগিরি দেখা যায় তার বিভিন্ন ভাষা ব্যবহারে। যুদ্ধ শুরু করে দেয়ার দ্বিতীয় দিনই তিনি যোদ্ধা ইউক্রেনিয়ানদের বলতে থাকেন ‘গ্যাংগস অব ড্রাগ এডিক্টেড’ (Putin calls, The Print)। এর আগে তো তিনি সারাক্ষণই ইউক্রেনের ইউরোময়দান আন্দোলনকারীদের ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’ এবং ‘নব্য-নাজী’ হিসাবে গালাগালি করেছেন।
পুরাই প্যাট্রিয়ার্কিতে ভরা আব্বারা যেমন পরিবারের কোন সদস্যের ভিন্ন চিন্তা না মানতে পারলে নৈতিকতাকে ব্যবহার করে গালাগালি করে, সেরকম
যৌথ এবং একক পরিবারের আব্বারা যেমন সন্তানের নিজস্ব গলার স্বরে পরিবারের নিয়ম কানুন অমান্য করা মানতে পারেন না, উল্টা কারো না কারো চক্রান্ত খোঁজেন, সেরকমভাবেই পুতিন যুদ্ধের ঘোষণার দিন বল্লেন, ‘ইউক্রেনকে জিম্মি করে যারা আমাদের দেশ এবং জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, যুদ্ধটা তাদের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ, তিনি ইউক্রেনিয়ানদের দেখলেন না, তাদের স্পৃহা ধরতে পারলেন না, তাদের পুরা ফেইসলেস করে তিনি প্রতিপক্ষ হিসাবে হাজির করলেন তার পূর্বতম ইগো পাল্লা-পাল্লির শত্রু ন্যাটোকে। যেন যুদ্ধটা ন্যাটোর বিরুদ্ধে, ইউক্রেন জাস্ট একটা প্যাসিভ এনটিটি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে পুতিন কেন এত পরিবার, ইতিহাসের কথা বলে সম্পর্ক ধরে রাখতে চান? এর গোড়াটা কোথায়?
আবার এই পুতিনই বলতে থাকেন, আমরা তো একই পরিবার – ইউক্রেনিয়ান এবং রাশান একই জনগন (Guest, RT)। ডনবাসের দুই অংশের স্বাধীনতার স্বীকৃতির দিন ২১ ফেব্রুয়ারি পুতিন ইতিহাসে ডুব দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, তখনকার রাশিয়ান এসএফএসআরের সাথে সম্পর্ক তুলে ধরে বলতে থাকেন, ‘ইউক্রেন শুধু আমাদের প্রতিবেশি দেশই নয়, এটা আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিক দুনিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাশানদের সঙ্গে তাদের রক্তের সম্পর্ক, পারিবারিক সম্পর্ক’ (Guest, RT)।
অর্থাৎ, ভ্লাদিমির পুতিন সোজা সাপ্টা যে কথা বারবার অস্বীকার করছেন, সেটা হচ্ছে রাশিয়ার প্রতি ইউক্রেনিয়ানদের ‘না’ যে ইউক্রেনিয়ানদের নিজস্ব গলার স্বর, প্রাণের দাবি, সেটা। তিনি মানতে এবং হজম করতেই পারছেন না। যৌথ এবং একক পরিবারের আব্বারা যেমন সন্তানের নিজস্ব গলার স্বরে পরিবারের নিয়মকানুন অমান্য করা মানতে পারেন না, উল্টা কারো না কারো চক্রান্ত খোঁজেন, সেরকম ভাবেই পুতিন যুদ্ধের ঘোষণার দিন বল্লেন, ‘ইউক্রেনকে জিম্মি করে যারা আমাদের দেশ এবং জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, যুদ্ধটা তাদের বিরুদ্ধে (No other option, Al Jazeera)।’
অর্থাৎ, তিনি ইউক্রেনিয়ানদের দেখলেন না, তাদের স্পৃহা ধরতে পারলেন না, তাদের পুরা ফেইসলেস করে তিনি প্রতিপক্ষ হিসাবে হাজির করলেন তার পূর্বতম, ইগো পাল্লা-পাল্লির শত্রু ন্যাটোকে। যেন যুদ্ধটা ন্যাটোর বিরুদ্ধে, ইউক্রেন জাস্ট একটা প্যাসিভ এনটিটি।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, পুতিন কেন এত পরিবার, ইতিহাসের কথা বলে সম্পর্ক ধরে রাখতে চান? এর গোড়াটা কোথায়?
এর গোড়া আসলে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায় ভেঙ্গে-ভেঙ্গে পড়ছে, সেই ১৯৯১ সালেই। মিখাইল গর্ভাচেভের সময়ে। তখন পুতিন কেজিবি’তেই ছিলেন। মিখাইল গর্বাচেভের পেরস্ত্রয়কা বা সংস্কারের নীতি, এবং গ্লাসনস্ত বা উদারনীতির কারণে যখন পূর্ব ইউরোপ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই আলগা হয়ে পড়ে এবং গর্বাচেভের নিউ ইউনিয়ন চুক্তির মাধ্যমে ইউনিয়নভূক্ত রিপাবলিকগুলাতে গণতন্ত্রায়নের সুযোগ হচ্ছিল, তখন ক্ষমতাসীনদের পার্টি কম্যুনিস্ট পার্টি অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সিপিএসইউ’র আটজন হাই অফিসিয়াল দুই দিনের জন্য গর্বাচেভ থেকে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় (The attempted coup, Britannica)।
১৯৯১ সালের ১৯ অগাস্ট এই ক্যু হয় বলে একে অগাস্ট ক্যু বলা হয় এবং ওই আটজন গ্যাং অব এইট নামেও পরিচিত। এই ৮ জন স্টেট কমিটি অন দ্য স্টেট অব ইমার্জেন্সি গঠন করে। এরমধ্যে ছিলেন তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেন্নাদি ইয়ানায়েভ, প্রধানমন্ত্রী ভেলেনটিন পাভলভ, ইন্টেরিয়র মিনিস্টার বরিস পুগো, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং মার্শাল অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ডিমিত্রি ইয়াজভ, কেজিবি চেয়ারম্যান ভ্লাদিমির ক্রুচকভ, প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের প্রধান ডেপুটি কাউন্সিলর ওলেগ বাকলানভ, ইউএসএসআর এর কৃষক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভাসিলি স্টারোডুবসেভ এবং এসোসিয়েশন অব স্টেট এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান আলেকসান্দ্রর তিজিয়াকভ (The men who, The Moscow Times)
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার আগে আগে এই হার্ডলাইনাররা সমাজতন্ত্রহীন, সমাজতন্ত্রের নামে একনায়কতান্ত্রিকতায় পূর্ণ ইউনিয়ন জোর করে, ভয় দেখিয়ে, ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। অবশ্য পরিস্থিতিটা তখন যথেষ্ঠ জটিল ছিল, গোটা দুনিয়ায় একটা আশাহত, আশাভঙ্গের বেদনায় আর্ত ছিল। খুব চট করে বটম লাইন মন্তব্য করা সম্ভব না, কিন্তু এটা বলা যায়, সমাজতন্ত্রী আন্দোলনকারীদের কাছে বিষয়টা খুব আবেগের ছিল। সেই আবেগ পুতিনেরও ছিল, কিন্তু সেই আবেগকে তিনি ব্যবহার করছেন আব্বাগিরিতে।
আর নিজেদের প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদের দায়িত্ব নিজেরাই বুঝে নিতে পালে এই ইউক্রেনিয়ানরাই হয়ে উঠবে ইউরোপের অন্যতম প্রধান দেশ। ইউক্রেনিয়ানরা জানে তখন ন্যাটো তাদের কাছে দর কষাকষি করতে আসবে, রাশিয়া নেগোসিয়েশন এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করতে উন্মুখ থাকবে। ইউক্রেনের জনগণকে দাবায়া রাখতে পারবে না রাশিয়া।
যুদ্ধ চলছে, হয়তো আরো কিছু দিন পর যুদ্ধ থামবে। যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক শক্তিতে অনেক এগিয়ে থাকা রাশিয়া হয়তো যুদ্ধ জিতে যাবে, বর্তমান ইউক্রেনিয়ান প্রেসিডেন্ট এবং অন্যান্যদের বিচার করবে, পুরা ইউক্রেন দখল না করতে পারলেও যেটুকু দখল করবে, সেটুকু রাশিয়ার অংশ করে ফেলবে ‘আমরা একই পরিবারের লোক’বলে।
কিন্তু ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার এই চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের বিরুদ্ধ সারা বিশ্বের মতো রাশিয়ার রাশানভাষীরাও ব্যাপক প্রতিবাদ করছেন রাস্তায় নেমে। পুরা দুনিয়ায় রাশিয়ার যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে।
ইউক্রেনিয়ানদের কাছে এরমধ্যেই এই সত্য পরিস্কার যে, তাদের সম্পদ কী। আয়তনে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশই না শুধু, তাদের দেশটা জনবহুলও। ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন স্বল্প সংখ্যক জনসংখ্যার কারণে ধুঁকছে, ইউক্রেনের সেই ঘাটতিও নেই, সাড়ে চার কোটি প্রায়, ইউরোপের অস্টম জনবহুল দেশ। আর নিজেদের প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদের দায়িত্ব নিজেরাই বুঝে নিতে পারলে এই ইউক্রেনিয়ানরাই হয়ে উঠবে অন্যতম প্রধান দেশ। ইউক্রেনিয়ানরা জানে তখন ন্যাটো তাদের কাছে দর কষাকষি করতে আসবে, রাশিয়া নেগোসিয়েশন এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করতে উন্মুখ থাকবে। ইউক্রেনের জনগণকে দাবায়া রাখতে পারবে না রাশিয়া।
জারি থাকুক ইউক্রেনের মর্যাদার লড়াই।
কাভার ফটো: বুলেটের শেল দিয়ে ‘ফেইস অব ওয়্যার’ নামে চিত্রকর্মটি করেছেন ইউক্রেনিয়ান আর্টিস্ট দারিয়া মারচেনকো। ২০১৫ সালে। তথ্য সূত্র: রয়টার্স
তথ্যসূত্র:
Sing, Namita. “Ukraine President says his country ‘has been left to fight alone’ as hundreds killed or injured”. The Independent. 25 February 2022, https://www.independent.co.uk/news/world/europe/ukraine-volodymyr-zelenskyy-putin-twitter-b2022984.html
Lister, Tim. “Satellite photos raise concerns of Russian military build-up near Ukraine”. CNN. 4 November 2021, https://edition.cnn.com/2021/11/04/europe/russia-ukraine-military-buildup-intl-cmd/index.html
Baczynska, Gabriela and Vasovic, Aleksandar. “Pushing locals aside, Russians Take top rebel posts in east Ukraine”. Reuters. 27 July, 2014. https://web.archive.org/web/20140728013327/https://www.reuters.com/article/2014/07/27/us-ukraine-crisis-rebels-insight-idUSKBN0FW07020140727
Fisher Max. “Everything you need to know about the 2014 Ukraine crisis”. Vox. 3 September,
https://www.vox.com/2014/9/3/18088560/ukraine-everything-you-need-to-know
Tabuchi, Hiroko. “Before Invasion, Ukraine’s Lithium Wealth was drawing Global attention”. The New York Times. 2 March 2022, https://www.nytimes.com/2022/03/02/climate/ukraine-lithium.html
Guest, Layla. “Putin signs ‘immediate recognition of Donbass regions”. RT. 21 February, https://www.rt.com/russia/550170-putin-donbass-ukraine-speech/
Nardelli, Alberto, Jacobs, Jennifer, and Wadhams, Nick. “U.S Warns Europe That Russia May be Planning Ukraine Invasion”. Bloomberg. 11 November, 2021, https://www.bloomberg.com/news/articles/2021-11-11/u-s-warns-europe-that-russian-troops-may-plan-ukraine-invasion
“Biden Warns Putin of ‘strong’ Western Economic Sanctions if Russia attacks Ukraine”. France 24. December 7, 2021, https://www.france24.com/en/europe/20211207-western-powers-say-determined-to-defend-ukraine-s-sovereignty
“Russia demands Ukraine, ex-Soviet nations be barred from NATO”. Al-jazeera. 17 December 2021, https://www.aljazeera.com/news/2021/12/17/russia-demands-ukraine-ex-soviet-nations-barred-from-nato
“Putin calls Kyiv leadership ‘gang of drug addicts’, urges Ukraine Army to overthrow leadership”. The Print. 25 February 2022, https://theprint.in/world/putin-calls-kyiv-leadership-gang-of-drug-addicts-urges-ukraine-army-to-overthrow-leadership/848384/
“The men who tried to topple Mikhail Gorbachev”. The Moscow Times. 17 August 2001. https://web.archive.org/web/20010905011525/http://www.themoscowtimes.com/stories/2001/08/17/019.html
“Ukraine Crisis: Biden Warns Russia may invade next month”. BBC. 28 January 2022, https://www.bbc.com/news/world-europe-60164537
“In full: Russian President addresses the nation”. Sky news. 21 February 2022, https://www.youtube.com/watch?v=W57I2mzAr9c&list=FLI41d5kYnAxemutnglhq_-g&index=18
“‘No other option’: Exxcerpts of Putin’s speech declaring war”. Al Jazeera. 24 February 2022, https://www.aljazeera.com/news/2022/2/24/putins-speech-declaring-war-on-ukraine-translated-excerpts
“Election of the President of Ukraine 2019”. Central Election Commission. https://www.cvk.gov.ua/pls/vp2019/wp300pt001f01=719.html
“Vladimir Putin describes secret meeting when Russia decided to seize Crimea”. The Guardian. 9 March 2015, https://www.theguardian.com/world/2015/mar/09/vladimir-putin-describes-secret-meeting-when-russia-decided-to-seize-crimea
“The attempted coup”. Britannica. https://www.britannica.com/place/Soviet-Union/The-attempted-coup
Amiel, Sandrine. “Russia’s military build-up near Ukraine is different this time, says experts”. Euro news. 6 December 2021, https://www.euronews.com/my-europe/2021/11/24/russia-s-military-build-up-near-ukraine-is-different-this-time-say-experts