শাহীন আখতার তার সবশেষ উপন্যাস এক শ এক রাতের গল্প বইবাজারে ছেড়ে বার্লিন-হাইডেলবার্গ-সারায়েভো ঘুরে আসেন আন্তালিয়ায়। সেপ্টেম্বর মাস। আমি উত্তরপূর্ব ইউরোপের, পোস্ট-সোভিয়েত এক শহর থেকে যাই শাহীন আখতারের সাথে আড্ডা দিতে। আমার সাথে আর দ্বিতীয় কোন উদ্দেশ্য ছিল না আন্তালিয়ায় যাওয়ার, শাহীনের ওরফে শাহীন আপার ছিল, তিনি এক শ এক রাতের গল্প লিখতে-লিখতে, ভেতরে-ভেতরে জমিয়ে তোলা ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী শহর-লোকালয় চাক্ষুষ করার মনোবাঞ্চাও সাথে নিয়ে আসছেন। আমাদের দেখা হয় এয়ারপোর্টে, আন্তালিয়া এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে আড্ডা শুরু, সেটা গড়ায় কাস, ওলুদিনিজ, পামুক্কালে হয়ে আবার আন্তালিয়ায়। কিন্তু এই আড্ডাটা আমরা সচেতন অ্যারেঞ্জমেইন্টের মধ্যে হারায়াও যাইতে পারে কেউ, এই অর্ডারে দেই, কাসে। কাস পাহাড় আর ভূমধ্যসাগর ঘেরা একটা শহর, আন্তালিয়া থেকে চার ঘন্টা বাস দূরত্বে। সেইখানে পাহাড়ের পেটের ভেতর থাকা একটা এয়ারবিয়েনবিতে আমরা দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আলাপ চালাই, সাক্ষাৎকার টাইপ প্রশ্ন এসে যায় মাঝে মধ্যে, তারপর আবার হা হা হি হি হয়। এটা একটা নিটোল আড্ডা + সচেতন সাক্ষাৎকারের একটা ফর্মাল-ইনফর্মাল -মিক্সড কথপোকথন। ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২। কাস, টার্কি বা টুর্কিয়ে বা তুরস্ক।
এটা প্রথম পর্ব। দুই পর্বে ভাগ করা পুরা আড্ডাটা। শাহীন আখতারের সাথে শামীমা বিনতে রহমানের একটা ফর্মাল-ইনফর্মাল মিক্সড কথপোকথন।
শা.বি.র.: প্রথমেই আপনাকে অভিনন্দন তালাশের জার্মান ভাষায় অনুবাদ হওয়ার খবরে। আপনি তো গত মাস, মানে অগাস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেশের বাইরে আছেন, প্রথমে জার্মানি গেলেন, এরপর বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে আর এখন টার্কিতে। আপনার সদ্য প্রকাশিত এক শ এক রাতের গল্পের সাথে তো ভূমধ্যসাগরের এই দিকটা, টার্কির দিকটার একটা সম্পর্ক আছে, তো . . .
শা.আ.: আমি অনেকদিন থেকেই চাচ্ছিলাম বের হই, তো কয়েকটা নির্দিষ্ট জায়গা তো মাথায় ছিলই। তুমি বল্লে না যে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলটা, সেইটা একটা আগ্রহের দিক — এক শ এক রাতের গল্প লিখতে লিখতে তৈরি হয়। এর আগেও একবার ভেবেছিলাম এই অঞ্চলে আসার কথা, টার্কির এই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলটায়, ভূমধ্যসাগরের এই দিকটায়, পূর্বাঞ্চলীয় ক্লাসিক গ্রিক সভ্যতার প্রেমে পড়ার জন্য হয়তো। কিন্তু করোনা এবং বিভিন্ন কারণে সম্ভব হয় নাই। তারপরও জায়গাগুলো টানছিলো। আমি বের হৈতে চাচ্ছিলাম প্রথমত: যে, আমার জায়গাটা থেকে একটু বেরিয়ে যাই, অনেক কিছু থেকেই বের হৈতে চাচ্ছিলাম আর কি। আর দ্বিতীয় আরেকটা ছিল — এক শ এক রাতের গল্প লিখতে লিখতে আমি যেসব অঞ্চলগুলিতে ছিলাম মনে মনে, হা হা হা . . . কল্পনায়, সেইগুলো খুব টানছিলো। বইটা লেখা শেষ হয়ে গেল আর আমার মনে হচ্ছিল আমি মিস করতেসি সেসব জায়গা আর মানুষগুলোরে। আমার কল্পনায় তো আছে অনেক আগের একটা জায়গা, যেরকম হয় দূরের একটা জিনিস খুব টানে, সেরকমই টানছিলো।
আর, জার্মান ভাষায় তালাশ‘ র অনুবাদ বিষয়টা। যিনি প্রকাশক তিনি জার্মান, মূলত: সাউথ এশিয়ার বই করেন। গীতাঞ্জলী শ্রীর প্রথম উপন্যাসটা করেছেন, আরো বেশ কিছু বইপত্র। পথের পাঁচালির জার্মান অনুবাদ হচ্ছে। উনাদের ব্যাপারটা এমন অনেকটা যে, সরাসরি দক্ষিণ এশিয়ান ভাষা থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করাটা তারা পছন্দ করেন। তো একজন জার্মান মেয়ে বাংলা থেকে তালাশ অনুবাদের কাজটা করবে। অনেকদিন আগে তালাশ অনুবাদ নিয়ে এ প্রকাশকের সাথে আলাপ হয়েছিল। যোগাযোগটা আরো আগের। ২০০৪-এ সম্ভবত উনি বাংলাদেশে এসে কয়েকজন লেখকের সঙ্গে মিট করেন। তখন আমার ‘মেকআপ বক্স’ গল্পটা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করিয়ে প্রকাশ করেছেন। তো আমার জার্মানি আসার আরো একটা বিষয় ছিল— হাইডেলবার্গে একটা রিডিং প্রোগ্রাম।
শা.বি.র: ওখানে আপনি কী পড়লেন?
শা.আ.: ওখানে আমাকে তালাশের বাংলা এবং ইংরেজি দুটোরই একটা করে অংশ পড়তে হয়েছে। শ্রোতাদের মধ্যে বাঙালি ছিল। প্রফেসর হান্স হার্ডার, যিনি হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়া ইন্সটিটিউটের পরিচালক, তিনি বাংলা খুব ভালো জানেন। মাইজভান্ডারির ওপর পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ছিল তার। যার জন্য বাংলায়ও যখন পড়ছিলাম, এক্সপ্রেশন যেটা শ্রোতাদের দিক থেকে ছিল, মানে বুঝতেসিল আর কি, কমিউনিকেট করতে পারতেছে।
শা.বি.র: আচ্ছা . . . মজার তো।
শা.আ.: হ্যা, এটাই মূলত ছিল রিডিং আর বাকি সব ছিল লেখালেখি নিয়ে প্রশ্ন।
শা.বি.র: একটু বলবেন কী ধরনের প্রশ্ন ছিল?
শা.আ.: একদম বেসিক প্রশ্ন যেমন কেন লিখি, কী লিখি, তালাশের এন্ডিংটা নিয়ে উচ্ছ্বাস ছিল।
শা.বি.র: ওখানে কি শুধু জার্মান অডিয়েন্স ছিল, নাকি জার্মান-বাংলা স্পিকিং মিলায়া ছিল?
শা.আ.: জার্মান অডিয়েন্সই ছিল বেশি। পোলান্ডের ছিল, বাংলা স্পিকিং স্টুডেন্ট দুইজন ছিল। বাঙালি কাপল ছিল দুইজন। পাকিস্তানি, ইন্ডিয়ানও ছিল।
আমার পাবলিশার যিনি, তিনিই মূলত মঞ্চে হোস্ট করতেসিলেন। পাকিস্তানি ছেলেটা বল্লো, যুদ্ধের পরও এরকম হয়! আমি বল্লাম যে, এইটা তো একা বাংলাদেশের বিষয় না। আমি অবশ্য এটা আলোচনার মধ্যেও বলছি। আমি বল্লাম, শুরুতে আমার মনে হৈত যে এইটা বুঝি আমাদের দেশেই ঘটছিল। কনজারভেটিভ মানসিকতা, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সাফার করতে হৈল ইত্যাদি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে রেইপ সার্ভাইভার, কমফোর্ট উইম্যান, ওদের পরিনতিও তো ভালো হয় নাই। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল পুরাটা জুড়ে।
শা.বি.র: কোনো প্রশ্ন কি ইন্টারেস্টিং মনে হৈসিল আপনার কাছে? ধরেন আপনি কী লিখসি, কীভাবে লেখা শুরু করলাম এইসবের বাইরে আরকি।
শা.আ.: একটা প্রশ্নে মনে হয়েছে যেটা আগে ভাবি নাই সেইভাবে।
শা.বি.র.: হুম-উমম। কি সেটা?
শা.আ.: সেটা হৈল, তালাশ তো রেইপ সার্ভাইভার নিয়ে, না? রেইপ সার্ভাইভার এবং বাংলাদেশের একাত্তরের যুদ্ধে তারা রেইপড হয়েছে। যেইটা কোরিয়ানদের কাছে, মানে বইটাতো কোরিয়ান ভাষায় অনুবাদ হৈসে, কোরিয়ানরা খুবই পছন্দ করেছে বইটা। ওদের একই এক্সপেরিয়েন্স আছে যুদ্ধের। ওদের একটা ইতিহাস আছে এইরকম। কিন্তু জার্মানি নিয়া আমি এমন কিছু ভাবি নাই। মানে সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে ওদের যে এরকম অভিজ্ঞতার মধ্যে যেতে হৈসিল, এইটা আমার মাথায়ই ছিল না, মানে ভাবিই নাই। কিন্তু আমাকে এই প্রশ্নটা করা হৈসিল যে, আমি কি জানি যে জার্মান মেয়েরাও সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে রেইপড হৈসিল? আমি বল্লাম যে, জেনারেলি তো একটা যুদ্ধ যেইখানে হয়, এইটা একদম ইনএভিয়েটাবল যে, নারীরা রেইপড হয়ই। এইটাও একটা হাতিয়ার যুদ্ধের। তোমার শত্রুর বিরুদ্ধে তুমি রেইপ করাটা ব্যবহার করছো। তখন অডিয়েন্সের একজন বলছিল সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় জার্মান মেয়েদের ভিক্টিম হওয়ার কথা, রাশিয়ান সোলজারদের কথাই বলছিল। জার্মানি টেইকওভার করার পর বার্লিনে, বার্লিনের কথাই বল্লো। আমরা তো সেটা জানতাম, গুন্টার গ্রাসের দ্য টিন ড্রাম উপন্যাসে রেইপের ব্যাপারটা আছে। ফিল্মটাও আমি দেখসি। তো ইনফরমেশনটা যে অজানা, সেইটা না। কিন্তু আমি হয়তো ওইভাবে ভাবি নাই, মানে এক্সপেক্ট করি নাই।
তারপর ওই ভদ্রলোক বল্লো, প্রথমে জাস্টিফাই করলো জার্মানীর যুদ্ধে নাজী বাহিনীতে অনেক নারী ছিল, তো সেইক্ষেত্রে ওদেরকে আমরা ভিক্টিম বলবো না। রিডিং সেশনে এইটুকই। কিন্তু হাইডেলবার্গ থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে পৌছে দেওয়ার সময়, আমারে একা পেয়ে উনি আবার মুখ খুল্লেন। বল্লেন, তার ফ্যামিলি, তার মা।মায়ের কথাটা তখন বল্লেন। আমি বল্লাম সব মেয়ে, নারী তো আর নাজীর সাপোর্টার ছিল না। বলেন, হ্যা। তারপর বল্লেন যে, তার মা ইননোসেন্ট ছিলেন, উনি সত্তর বছর বেঁচে ছিলেন এবং কখনো বলেন নাই। রিডিং সেশনে পাকিস্তানি একজন স্টুডেন্ট ছিলেন, লাহোর থেকে আসছেন। যেহেতু আমার বইয়ের মধ্যে পোস্টওয়ার একটা বিষয় আছে, স্বাধীন দেশে কী হয়েছিল মেয়েদের। তো তালাশ নিয়ে আলোচনা মানে এইটা চলেই আসে। আর বাংলা ও ইংরেজি তালাশ পড়া চার/পাঁচজন ওইখানে ছিলেন। জার্মান রেডিওতে কাজ করতেন এমন একজন রিটায়ার্ড বাংলাদেশি তো ইনভাইটেড না হয়েও চলে আসছিলেন কারণ তালাশের লেখক আসছে এই খবরে। আমার পাবলিশার যিনি, তিনিই মূলত মঞ্চে হোস্ট করতেসিলেন। পাকিস্তানি ছেলেটা বল্লো, যুদ্ধের পরও এরকম হয়! আমি বল্লাম যে, এইটা তো একা বাংলাদেশের বিষয় না। আমি অবশ্য এটা আলোচনার মধ্যেও বলছি। আমি বল্লাম, শুরুতে আমার মনে হৈত যে এইটা বুঝি আমাদের দেশেই ঘটছিল। কনজারভেটিভ মানসিকতা, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সাফার করতে হৈল ইত্যাদি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে রেইপ সার্ভাইভার, কমফোর্ট উইম্যান, ওদের পরিনতিও তো ভালো হয় নাই। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল পুরাটা জুড়ে। কমফোর্ট উইম্যানদের ক্ষেত্রে কোরিয়ার বিষয়টা বেশি আসছে সামনে, সেখানেও তো একই। তারপর দেখা গেল ওই জার্মান ভদ্রলোক, যিনি বলছিলেন উনার মায়ের ব্যাপারটা, তার মা সব সময়ই হাইড করে গেছিলেন, কখনোই কাউকে বলেন নাই। এমনকি বৃদ্ধ বয়সেও বলেন নাই, কেউ কেউ উনার কাছে জানতে চাইত যখন।
শা.বি.র: আসলেই. . .
শা.আ.: এইটা তো আধুনিক কালের যুদ্ধ, একদম মধ্যযুগ বলো, বা প্রাচীন যুগ বলো যুদ্ধ সবসময়ই নারীদের জন্য একই ছিল। যেমন বাবরনামা । জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবরের আত্মজীবনীতেও তাই দেখা যায়। বাবরের বোন খানজাদা বেগমকে উজবেক যে নেতা, যে তখন সমরখন্দ দখল করেছিল, উঠায়া নিয়ে গেছিল। বাবরের এই হারায়ে যাওয়া বোনকে রুশদী নিয়ে আসছেন তার দ্য অ্যানচানথ্রেস অব ফ্লোরেন্স (The Enchantress of Florence) উপন্যাসে। তারপর দেখ, গত নব্বইয়ের দশকের বসনিয়ার যুদ্ধ অভিজ্ঞতাটা। সেখানেও তো ভয়াবহ। সারায়েভোর ওয়ার চাইলডহুড মিউজিয়ামে একটা যুদ্ধশিশুর টেস্টেমনি, তার ফিলিংস, অভিজ্ঞতা শুনছিলাম। তার মায়ের পক্ষে সে, তার বাবার রিকগনিশনটা সে চায় না। আর মায়ের সাফারিংসের জন্য সমাজকে দুষে।
শা.বি.র: আপনার বসনিয়ায় যাওয়ার কারণ কি?
শা.আ.: আমার যাওয়ার আগ্রহ ছিল আর আমার একজন ফ্রেন্ড আছে ওইখানে। ও সুইডিশ, আমরা একসময় আর্লি নাইন্টিজে ঢাকায় একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম। যাওয়া তো কঠিন এ সমস্ত জায়গায়। ভিসা পাওয়া বা পরিচিত কেউ না থাকলে। একটা যুদ্ধ সেখানে লম্বা সময় চলছিল। নাইন্টিজের মাঝামাঝি পর্যন্ত ওইখানে যখন যুদ্ধটা চলছিল, তখন প্রায় সময় আমাদের নিউজপেপারের হেডলাইন হয়েছে। এটা বেশ আলোচনায় ছিল সেই সময়টায়। তো এ রকম একটা জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছাও ছিল আর কি। ওই যুদ্ধের ক্ষতটা ওখানে খুব চোখে পড়ে। তাছাড়া জায়গাটা খুব সুন্দর। নেচার, মানুষজন সব কিছু মিলায়ে আমার অনেক ভাল্লাগসে।
শা.বি.র: আমার একটা প্রশ্ন আসছে মাথায়। সেটা হৈল যে, ধরেন, যুদ্ধ ক্যানো আপনাকে এত বেশি নাড়া দেয় বা আপনার মধ্যে চলে আসে, সেটা কি আপনার শৈশবে যুদ্ধ দেখার কারণে, মানে আপনার শৈশবেই বাংলাদেশ মুক্তির যুদ্ধ করেছিল। তারপর আপনাদের আপব্রিঙ্গিংয়ে যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিটাও দেখতে থাকেন। এটার কি কোন ধরনের রোল আছে?
শা.আ.: এইটা খুবই ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন। আমি এইভাবে ভাবি নাই আগে। তোমার প্রশ্নটা শুনে এখন মনে হচ্ছে সম্ভবত আছে, যদিও আমি সবসময় জাস্টিফাই করে আসছি যে, তালাশ লেখার পেছনে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ওরাল হিস্ট্রি প্রজেক্ট। অবশ্য সেইটাতে কাজ না করলে আমি কখনোই জানতে পারতাম না… আমি অবাক হৈসিলাম, এক ধরনের ধাক্কা খেয়েই লেখার কথা ভাবলাম। অ্যাট দ্য সেইম টাইম আমার ছোট বেলার খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় কিন্তু এই যুদ্ধটা। যেই যুদ্ধটা এখনো দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে । এখনো মনে হয় একটা জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় পালাচ্ছি, গুলি হচ্ছে, এই রকম। এইটা মেমোরিতে অনেক বেশি ছাপ ফেলে গেছে। মনে হয় এইটা একটা হিডেন কারণ হিসাবে আমার ভেতরে রয়েই গেছে, আর তা হৈতেই পারে।
আরেকটা বিষয় হলো, তখন আমি কোরিয়ায় ছিলাম রাইটার্স রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে, তারপর ঘটনার থার্ড ডে তো বোধহয় দেশে ফিরছি। আমার মনে আছে হংকং এয়ারপোর্টে যেখানে ইংরেজি পত্রিকা রাখা হয়, সবগুলাতেই বড় বড় হেডলাইনে স্টোরিগুলি তখন দেখছিলাম। তারপর আসার পর আমি পত্রপত্রিকায় ঝাপায়া পড়লাম। তখন আমার স্টেইট অব মাইন্ড ছিল বুঝতেই চাইতেসি, এটুকুই। কারণ তখন আমি অসুখী দিন লিখতেছিলাম।
শা.বি.র: আপনি ঢাকা ছাড়ার আগে, মানে অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে আপনার এক শ এক রাতের গল্প প্রথমা থেকে প্রকাশ পায়। সব লেখকই তো ফেব্রুয়ারি টার্গেট করে বই প্রকাশ করেন। আপনি বছরের মাঝামাঝিতে . . .
শা.আ.: আমি কখনোই ব্যক্তিগতভাবে ফেব্রুয়ারি টার্গেট করে বইয়ের বিষয়টা ভাবি না। যেহেতু আমি প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির বইমেলায় বই প্রকাশ করি না, আমার দিক থেকে বলতে গেলে এটা প্রকাশকদের দিক থেকেই হয়ে আসছে এতদিন। কিন্তু করোনার কারণে বইমেলা একটা দুইটাতো বাদই গেছে। এ কারণে বইমেলার বাইরেও বই বের হচ্ছে এখন। তুমিও বইটার পান্ডুলিপি পড়েছ। এ বইয়ের ফার্স্ট ড্রাফটা লেখার পর একটু সংশয়ে ছিলাম। আমার মনে হয়েছে আমি যেভাবে লিখেছি আর যেভাবে বলতে চেয়েছি, এটাতে আসলে কোনো প্রবলেম হবে কি-না। সেজন্য একটু দূর থেকে দেখা দরকার। লেখালেখির সাথে সম্পর্কিত এ রকম চারজনই দেখেছে। তো এটাও ছিল একটা লম্বা প্রসেস। আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল— তোমাদের মতামত পাওয়া, সেভাবে আবার চিন্তা করা। আমার দিক থেকে বলি, দীর্ঘদিন ধরে একটা বিষয়ের মধ্যে থাকা মানে এটা আসলে নিজের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। পাঠকের দৃষ্টি দিয়ে দেখার ব্যাপারটা কিন্তু ইন দ্য মিন টাইম হারায়ে ফেলা হয়। মনে হয় এটা আমারই একটা পার্ট, একটা অংশ। তো সে ক্ষেত্রে আরেকজনের পান্ডুলিপি পড়াটা কিন্তু লেখককে বাস্তবে নিয়ে আসে। অবাস্তব জগৎ এ সেন্সে বলতে চাই… নিজের লেখার জগত থেকে লেখককে একটু বাইরে নিয়ে আসে, হেল্প করে দেখতে যে, সে কী লিখেছে। তো এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমি আগেও চেষ্টা করেছি কিন্তু এরকম পাওয়া খুব মুশকিল হয় যে, কেউ কষ্ট করে পান্ডুলিপি পড়বে। এবার আমি একটা উসিলা পেয়েছিলাম আর কি . . . আমি এপ্রোচটা এভাবে করেছি যে, দেখো তোমরা না দেখলে আমি বুঝতে পারতেসি না বইটা লিখে আমি কোনো বিপদে পড়বো কি-না . . . হা হা হা . . . এই অ্যাপ্রোচটায় ওরা খুবই সাড়া দিয়েছে, তুমিও দিয়েছ। সবাই ভাবছে শাহীন আপা বিপদে পড়তে পারে, তারচে বাঁচাই . . . হা হা হা . . .
শা.বি.র: হা হা হা . . .
শা.আ.: তো ৭/৮ মাস ধরে এই প্রসেসে ছিলাম। এটা একটা ভালো এক্সপেরিয়েন্স। আমি আবার পেছনে গেছি, সামনে আসছি। কখনো তর্ক করেছি, নিজের অবস্থাটাও জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছি। ভালো একটা ওলট-পালট গেছে এটা নিয়ে।
শা.বি.র.: আচ্ছা একটা রিলেভেন্ট প্রশ্ন মাথায় আসছে। ধরেন আপনি যখন লিখতেসেন এবং ক্যারেক্টার ডেভেলপ করতেসেন এবং ক্যারেক্টার রান করতেসে, অনেকগুলা পয়েন্ট অব ভিউস আপনার। কেউ যখন আপনাকে কাউন্টার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে ফিডব্যাক দিচ্ছে, তখন ব্যাপারটা আপনি কীভাবে দেখেন, মানে কী মনে হয় তখন?
শা.আ.: হ্যা, যেমন কারও কারও কাছ থেকে কিছু প্রশ্ন আসছে যে, উপন্যাসের মূল বিষয়টায় ওরা কেন, মানে হোলি আর্টিজানের হামলাকারীরা কেন, যারা নিহত হয়েছে ওরাও নয় কেন? ওদের রিপ্রেজেন্টেশন নাই কেন? তো এই প্রশ্নগুলা মনে হয় একটু ইরেলিভ্যান্ট ফিকশনের ক্ষেত্রে। এটা একটু বাইরের প্রশ্ন আমার মনে হয়। কারণ আমি তো একটা স্ট্রাকচার, একটা ছকের মধ্যে ব্যাপারটা ভেবেছি, তো আমার স্ট্রাকচারের মধ্যে প্রশ্ন আনলে ফিডব্যাক হিসাবে, সেটা অনেক বেশি কাজের হয়। তারপরও সেটার তো জবাব আছেই— আমি কেন করেছি। আমি আসলে এই এরিয়াটাই বুঝতে চেয়েছি। আর ধরো মৃত্যু যাদের হয়েছে, আমি অবশ্য বইটা উৎসর্গ করেছি তাদের। কিন্তু যাদের কষ্টটা কখনোই অ্যাকনলেজড হয় নাই, যে কষ্টটা ওদের লুকিয়ে ফেলতে হয়েছে, এই বিষয়টা শুরু থেকেই আমাকে নাড়া দিচ্ছিল। আমি ফ্যামিলিগুলির কথাই ভাবছিলাম যে কীভাবে ওরা পারছে এই শোকটা, এই কষ্টটা নিতে।
শা.বি.র.: আপনার বেশিরভাগ উপন্যাস যেমন অসুখী দিন, সখী রঙ্গমালা ঐতিহাসিক ঘটনা বা চরিত্রকে বেইজড করে লেখা, এই উপন্যাসটা ঠিক তা-না, বরং কনটেম্পরারি বিষয় নিয়ে, হোলি আর্টিজানের ঘটনাটা বছর ছয়েক পুরানা কিন্তু কনটেম্পরারি। তো, এই কনটেম্পরারি মেমোরি থেকে উপন্যাস লিখতে আপনি কীভাবে বা কেন উৎসাহিত হৈলেন?
শা.আ.: আগের উপন্যাসগুলির কথা বল্লে তো? আমি কোন সময়টা নিয়ে লিখবো, লেখার শুরুর ভাবনায় আসলে টাইমের ব্যাপারটা ওইভাবে মাথায় থাকে না।অসুখী দিনে মনে হয় খেয়াল করেছ যে, একটা বর্তমান পার্ট আছে।
শা.বি.র. : হ্যা, বর্তমান পার্ট আছে এবং আরেকটা আছে অতীতের। দুইটাই প্যারালালি আছে উপন্যাসে।
শা.আ.: আমার কখনোই মনে হয় না যে, আমি সবসময় ঐতিহাসিক উপন্যাসই লিখবো বা সবসময় কনটেম্পরারি বিষয় নিয়েই লিখবো। মানে টাইম ফ্রেমে বেঁধে লিখবো, এরকম ভাবি না। অসুখী দিনে পার্টিশনের বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম বলেই হয়তো বা নাইন্টিজ ফরটিজ নিয়েই ভাবছিলাম, সেটা ভাবতে গিয়েই দেখি মন্বন্তর, দেশভাগ, এবং সেসব ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখি, আমরা আসলে এড্রেসই করি নাই এই বিষয়গুলি অথচ এসব আমাদের ভূখন্ডেই ঘটেছিল। মনে হৈসিল যে, কী একটা জিনিষ মিসিং। যেন একাত্তর দিয়েই আমাদের ইতিহাস শুরু হয়েছে, বা বায়ান্ন দিয়ে শুরু, এর আগে মনে হয় কিছুই ছিল না। এটা আমার খুবই আগ্রহের একটা বিষয়। মানে একটা বোঝার ইচ্ছা। আর বিষয়টা নিয়ে লেখার কথা ভেবেছি আরো পরে।
শা.আ.: হ্যা, এবং যেই শোনে, সেই বলে ওরে বাবা তুমি এটা লিখতে যাচ্ছ? সেজন্য আমি লেখাটা বেনামে সেন্টারকে দেই। যার জন্য যে ট্রান্সলেট করেছিল, সেও ভয় পেয়ে ওর নাম উইথড্র করেছিল। হা হা হা . . . বুঝছো। পুরা পিসটাই একটা বেনামি পিস ছিল। কিন্তু ওই যে, একটা জানার প্রসেসে আমি ঢুকলাম, আমি বুঝতে পারছিলাম আমি ঢুকে গেছি হোলি আর্টিজান ঘটনার মধ্যে। আমি বুঝতেসিলাম যে, স্বনামে যেখানে সিম্পল জিনিষই ছাপাইতে পারি না, উপন্যাস লেখা তো, অনেকটা আগুনে ঝাপ দেয়ার মতো।
শা.বি.র.: হোলি আর্টিজানের ঘটনাটা ঠিক কোন জায়গায় আপনাকে স্ট্রাইক করসিলো যে আপনি বুঝতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন?
শা.আ.: প্রথমত: বলি ঢাকা শহরের মিডল ক্লাস যে নাড়া খেয়েছিল, সেইটা। এর আগ পর্যন্ত সবার ধারণা ছিল মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলেরাই এসব হামলা করে। নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির ওরাই করে, এরকম। সন্ত্রাসী, মানে কোট আনকোট যেভাবে শব্দটা ব্যবহার করা হয়— ওরাই করে এবং ধর্মীয়ভাবে এই কাজটায় উৎসাহিত হয়। মানে মাদ্রাসার স্টুডেন্ট যারা কোরান শরীফ না বুঝে মুখস্ত করে, ওরাই করে। এরকম একটা ধারণা। কিন্তু এই পুরা হোলি আর্টিজান ব্যাপারটা এই সোকল্ড ধারণাকে এমনভাবে নাড়া দিয়েছে যে, আমার মনে হৈসে, না, এবার নিজের দিকে তাকাও। এতদিন মনে হয়েছিল ব্যাপারটা দূরের, আমার বাচ্চা মাদ্রাসায় পড়ে নাই বা আমি তাদের পড়াই নাই, আমরা সেইফ, এই জিনিষটা। যেমন আমার ভাইয়ের ছোট ছেলেটার ক্লাসমেইট ছিল হোলি আর্টিজান ঘটনার ছোট ছেলেটা, নামটা যেন কি, হ্যা, মোবাশ্বের। আবার বোনের ছেলের সাথে ফুটবল খেলতো নিবরাস। এতো কাছের যে নিজের ফ্যামিলির মেম্বারদের মধ্যেই ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে। আরেকটা বিষয় হলো, তখন আমি কোরিয়ায় ছিলাম রাইটার্স রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে, তারপর ঘটনার থার্ড ডে তো বোধহয় দেশে ফিরছি। আমার মনে আছে হংকং এয়ারপোর্টে যেখানে ইংরেজি পত্রিকা রাখা হয়, সবগুলাতেই বড় বড় হেডলাইনে স্টোরিগুলি তখন দেখছিলাম। তারপর আসার পর আমি পত্রপত্রিকায় ঝাপায়া পড়লাম। তখন আমার স্টেইট অব মাইন্ড ছিল বুঝতেই চাইতেসি, এটুকুই। কারণ তখন আমি অসুখী দিন লিখতেছিলাম।
শা.বি.র.: হু-হুম-উমম
শা.আ.: তারপর সেই সময় আরো একটা ঘটনা ঘটেছে, যেই জন্য আমি বিষয়টার আরো ভিতরে গেছিলাম। কোলকাতার দ্য সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন স্যোশাল সাইন্সেস, ওইখান থেকে আমাকে একটা লেখা লিখতে বলেছিল এ বিষয়ে। আমি ওদের বল্লাম, আমি তো একাডেমিক না, ওরা বল্লো, না, তুমি তোমার স্টাইলেই লিখতে পারো। তারপরে আমি ভাবলাম যে লিখি, কিন্তু কেউ তখন আর এ নিয়ে লিখে টিখে না। ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন উনারাই করে নিবেন। কিন্তু আমি ভয় পাইলাম এই জন্য যে, বাংলাটা নিয়ে আমি যখন কালি ও কলমের হাসনাত (আবুল হাসনাত) ভাইয়ের সাথে কথা বল্লাম, উনি বল্লেন, শাহীন এ বিষয়টা এখন তুলে আনার দরকার নাই, ওইটা এখন না আনাই ভালো। সবার নিরাপত্তার জন্য।
শা.বি.র.: আচ্ছা, তারপর আপনি বুঝতে পারলেন হোলি আর্টিজান ব্যাপারটা ভীষণ সেনসেটিভ . . .
শা.আ.: হ্যা, এবং যেই শোনে, সেই বলে ওরে বাবা তুমি এটা লিখতে যাচ্ছ? সেজন্য আমি লেখাটা বেনামে সেন্টারকে দেই। যার জন্য যে ট্রান্সলেট করেছিল, সেও ভয় পেয়ে ওর নাম উইথড্র করেছিল। হা হা হা . . . বুঝছো। পুরা পিসটাই একটা বেনামি পিস ছিল। কিন্তু ওই যে, একটা জানার প্রসেসে আমি ঢুকলাম, আমি বুঝতে পারছিলাম আমি ঢুকে গেছি হোলি আর্টিজান ঘটনার মধ্যে। আমি বুঝতেসিলাম যে, স্বনামে যেখানে সিম্পল জিনিষই ছাপাইতে পারি না, উপন্যাস লেখা তো, অনেকটা আগুনে ঝাপ দেয়ার মতো।
শা.বি.র.: তাইতো . . .
শা.আ.: সেল্ফ সেন্সরশীপ এ উপন্যাসে বহুত দূর কাজ করেছে বলে আমি অনেক ঘুরপথে যাচ্ছিলাম। এখানে কোনো স্ট্রেইট ওয়েতে গল্প বলি নাই। অনেক প্যাঁচগোচ আছে। অনেক বাঁক আছে উপন্যাসের মধ্যে।
শা.বি.র.: কিন্তু সেল্ফ সেন্সরশীফ ব্যাপারটা এসে গেল কীভাবে?
শা.আ.: সেল্ফ সেন্সরশীপ ব্যাপারটা আসছিল, কারণ, তোমাকে তো বল্লাম যে, ওই রকম কিছু এক্সপেরিয়েন্সের কারণে একটা ভয়ের মধ্যে ঢুকে গেছিলাম। এই প্রতিক্রিয়াটা আমাকে একটা ভয়ের জায়গায় নিয়ে গেছিল এবং আমার মনে হয় এরপরই আমার মধ্যে উপন্যাস লেখার ভাবনাটা আসে।
শা.বি.র.: তার মানে যেই বিষয়টা নিয়ে সবাই মুখবন্ধ করে রাখতে চাচ্ছে, সেই বিষয়টাই আপনাকে উৎসাহিত করলো মুখ খোলার, এরকম?
শা.আ.: হ্যা, এরকমই মনে হয় অনেকটা। ওই ভয় থেকেই ভয় ভাঙ্গার চেষ্টা, মানে একটু গভীরে গিয়ে দেখা। আমার তখন একটা জিনিষ মাথায় কাজ করছিল— ইরানে ফিল্ম নিয়ে যে ঘটনাটা ঘটেছে, মানে ওইখানে এত এত সেন্সরশীপ, এর মধ্য দিয়েও ওরা ওদের মতো একটা ফরম্যাট দাঁড় করায়া ফেল্লো, প্রকাশের। ফিল্মের ক্ষেত্রে। আমার সবসময় মনে হয়, এরকম না কেন? আমরা কি সব বাদ দিয়ে চলে যাবো?
আর আমার মধ্যে একটা ভাবনা শুরু থেকেই ছিল— যারা খুনী হিসাবে অভিযুক্ত, এই ফ্যামিলিগুলির অবস্থা কী, আমি সবসময় আগ্রহী ছিলাম জানতে যে, ফ্যামিলির লোকেরা কী বলে, কী রকম আছে। আমার কয়্যারিটা ওইদিকেই বেশি যাচ্ছিল, ওরা কীভাবে বিষয়টা ডিল করতেসে। ওদের জীবনটা এখন কী রকম যাচ্ছে। আর একটা ব্যাপার ধরো, এখানেও বিশাল হিস্টোরিক্যাল ক্যানভাস আছে। এসব নাড়াচাড়া করতে গিয়ে, মানে এই প্রসেসের মধ্যেই অনেক কিছু পাচ্ছিলাম, যেইটা আমি আগে প্ল্যান করি নাই। তখন মনে হৈল এই ঘটনাকে আমি এরকম ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে না দেখে এর বিশাল ব্যাকগ্রাউন্ডের মধ্যে দেখি।
শা.বি.র.: একটা বিষয়, জাস্ট একটু বুঝতে চাইতেসি, সবাই যে মুখ বন্ধ করে রাখতে বলতেসে বা মুখ খুলতে চাচ্ছে না, সেটার কি একটা কারণ ক্লাস? যেমন ধরেন এরকম ধারণা আছে বা ছিল, ইন জেনারেল, মাদ্রাসায় যারা পড়ে তারা গরীব এবং ব্লেইম করাটাও খুবই একটা ইজি ব্যাপার, যে এরা মাদ্রাসায় পড়ে, এবং কিছু একটা হৈলেই, মানে কোট-আনকোট “ইসলামিস্ট টেররিজম” হৈলেই বলা হয় অশিক্ষিত, গোঁয়ার গরীব মাদ্রাসার স্টুডেন্টরা এইগুলা করছে। মানে ইজি টু পুট দ্যাম ইন অ্যা সোকল্ড টেররিস্ট বক্স। কিন্তু হোলি আর্টিজান ঘটনায় আপারক্লাস চলে আসছে। এটা কি একটা কারণ ভয়ের?
শা.আ.: না, এখানে ভয়টা ব্লগারদের এক্সপেরিয়েন্স থেকে। যারা ভয় পাইতেসিল, ধরো সম্পাদক হিসাবে যিনি ভয় পাচ্ছেন, বা কাছাকাছি প্রফেশনের যারা মত প্রকাশ করে, তাদের ভয় পাওয়ার কারণ ছিল ব্লগারদের খুন হওয়ার অভিজ্ঞতাটা। ভয়টা এমন যে, এরকম বিষয় নিয়ে লিখতে গেলেই, তুমি সেটা যেভাবেই লিখো না কেন, চাপাতির কোপ খাইতে হবে, মানে জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে।
শা.বি.র.: ওরা তো আপার ক্লাসই। যাই হৌক, মানে যেটা ব্লগাররা এক্সপেরিয়েন্স করছিল তখন, সেইটার টার্গেট যে কেউ হয়ে যেতে পারে, এরকম?
শা.আ.: ওই সময়, মানে ২০১৩ থেকে ২০১৬, বাংলাদেশে ওই সময়টায় পরপর এতোগুলি ব্লগার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে যে, সবাই ভয়ের মধ্যে ঢুকে গেছিলো। খুবই ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আমার মনে হয় পাকিস্তান বা অন্য কোথায়ও এমন হয় নাই যে, ব্লগ লিখতে গিয়ে এইভাবে এতজন মারা গেছে। আমার মনে হয় এই ভয়টাই, মানে আমি কনফার্ম, ওই জায়গা থেকেই ভয়টা কাজ করতো। কিন্তু ওই ভয় পাওয়া বা ভয় দেখানো, বলে না যে জুজুর ভয় দেখানো টাইপের. . . ওরা হয়তো আন্তরিকভাবেই বলেছে, কিন্তু আমার মনে হৈসে যে একটা বিষয়কে ভয় দেখিয়েই বা ভয় পাইয়েই কি থামিয়ে রাখা যায়? আমি আসলে তন্ময় হয়েছিলাম, কী লিখবো, কী লিখবো না, ছাপানো হবে কি হবে না, ছাপাতে না পারলেও আমি ওইদিকেই চলছিলাম। লেখার দিকে আরকি।
লিখতে লিখতে আমার মনে হচ্ছিল, আমি মেয়েটারে দেখতেসি আর গল্প অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। এটা অদ্ভুত একটা ব্যাপার কিন্তু। লিখতে লিখতে, যত বেশি ভেতরে ঢোকা হয়, তত মনে হয় হারায়ে যাইতেসি। তোমাকে টেনে নিয়ে যাইতেসে য্যানো আরেকজন কেউ। আমার কাছে মনে হৈসে যে, ওই-ই আসলে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, ও চালাচ্ছিল আর কি। আমি দেখলাম মেয়েটা চলে যাচ্ছে ওই দিকে, ভাইয়ের পথ ফলো করছে।
শা.বি.র.: এটা কি এরকম মনে হয়, মানে হোলি আর্টিজান একটা লিভিং মেমোরি, ভয়টাও দেখা যাচ্ছে – ইটস লাইক ইনফ্রন্ট অব ইয়্যু, একটা চ্যালেঞ্জ . . .
শা.আ.: হুম চ্যালেঞ্জ. . . আমার মনে হয় আমি ফর্মের দিক থেকে এ চ্যালেঞ্জটা নিয়েছি। আমি তোমাকে ইরানিয়ান ফিল্মের উদাহরণটা দিছি। এত রকমের বিধি এবং নিষেধের ঘেরাটোপ মানে খুবই লিমিটেড করে দেয়া, এসবের মধ্য দিয়ে ওরা ভিজ্যুয়াল আর্টের ক্ষেত্রে একটা আলাদা ফরমেট করে নিছে, যেমন বাচ্চাদের নিয়ে ছবি বানানো। মানে কোন কাজ তো বন্ধ থাকতে পারে না। সেই উপায়টা খুঁজে বের করা যে, কীভাবে কাজটা করবো, লিখবো। আর আমার মধ্যে একটা ভাবনা শুরু থেকেই ছিল— যারা খুনী হিসাবে অভিযুক্ত, এই ফ্যামিলিগুলির অবস্থা কী, আমি সবসময় আগ্রহী ছিলাম জানতে যে, ফ্যামিলির লোকেরা কী বলে, কী রকম আছে। আমার কয়্যারিটা ওইদিকেই বেশি যাচ্ছিল, ওরা কীভাবে বিষয়টা ডিল করতেসে। ওদের জীবনটা এখন কী রকম যাচ্ছে। আর একটা ব্যাপার ধরো, এখানেও বিশাল হিস্টোরিক্যাল ক্যানভাস আছে। এসব নাড়াচাড়া করতে গিয়ে, মানে এই প্রসেসের মধ্যেই অনেক কিছু পাচ্ছিলাম, যেইটা আমি আগে প্ল্যান করি নাই। তখন মনে হৈল এই ঘটনাকে আমি এরকম ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে না দেখে এর বিশাল ব্যাকগ্রাউন্ডের মধ্যে দেখি। এইটা একটা নির্দিষ্ট ভূখন্ডের না। এইটার পিছনে যেমন ঐতিহাসিক ঘটনা আছে, রাজনীতি আছে, মানে এইগুলোও আমি বোঝার চেষ্টা করেছি উপন্যাসে।
শা.বি.র.: আরব্য রজনীর গল্প যেইটা এক হাজার এক রাতের গল্প হিসাবেও পরিচিত, যেইখানে নারী চরিত্র শেহেরজাদ তার নারী বিদ্বেষী স্বামী শাহরিয়ারকে গল্প শুনাতে থাকে এবং এর মধ্য দিয়া শেহেরজাদের অবধারিত মৃত্যু একরাত একরাত কৈরা পিছাইতে পিছাইতে দীর্ঘ হৈতে থাকে। আপনার উপন্যাসে শেহেরজাদের মতো চরিত্র গল্প বয়ানকারি শফি মোহাম্মদ, তো এই ক্যারেক্টারটা কীভাবে . . .
শা.আ.: আমি কীভাবে অতীতের সময়টা আনবো, সেইটা নিয়ে অনেক চিন্তায় ছিলাম। আসলে আমি জানি যে আমি ওই টাইমটা নিয়ে আসতে চাই কিন্তু কীভাবে আনব, হ্যা। আমি বিভিন্নভাবে ভেবেছি, লাইক কনটেম্পরারি ক্যারেক্টার, অতীতেরও একটা ক্যারেক্টার থাকবে যার মাধ্যমে কাহিনীগুলি আসবে। অনেক ভাংচুর করতে হয়েছে। ওই অংশটা নিয়ে আমার আসলে বড় একটা সময় গেছে। এইটা চ্যালেঞ্জিং পার্ট ছিল উপন্যাসের। একভাবে আগে ভেবেছি, পরে আবার অন্য ভাবনা আসছে। শফি মোহাম্মদের যে প্রথম চ্যাপ্টারটা, তার ফার্স্ট ইনট্রোডাকশন, এখন যেটা বইতে আছে, এটা কিন্তু ছিল না। এইটা আরো পরে আসছে। যার জন্য বিভিন্নভাবে এই ক্যারেক্টার ক্রিয়েট করা এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে সেই ক্যারেক্টারকে সেট করা, এসব নিয়ে অনেক কাজ করতে হৈসে, ভাবতে হৈসে, বদলাতে হয়েছে অনেকখানি। তারপরে এখন এই চেহারাটা দেখা যাচ্ছে।
শা.বি.র.: তার মানে আইডিয়া আসার পর আপনার ফর্ম নিয়ে নাড়া চাড়া করতে হৈসে।
শা.আ.: হ্যা, বিশেষ করে ওই পার্টটা, শফি মোহাম্মদ এবং তার গল্প বলার পার্টটা। এম্নিতে আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম জঙ্গীনেতার বোন সাফা মরিয়ম জামালের চরিত্রটা। মা ভাবি নাই, কারণ মা হ্যান্ডেল করতে পারবো না আমি। আমার মনে হয়েছে যে আমার নিজেরও কষ্টের অভিজ্ঞতা আছে– আমার ভাইয়ের মৃত্যু। তো আমি যার জন্য বোন ক্যারেক্টারকেই ভেবেছি, যে হোলি আর্টিজানের অপারেশনকারী জঙ্গীদের ফ্যামিলিগুলোকে রিপ্রেজেন্ট করবে। মা দুইবার/তিনবার আসছে ছোট ছোট জায়গায়। আরেকটা বোন ক্যারেক্টার আছে আমীরন, আরেকজন জঙ্গীর বোন, সেইটা কিন্তু আমার শুরুর পরিকল্পনায় ছিল না। লিখতে লিখতে আমার মনে হচ্ছিল, আমি মেয়েটারে দেখতেসি আর গল্প অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। এটা অদ্ভুত একটা ব্যাপার কিন্তু। লিখতে লিখতে, যত বেশি ভেতরে ঢোকা হয়, তত মনে হয় হারায়ে যাইতেসি। তোমাকে টেনে নিয়ে যাইতেসে য্যানো আরেকজন কেউ। আমার কাছে মনে হৈসে যে, ওই-ই আসলে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, ও চালাচ্ছিল আর কি। আমি দেখলাম মেয়েটা চলে যাচ্ছে ওই দিকে, ভাইয়ের পথ ফলো করছে। আরেকটা জায়গায়ও এমন হৈসে, আবু ইসহাকের একটা চ্যাপ্টার। মানে দুইটা চ্যাপ্টার আছে ওর। প্রথম চ্যাপ্টারের মধ্যে একটা ইন্টারোগেশন পার্ট আছে। পুলিশ ইন্টারোগেশন চলতেছে। ওই চ্যাপ্টারটা আসলে শাঁখের করাতের মতো। দুই দিক কাটতেসিল। যেমন, ধরো সরকারি যে বিশেষ বাহিনী থাকে, বিভিন্ন রাষ্ট্রেই আছে সন্ত্রাসিদের দমন করার জন্য, এইটা; অ্যাট দ্যা সেইম টাইম, আবু ইসহাক দুই দিকেই মাইর খাইতেছে তখন, মানে আইএসের কাছ থেকেও, যেটা ফ্লাশব্যাকে আসতেছে। এই যে বিষয়টা, এইটা হয়তো টেকনিক, যা একই সঙ্গে দুই পক্ষকেই অভিযুক্ত করতেছে, দোষী সাব্যস্ত করতেছে। ওই চ্যাপ্টারটা লিখতে বসে টেকনিকটা অ্যাপ্লাই করেছি, তা কিন্তু না। আগে থেকেই আমার মধ্যে এই জিনিষগুলো নিয়ে একটা সতর্কতা জারি ছিল মনে হয়। আমি আমার বক্তব্য বলবো কিন্তু আমাকে কতগুলি টুলস ব্যবহার করতে হবে। এবং আমি যে পদে পদে কনশাস হয়ে এই চ্যাপ্টারটা এইভাবে লিখছি, সেইটাও না। আমার মনে হয় ওইভাবে ছকটা আসছে আমার কাছে। আমার মধ্যে একটা এলার্টনেস ছিল আর কি। আমার এই ব্যাখ্যাটাও ধরো, এখন তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে ভাবতে ভাবতে মাথায় আসতেসে।
শা.বি.র.: আমি আসলেই ওইটাই জানতে চাচ্ছিলাম যে, ধরেন সহজাতভাবে, ফ্লুয়েন্টলি যে জিনিষটা আসতেছে, তারপরে একটা সময় মনে হৈল যে কী ব্যাপার আমি তো এই জিনিষটা অন্যভাবে ভাবসিলাম, আর এখন এইটা এইভাবে চলে আসতেছে, ওইরকম মুহূর্তে গিয়া তখন আপনি কী করেন? কারণ আপনার ভাবনার মধ্যে তো একটা ধরণ আছে, কিন্তু প্লটটা আবার আপনাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরেক জায়গায় . . .
শা.আ.: হ্যা, কিছু জায়গায় যখন প্লটটা টেনে নিয়ে যায়, তখন বেশ ভালোলাগার একটা ফিলিংস হয়। আমি তখন এমন একটা পর্যায়ে, মনে হয় অন্য একটা পাওয়ার নিজের মধ্যে ফিল করতেছি।
শা.বি.র.: উমম . . .
শা.আ.: আমার তৈরি জিনিষই আমাকে লিড করতেসে, হ্যা, এইরকম। কিন্তু এই, এই জিনিষটা কম আসে।
শা.বি.র.: স্বাধীন মনে হয় তখন, নাকি পরাধীন লাগে?
শা.আ.: এক ধরনের আনন্দ, তূরীয়ানন্দ! সৃষ্টিশীল মানুষের যেরকম একটা আনন্দ হয়, ওই মুহূর্তটা সেরকমটা দেয়।
শা.বি.র.: নিজের ডোমেইন মনে হয়?
শা.আ.: হ্যা, নিজের বানানো দুনিয়া মনে হয়, মানে আমার বানানো, মানে এটা তো বাইরের কিছু না, কেউ না। মানে আমিই কিন্তু ওকে নিয়ে আসছি, আমিই ওকে তৈরি করেছি, ও এখন আমাকে পথ দেখাচ্ছে … হা হা হা . . .
শা.বি.র.: হা হা হা . . .
শা.আ.: অন্যরকম একটা পাওয়ার। মনে হয় যে, এটা আরো বেশি হৈলে ভালো হয়, যেন লেখার একটা জায়গায় গিয়ে নিজেকে ছেড়ে দিতে পারি, আমাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু এটা আসলে খুব কম ক্ষেত্রেই ঘটে।
শা.বি.র.: জোস! আচ্ছা, আপনি তো উমবার্তো একো কোট করছেন আপনার উপন্যাসে, দ্য নেইম অব দ্য রোজ থেকে, তো উনি উনার কনফেশন অব দ্য ইয়াং নভেলিস্ট এস্যেতে লিখলেন কীভাবে দ্য নেইম অব দ্য রোজ উপন্যাসটা শুরু করলেন। তো ওই এ্যসেতে একো বলতেসেন কি যে উনি একবার তার মধ্যযুগ সংক্রান্ত গবেষণার কাগজপত্র, উনি তো একাডেমিক ছিলেন বাই প্রফেশন, তো মধ্যযুগ সংক্রান্ত গবেষণার কাগজপত্র উল্টাইতে উল্টাইতে উনার মধ্যে একটা ইমেজ আসে এবং তিনি দেখেন বই পড়তে পড়তে বিষে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে এক মধ্যযুগীয় ক্যথলিক খ্রীস্টান সন্নাসি, মানে খুন হয় বিষাক্রান্ত হয়ে, মনাস্ট্রির ভিতর। এই ইমেজটা তার মধ্যে আসে এবং খুবই স্ট্রাইক করে, আর তাকে লেখায় বসায় দেয়। লেখকের ঘোরে থাকাথাকির মধ্যে এইরকম ইমেজ বা ভাবনা যেইটা লেখককে লেখায় বসায় দেয়, সেইটারেই উনি সেমিনাল ইমেজ বলতেসেন, তো আপনার লেখালেখির মধ্যে কি এরকম ব্যাপার ঘটে?
শা.আ.: হ্যা, বইটা দারুণ! সখী রঙ্গমালার ক্ষেত্রে আমার মধ্যে একটা মেয়ের ইমেজ আসছে, আমি যখন লেখা শুরুর আগে ওই এলাকায় গেছি, ওইখানে রাজবাড়িতে। নামেই রাজবাড়ি, আসলে মাটির ঢিবি, দীঘি আছে একটা। দীঘির পাড় দিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ ওর চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভাইসা ওঠে। একটু বৃষ্টি পড়ছে আগে, একটু ভিজা ছিল রাস্তাটা। দুই দিকে এরকম জঙ্গলের মতো। মাঝখান দিয়ে হেঁটে আসতেছি, তখনই এমনভাবে আসলো আমার ভেতরে, ক্যামন যেন একটা দুঃখী চেহারা আমার সামনে আসলো আর আমি তখন থেকেই কিন্তু ওই চেহারার মেয়েকে ভাবতে থাকলাম। পুরা জার্নির মধ্যে, মানে পুরাটা সময় ওর একটা চেহারা আমার মনের মধ্যে থেকেই গেল। ক্যানো মনের মধ্যে ওইরকম একটা চেহারা আসছিল, জানি না। আসলে ওইখানে গিয়ে তো খুঁজে পাওয়ার কিছু নাই। তারপরও আমি দুইবার গেছি। জায়গাগুলো আমার স্বপ্নের মধ্যেও আসতো, মনে হৈত যাই, দীঘির পাড়টা দিয়ে একটু হেঁটে আসি।
আর, হ্যা, জর্জিয়ান ফিল্ম মেকারের ফিল্ম পুরা ফ্যান্টাসি, বুঝছ, মনে হয় কি . . .
শা.বি.র.: এইটা হচ্ছে কোথায়?
শা.আ.: জায়গাটা তো নোয়াখালিতে। বেগমগঞ্জের পাশেই জায়গাটা। মাইজদী থেকে সিএনজি নিয়ে যাওয়া যায়, সারাদিনের জন্য ভাড়া করে। আমি গেছিলাম। বাসবী গেছিল একবার আমার সাথে।
শা.বি.র. : বাসবী বড়ুয়া আপনার ঘোরাঘুরির মেইট ছিল . . .
শা.আ.: হ্যা, ও আমার ক্লোজ ছিল। সবসময় আমার সাথে বাইরে যেতে আগ্রহী ছিল। আমার খুব ভালো কম্পেনিয়ন ছিল। ও তো এম্নিতে বয়সে অনেক ছোট। ও জাস্ট ফর্টি ক্রস করসিল. . .
পরের বার গেছিলাম লক্ষীপুর টাউনে। উপন্যাসে ফুলেশ্বরী রাই একটা ক্যারেক্টার দেখছ তো! ওর সম্পর্কে পালাগানে এক লাইনই আছে। একটা বউয়ের বর্ণনা, যে পাখি পুষতো। আর ওকে উল্লেখ করা আছে অভাগী হিসাবে। বাংলা সাহিত্যে নারী অ্যান্থলজি এডিট করতেসিলাম যখন, “চৌধুরীর লড়াই” নামে পূর্ববঙ্গ গীতিকায় একটা পালাগান পাই, পড়তে গিয়েই আমি পড়া বন্ধ করে দিছিলাম পালাগানটা। মানে ব্যাপারটা এমন ছিল, অ্যান্থলজির কাজটা শেষ হোক, তারপর ধরবো। তখনই ওইটা আমাকে ক্লিক করে গেছিল, রঙ্গমালা। এই মেয়েটাই বোধ হয় আসবে, হ্যা, পরের লেখায়, মানে রঙ্গমালা, এই রঙ্গমালাই আসবে, পরের উপন্যাসে। জার্নিটা পরে কতটা কঠিন হবে, সেটাও কিন্তু মাথায় ছিল না। যেমন হয় আর কি, একটা বিষয় নিয়েই উলট পালট হৈতে থাকা, নিজেই একটা জার্নির মধ্য দিয়ে যাওয়া। এটার মধ্যেই ঢুকে থাকা, অর্ধেক বাস্তব জীবনে থাকা, অর্ধেক না থাকা, এটাই বোধহয় গত দেড় দুই দশকের আমার অবস্থা। আমার জীবন যাপনটাই এরকম হচ্ছে।
কিছু বিষয় নিয়ে ভয় তো থাকেই, কখনো কখনো ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক বাতিল করে দিবো কি-দেবো না, এরকম সময়ও সামনে চলে আসে। কিন্তু সেটা না করে কেন আমরা বিভিন্ন উপায় খুঁজে বাইর করি না? যেমন তুমি অনেক রকমের ফর্ম সার্চ করতে পারো। হ্যা, তুমি ওই খেলায় নেমে যাও না ক্যানো, এই খেলা দিয়েই তুমি ডিফিট দিতে চাও না ক্যানো. .. তুমি খেলোয়াড় হয়ে ক্যানো খেলতে চাইতেস না- এরকম একটা চ্যালেঞ্জ নেয়া আর কি ক্রিয়েটিভিটি প্রাক্টিসে।
শা.বি.র.: বঙ্কিমের ভ্রমর মনে হৈসে আমার ফুলেশ্বরীকে আপনার উপন্যাসে। ওই যে কৃষ্ণকান্তের উইল‘র ভ্রমর। আবার ধরেন রোহিনীকে কেউ দেখতে পারে না, যেরকম রঙ্গমালাকে দেখতে পারে না, মানে সোসাইটির নর্মস ভাঙ্গা তরুণ নারী। ক্যারেক্টারের ফিচার হিসাবে এদের সাথে মিল আছে। কিন্তু গল্পের বাঁক ভিন্ন। হয়তো সময় একটা ফ্যাক্টর এইখানে। আপনি তো প্রচুর ফিল্ম দেখেন, ফিল্মের বানাবানির মধ্যেও ছিলেন। এই এক্সপেরিয়েন্স কি মনে হয় আপনার নেরেটিভে ভূমিকা রাখে?
শা.আ.: আমার তো মনে হয় রাখে, আমার মনে হয় আমি ফিল্মের কাছে ফিরেও যাই। হ্যা, যেমন সখী রঙ্গমালার সময়ও ফিরে গেছি, বিশেষ করে জাপানি ফিল্মমেকার মিজোগুচি (Kenji Mizoguchi) আরেকজন হলেন জর্জিয়ান ফিল্মমেকার পারাজানব (Sergei Parajanov)। পুরানো সময় নিয়ে লিখতে গেলে, তুমি তো আসলে সময়টা হাতড়াইতে থাকবা, মনে হবে কী ছিল সেই সময়, ক্যামন ছিলো, কীভাবে ঘটনাটা ঘটতে পারে, হ্যা, টেকনিকগুলো বা আমি কীভাবে এটা নিয়ে আসবো লেখাতে, এসব তো হয়। তখন মনে হয় এই ফিল্মমেকাররা কীভাবে একটা ঘটনা, রূপকথা বা পুরানো কাহিনী ডিল করেছেন, সেটা অনেকটা শিক্ষানবীশের চোখ দিয়ে দেখা। যেমন তুমি একটু আগে বল্লা না, বঙ্কিম চন্দ্রের উপন্যাসের কথা! আমি তখন বঙ্কিমচন্দ্রের ঐতিহাসিক উপন্যাসও নতুন করে পড়া শুরু করসিলাম। মানে ওই সময়টার আরেকটু চেহারা দেখা যায় কি-না, কীরকম ছিল সময়টা। কৃষ্ণকান্তের উইল কিন্তু তখন পড়ি নাই… হা হা হা…
আর, হ্যা, জর্জিয়ান ফিল্ম মেকারের ফিল্ম পুরা ফ্যান্টাসি, বুঝছ, মনে হয় কি . . .
শা.বি.র.: হ্যা, এইটা খুব ইন্টারেস্টিং, আপনি জর্জিয়ান মুভি দ্যাখেন!
শা.আ.: আমার সুবিধা হৈসে অঞ্জন এতো বেশি ফিল্মের মধ্যে থাকে তো, যার জন্য ঘরেই এসব ছবি এভেইলাবল থাকে, অতো ছোটাছুটি করার দরকার পড়ে না। পারাজানব তো সোভিয়েত আমলের, তারাকোভস্কির জুনিয়র সম্ভবত। উনি জেল খেটেছেন, আমার মনে হয় উনি রূপকথার ফর্ম বেছে নিছিলেন উনার প্রকাশের সুবিধার্থে তখনকার সোভিয়েত সময়ে।
শা.বি.র.: যেইটা আপনার মনে হৈসে ইরানিয়ান ফিল্মের ক্ষেত্রেও যে ওরা সাপ্রেশনের মধ্যেও প্রকাশের ফরমেট খুঁজে বাইর করছে।
শা.আ.: হ্যা, তাদের ফিল্ম দেখতে দেখতে আমার এরকম মনে হৈসে। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফর্ম নিয়ে কাজ করলে কনটেন্ট এক্সপ্রেস করা যায়।
শা.বি.র.: মানে আপনার কথা হচ্ছে, সাপ্রেশনের মধ্যেও প্রকাশের রাস্তা বের করা
শা.আ.: হ্যা, বের করা দরকার। কিছু বিষয় নিয়ে ভয় তো থাকেই, কখনো কখনো ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক বাতিল করে দিবো কি-দেবো না, এরকম সময়ও সামনে চলে আসে। কিন্তু সেটা না করে কেন আমরা বিভিন্ন উপায় খুঁজে বাইর করি না? যেমন তুমি অনেক রকমের ফর্ম সার্চ করতে পারো। হ্যা, তুমি ওই খেলায় নেমে যাও না ক্যানো, এই খেলা দিয়েই তুমি ডিফিট দিতে চাও না ক্যানো. .. তুমি খেলোয়াড় হয়ে ক্যানো খেলতে চাইতেস না- এরকম একটা চ্যালেঞ্জ নেয়া আর কি ক্রিয়েটিভিটি প্রাক্টিসে।
শা.বি.র.: হুম . . . মম, হা হা হা . . . তাইতো . . .
শা.আ. : আর তুমি যেহেতু ক্রিয়েটিভ কাজ করতে নামছ, তুমি খেলোয়াড়ের রোল নিতে পারো। সব সময় তোমার ডাইরেক্ট কনফ্রন্টেশনে যাওয়ার দরকার কী?
শা.বি.র.: নাইস . . . হা হা হা . . .
শাহীন আকতারের সাথে আড্ডার দ্বিতীয় পর্ব
শাহীন আখতার: আর্টিস্ট কীভাবে একটা ফ্রেমের মধ্যে থাকে !! . . . আমি ফেমিনিস্ট আবার ফেমিনিস্ট না
শাহীন আখতারের বইসমূহ:
উপন্যাস:
এক শ এক রাতের গল্প (২০২২), অসুখী দিন (২০১৮), ময়ূর সিংহাসন (২০১৪), সখী রঙ্গমালা (২০১০), পালাবার পথ নেই (২০০০ সালে ঢাকায় প্রকাশ, ২০০২ সালে কোলকাতা)। এরমধ্যে আর্ন্তজাতিক খ্যাতি পাওয়া উপন্যাস, তালাশ।
তালাশ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৪। ওই বছরই বইটি প্রথম আলোর বর্ষ সেরা পুরস্কার পায়। এটি এখন জার্মান ভাষায় অনুবাদের প্রক্রিয়াধীন। ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে ২০১১ সালে। The Search নামে। অনুবাদ করেন এলা দত্ত (Ella Dutta), জুবান (Zubaan) নিউদিল্লি থেকে প্রকাশিত। কোরিয়ান ভাষায় অনুবাদ হয় ২০১৮ সালে। অনুবাদক সিং হি জন (Seung Hee Jeon)। কোরিয়ান ভাষায় অনুদিত তালাশের জন্য তিনি ২০২০ সালে এশিয়ান লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড পান।
সখী রঙ্গমালার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে সদ্য, সেপ্টেম্বর মাসে। ইংরেজি অনুবাদে নাম Beloved Rongomala. অনুবাদ করেন শবনম নাদিয়া (Shabnam Nadiya), ওয়েস্টল্যান্ড বুকস (Westland Books)।
ছোটগল্প:
শ্রীমতির জীবনদর্শন (১৯৯৭), বোনের সঙ্গে অমরলোকে (২০০১), ১৫টি গল্প (২০০৪), আবারও প্রেম আসছে (২০০৬), শিস ও অন্যান্য গল্প (২০১৩), ভালোবাসার পরিধি (২০২০)
সম্পাদিত বই:
জানানা মহফিল/ বাঙ্গালি মুসলমান লেখিকাদের নির্বাচিত রচনা (১৯০৪-১৯৩৮), যৌথ সম্পাদনা, মৌসুমী ভৌমিক, আরেকজন সম্পাদক। ১৯৯৮ সাল। ইংরেজি অনুবাদ হয় বইটির ২০০৮ সালে। অনূদিত নাম: Women in Concert – An Anthology of Bengali Women’s Writings ( 1904-1938).
সতী ও স্বতন্তরা/ বাংলা সাহিত্যে নারী (তিন খন্ড)। ২০০৭।
কাভার ফটো: শামীমা বিনতে রহমান