fbpx
with Shaheen Akhtar, award winning writer, Bangladesh. At Kas, Turkey
শাহীন আখতারের সাথে আড্ডা, কাস, তুরস্ক

শাহীন আখতার: আর্টিস্ট কীভাবে একটা ফ্রেমের মধ‍্যে থাকে !! . . . আমি ফেমিনিস্ট আবার ফেমিনিস্ট না

শাহীন আখতার তার সবশেষ উপন‍্যাস এক শ এক রাতের গল্প বইবাজারে ছেড়ে বার্লিন-হাইডেলবার্গ-সারায়াভো ঘুরে আসেন আন্তালিয়ায়। সেপ্টেম্বর মাস। আমি উত্তরপূর্ব ইউরোপের, পোস্ট-সোভিয়েত এক শহর থেকে যাই শাহীন আখতারের সাথে আড্ডা দিতে। আমার সাথে আর দ্বিতীয় কোন উদ্দেশ‍্য ছিল না আন্তালিয়ায় যাওয়ার, শাহীনের ওরফে শাহীন আপার ছিল, তিনি এক শ এক রাতের গল্প লিখতে-লিখতে, ভেতরে-ভেতরে জমিয়ে তোলা ভূমধ‍্যসাগর তীরবর্তী শহর লোকালয় চাক্ষুষ করার মনোবাঞ্চাও সাথে নিয়ে আসছেন। আমাদের দেখা হয় এয়ারপোর্টে, আন্তালিয়া এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে আড্ডা শুরু, সেটা গড়ায় কাস, ওলুদিনিজ, পামুক্কালে হয়ে আবার আন্তালিয়ায়। কিন্তু এই আড্ডাটা আমরা সচেতন অ‍্যারেঞ্জমেইন্টের মধ‍্যে হারায়াও যাইতে পারে কেউ, এই অর্ডারে দেই, কাসে। কাস পাহাড় আর ভূমধ‍্যসাগর ঘেরা একটা শহর, আন্তালিয়া থেকে চার ঘন্টা বাস দূরত্বে। সেইখানে পাহাড়ের পেটের ভেতর থাকা একটা এয়ারবিয়েনবিতে আমরা দুপুর থেকে সন্ধ‍্যা পর্যন্ত আলাপ চালাই, সাক্ষাৎকার টাইপ প্রশ্ন এসে যায় মাঝে মধ‍্যে, তারপর আবার হা হা হি হি হয়। এটা একটা নিটোল আড্ডা + সচেতন সাক্ষাৎকারের একটা ফর্মাল-ইনফর্মাল -মিক্সড কথপোকথন। ৬ সেপ্টম্বর, ২০২২। কাস, টার্কি বা টুর্কিয়ে বা তুরস্ক। 

এটা দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব। দুই পর্বে ভাগ করা পুরা মিক্সড কথোপকথনটি। শাহীন আখতারের সাথে শামীমা বিনতে রহমানের একটা ফর্মাল-ইনফর্মাল মিক্সড কথপোকথন।

 

 শা.বি.র.: তো আপনি আপনার এই যে লেখক সেল্ফ এইটাকে বুঝের মধ‍্যে আনলেন ক‍্যামন করে? কোন ইমাজিনারি অর্ডার কাজ করছে এইখানে?

শা.আ.: পেছনে ফিরে তাকালে যে জিনিষটা মনে হয়, আমি সত‍্যি হয়তো চাচ্ছিলাম নিজের একটা পরিচয়, নিজে একটা জিনিষ নিয়ে থাকবো। কারণ আমি তো খুব এলোমেলো—  ইকনমিক্সে পড়াশুনা করেছি, ডক‍্যুমেন্টারি বানানো, ইন্ডিয়াতে বছর দুই থেকে ফিরে আসলাম, ফিল্মের লাইনে গেলাম, আবার ফিরে আসলাম, কয়দিন এদিকে সেদিকে পত্রিকায় লেখালেখির কাজ করলাম। কিন্তু সবসময় আবার টান ফিল করতাম লেখার, ছোট বেলায় যেহেতু গল্প লিখেছি, বা সাহিত্যচর্চার আবহে ছিলাম, মনে হৈত এইটাই আমার জায়গা, এটাইতে আমি ঢোকার পথ খুঁজতাম, এইটাই বোধহয় আমার জায়গা, এটাই আমি চাই। 

শা.বি.র.: এইটাই আমার জায়গা—এইটা বুঝা কিন্তু একেক জনের একেক জার্নির মধ‍্য দিয়ে আসে, আপনার বেলায় সেইটা কীভাবে আসলো . . .

শা.আ: আমার বেলায়, পালাবার পথ নেই র আগে আমার মনে হৈসিল যে আমার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে, যদিও তখন আমি ডক‍্যুমেন্টারি ফিল্ম মেকিংয়ের মধ‍্যে ছিলাম, সেটা এক ধরনের ক্রিয়েটিভ কাজই, কিন্তু আমার মনে হৈসিল ওই অভিজ্ঞতাগুলো আমি ফিকশনে ভালো আনতে পারবো।

আমি তো নাইন্টি সেভেন থেকে পার্ট টাইম চাকরি করি, তারপর ফ‍্যামিলি লাইফের যে বার্ডেন থাকে বাচ্চা মানুষ করা, বড় করা এসব তো আমার ছিল না। আমি ২০০৪ পর্যন্ত সিঙ্গেলই ছিলাম। যার জন‍্য, আমি মাঝে মধ‍্যে বলি যে, ইচ্ছাটা আছে কিন্তু দম নাই, ইচ্ছাটাও বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারি না . . . হা হা হা . . . মানে ওইটা একটা পর্ব গেছে আমার। কিন্তু যখন উপন‍্যাস লেখা শুরু করলাম, তখন মনে হৈল যে আমি সব সময় লেখার মধ‍্যেই আছি।

শা.বি.র.: কোন সময়টায় মনে হৈসিল এমন? 

শা.আ: নাইন্টি টু, না, নাইন্টি ওয়ানের দিককার কথা। তখন তো আমি বাংলাদেশে চলে আসছি ইন্ডিয়া থেকে, ফিল্ম কোর্স ইত‍্যাদি অনেক কিছু করে। আমি প্রথম একটা ছোটগল্পের বই লিখেছিলাম, শ্রীমতির জীবন দর্শন। এইটাও কিন্তু অটোবায়গ্রাফিক‍্যাল, আসলে নিজের অবস্থাটাই বোঝার চেষ্টা ছিল তখন। তখন মনে হয় আমি সার্চই করেছি যে, নিজের অবস্থাটা বুঝতে, কেন আমার এমন হয়। আর সাহিত‍্যের চর্চা ছাড়া অন‍্য চর্চাতো আমাদের ফ‍্যামিলিতে ছিল না, বিশেষ করে গান-বাজনা, ছবি-টবি আঁকা বা ওইরকম কিছু করারও কোন সুযোগ ছিল না তখন। আমার মা এতো বই পড়তেন! তারপর আমার বড় ভাই, মেজো খালা লিখতেন, তো ফ‍্যামিলির মধ‍্যে সাহিত‍্যের একটা ব‍্যাপার ছিল। সবাই একটু সাহিত‍্য নিয়ে ছিল, মানে কথা বলতেই বইয়ের রেফারেন্স চলে আসত। অমুকের লেখা, তমুকের লেখা। তো সাহিত‍্যটাই মূল বিষয় ছিল। সেজন‍্য আমার মনে হয়েছে যে, ওই, পুরানো ভালোবাসার কাছে ফিরে যাওয়া যায়। 

খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের রোমান শাসকদের করা এম্ফিথিয়েটারে, শহরটার প্রাচীন নাম হায়ারপলিস, এখন সেটা পামুক্কালে শহরের ভেতর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ফটো: শামীমা বিনতে রহমান

শা.বি.র.: কোন লেখা বা লেখকের ইনফ্লুয়েন্স কি ছিল?

শা.আ: হয়তো একজনের লেখা ভাল্লাগসে, তার লেখা হয়তো উস্কে দিলো বা লিখতে উদ্বুদ্ধ করলো, এরকম। কিন্তু আমার মনে হয় আমি এটা করতে পারি বা করতে পারবো, তাহলে কেন আমি এখানেই খুঁজছি না! এ চিন্তাটা আসছে বাড়ির পরিবেশ থেকেই। আর্জটা আসছে কিন্তু শুধুই লেখার। আমার প্রথম উপন‍্যাসটা একদমই ডায়েরির মতো লেখা। এখানে কোন পাঠক সিনেই নাই। এইটা একটা বড় ধাক্কার মতো লাগছে, যখন ছাপা বই আমি নিজে পড়তে গেছি, বই হিসাবে পড়তে গিয়ে ঘাবড়ে গেছি। তো রিয়ালাইজেশন অনেক আগে আসলেও  ড্রাইভটা তীব্র ছিল না। গ‍্যাপগুলা দেখো আমার লেখার! অনেক লম্বা লম্বা গ‍্যাপে একেকটা লেখা লিখছি আমি। বছরে হয়তো একটা/দুইটা গল্প লিখছি, কয়েক বছরে একটা বই লিখছি, হ‍্যা, কিন্তু অন্য কিছুও যে করতেসি, তাও না। আমি তো নাইন্টি সেভেন থেকে পার্ট টাইম চাকরি করি, তারপর ফ‍্যামিলি লাইফের যে বার্ডেন থাকে বাচ্চা মানুষ করা, বড় করা এসব তো আমার ছিল না। আমি ২০০৪ পর্যন্ত সিঙ্গেলই ছিলাম। যার জন‍্য, আমি মাঝে মধ‍্যে বলি যে, ইচ্ছাটা আছে কিন্তু দম নাই, ইচ্ছাটাও বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারি না . . . হা হা হা . . . মানে ওইটা একটা পর্ব গেছে আমার। কিন্তু যখন উপন‍্যাস লেখা শুরু করলাম, তখন মনে হৈল যে আমি সব সময় লেখার মধ‍্যেই আছি। মানে দীর্ঘদিন একটা বিষয় নিয়ে থাকা, চারদিন/পাঁচদিন পরও চার/পাঁচ লাইন লিখলেও আমার মনে হয়, আমি লেখার মধ‍্যেই আছি। ধরো বাইরে ট‍্যুর করা, বিভিন্ন প্রোগ্রামে অ্যাটেন্ড করা, কোন কিছুতেই আমি বিশেষ যাই নাই গত প্রায় দুই দশক। এই লেখার মধ‍্যেই ছিলাম।

শা.বি.র.: আচ্ছা . . .

শা.আ: লেখক হওয়ার কথা কিন্তু আমি অনেক পরে ভেবেছি। আমার ছোটবেলার সাহিত‍্য চর্চার মধ‍্যে লেখক হওয়ার বিষয়টা ছিল না। আর তা ক‍্যানো জানো, কোন লেখক আমি কাছাকাছি দেখি নাই। তখন আমার মনে হৈত ওরা অন‍্য জগতের মানুষ। লেখকরা তখন ঢাকা শহরে থাকে, আমি তো তখন ঢাকা শহরের লোকও না . . . হা হা হা. . . .আবার পরে যখন লেখক হৈতেসি আমি, তখন আমার কাছে মেইন বিষয় ছিল, আমি লিখতে চাই, লেখক হবো কি হবো না জানি না। এটা হয়তো আল্টিমেইটলি লেখক হওয়াই, কিন্তু নিজের সামনে ছিল শুধু—এই এই বিষয় নিয়ে আমি লিখতে চাই। মানে লিখেই ওই বিষয়গুলা প্রকাশ করতে চাওয়ার ব‍্যাপারটা আমি বুঝতেছিলাম। মানে সেটা আমার ফিল্ম দিয়ে হবে না, এইটাও ক্লিয়ার হয়ে গেছিল। 

শা.বি.র.: কিন্তু আপনি তো ফিল্মে ছিলেন অনেক দিন . . .

শা.আ: হ‍্যা, এখন দর্শক। ফিল্ম দেখতে দেখতে আমি ডুবে যাই।

আলাদা একটা ভাষায় অনুবাদ হৈসে আমার বই বাংলা বা ইংরেজি থেকে, ওরা আগ্রহ বোধ করতেসে, ওদের নিজেদেরও দেখতে পাচ্ছে—এ রকম একটা ভালোলাগার মধ‍্যে ছিলাম আমি। এ সময়ে পুরস্কারটা বিস্ময়কর ছিল আমার জন‍্য। 

শা.বি.র.: আচ্ছা, অসুখী দিন‘র প্রথম প‍্যারাগ্রাফটা পড়ি? সেইটা নিয়ে একটা প্রশ্ন আছে।

শা.আ: হ‍্যা, পড়ো।

শা.বি.র.: “তখন ট্রেন ছাড়তে মিনিট দশেক দেরি। একশ টাকায় সানগ্লাস কিনে সাবিনা যখন আরো জিনিষ খুঁজছে, তখন পাশের বুকস্ট‍্যান্ডের সংকীর্ণ তাকে অনিতা সেনের স্মৃতিকথা নজরে পড়ে। বাদামি মলাটের সাদামাটা ছাপার, ট্রেনে পড়ার উপযোগী একটা সেকেন্ডহ‍্যান্ড বই। শ্রীহট্টবাসী নীলিমা দাসের শুভ পরিনয়ে শিলং পুলিশবাজারের শংকরলালের প্রীতি উপহার। সাবিনা পায়ের কাছে ব‍্যাগ নামিয়ে বইয়ের পাতা উল্টায়— কী নেই নীলিমা দাসের হাতের হলদে ছোপ লাগা জরাজীর্ণ বইতে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অল ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টি, অগাস্ট আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশ ভাগ . . . “ এইটা অসুখী দিনের প্রথম প‍্যারাগ্রাফ।

শা.আ: হ‍্যা, তাইতো।

শা.বি.র.: বাদামি মলাটের সেকেন্ডহ‍্যান্ড সাদামাটা ছাপার বই ইমেজের সাথে কোথায় যেন মিল আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কমিউনিস্ট পার্টি সংক্রান্ত ইমেজের। মানে কমিউনিস্ট পার্টি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মনে হয় এখন ক‍্যামন জানি পুরানো বইয়ের মলাট, হলুদ নিউজপেপার হা হা হা. . . । যাই হৌক, তো আপনি প্রথম প‍্যারাতেই আপনার কনজুমার বা পাঠকের একটা টেরিটোরি সেট করলেন প্রথম প‍্যারায়। এইভাবে যে শুরু করবেন সেইটা কীভাবে আসলো মাথায়? মানে শুরু করাটা তো অনেক লেখকের জন‍্যই একটা ব‍্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই তো স্ট্রাগল করে যে ফার্স্ট প‍্যারাগ্রাফ কীভাবে শুরু করবেন। তো, অসুখী দিনের শুরুটা কীভাবে সাবিনার সেকেন্ডহ‍্যান্ড বই খুঁজে পাওয়ার মধ‍্য দিয়ে শুরু হবে আসলো আপনার মাথায়, সাথে এক ঝাঁক ট‍্যাগ ওয়ার্ড —মন্বন্তর, দেশভাগ, আজাদ হিন্দ ফৌজ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, এইসব? 

শা.আ: হ‍্যা, শুরুটা আসলেই টাফ। আর এম্নিতেই রেল স্টেশনে আগে বুকস্ট‍্যান্ড তো থাকতোই। এখন দেখা যায় না, কিন্তু আগে এইটা খুবই কমন ছিল। বিভিন্ন ধরনের বই থাকতো সেখানে। আমার উপন‍্যাসের একটা বোধ হয় দিক – আমি শুরুতেই উপন‍্যাসটা কী নিয়ে, সেইটা বলে দেই। তারপর আস্তে আস্তে ভাঁজগুলো খুলতে থাকে। সখী রঙ্গমালাও দেখো। প্রথম সিনেই ও মারা গেছে। তারপর ঘটনাগুলোর… 

শা.বি.র.: হ‍্যা, এরপর ফ্লাশব‍্যাক দিয়ে গল্প আগাইতে থাকে।

শা.আ: আমি জানি না আমার মধ‍্যে এই টেন্ডেন্সিটা কেন বা কীভাবে হৈসে, সেইটা ব‍্যাখ‍্যা করতে পারবো না। কিন্তু প্রথমত, মনে এই ভাবনাটা আসে যে, বলে দেই, মানে বলি পাঠককে বা এরকম একটা হিন্টস রাখি। 

শা.বি.র.: কেন মনে হয়?

শা.আ: হয়তো পাঠককে আমি বোকা বানাতে চাই না বা বেশিক্ষণ ধাঁধায় রাখতে চাই না, এরকম কোন ইচ্ছা থাকতে পারে বা পাঠকের প্রতি মায়া থাকতে পারে. . . হা হা হা . . . মায়া থেকেই এটা হৈতে পারে . . .

শা.বি.র.: হা হা হা  . . .

শা.আ: কারণ আমি নিজেও খেয়াল করে দেখলাম— আমার উপন‍্যাসগুলোতে শুরুতেই একটা জানান দেয়ার ব‍্যাপার আছে। প্রায় সব, এই লাস্ট বইটা ছাড়া।

শাহীন আখতার, কাস, তুরস্ক। ফটো: শামীমা বিনতে রহমান

শা.বি.র.: হা হা হা . . . আচ্ছা এইবার একটু আপনার ব‍্যাপক পুরস্কার প্রাপ্তি, স্বীকৃতি এসব দিকে আগাই। এশিয়ান লিটারেরি অ‍্যাওয়ার্ড ২০২০ যখন পাইলেন, যদিও পুরান অনুভূতি, তবুও ক‍্যামন লাগসিল তখন, একটু যদি ভাষায় প্রকাশ করেন . . . হা হা হা . . .

শা.আ: হ্যা, এইটা একটা বিশাল ব‍্যাপার। আমার মনে হয়েছিল যে, এইটা কি আমি পাওয়ার যোগ‍্য .  . . হি হি হি . . .একদম প্রথম ফিলিং ছিল এইটা, আমি কি এইটা পাইতে পারি!! তখন নিজের ব‍্যাপারে একটা সন্দেহ চলে আসছিল— এই অ‍্যাওয়ার্ড পাওয়ার উপযুক্ত কি-না আমি। অবশ্য এর আগে দুই বার সাউথ কোরিয়া গেছি আমি। হ‍্যা, দুইবারই তালাশ সম্পর্কে বিভিন্ন ইন্টারভ‍্যুতে বা ওদের সাথে কথাবার্তার সময় আমি খেয়াল করসিলাম যে, আগ্রহের একটা ঝিলিক ছিল তাদের চোখেমুখে। যেমন একদিন অনুষ্ঠান শেষে আমাদের পুরানো শহরে নিয়ে যাবে বাসে করে, আমার পাশে একজন বসছে, ইয়াং একটা ছেলে, সে তখন কথা বলা শুরু করে দিল— আমাদের দেশেও এরকম ছিল, মানে যুদ্ধের রেইপড ভিকটিমদের বিষয়ে। মানে এই যে যোগসূত্র, ওদের আগ্রহ জাগিয়ে তোলা, এইটার মধ‍্যেই আমি ছিলাম, এরকম ভালোলাগার মধ্যে আমি ছিলাম। আলাদা একটা ভাষায় অনুবাদ হৈসে আমার বই বাংলা বা ইংরেজি থেকে, ওরা আগ্রহ বোধ করতেসে, ওদের নিজেদেরও দেখতে পাচ্ছে—এ রকম একটা ভালোলাগার মধ‍্যে ছিলাম আমি। এ সময়ে পুরস্কারটা বিস্ময়কর ছিল আমার জন‍্য। 

আগে কিন্তু রিভিয়‍্যুর চর্চা বা আলোচনার বিষয়টা ছিল। এখন গ্রুপওয়াইজ একজন আরেকজনেরটা করে। যদি তুমি কোন গ্রুপে বিলং না করো, সেক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তোমার বইয়ের কোন খবরই নাই। পুরস্কার একটা উপায়, যে তোমার বই চেনাচ্ছে পাঠককে।

শা.বি.র.: আপনি তো তার আগে বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাইছেন ২০১৬ সালে।  

শা.আ: তখন খুশি হৈলেও খুব বেশি অবাক হই নাই। মোটামুটি আমার বয়সের যারা, মানে ওই সময় আমার যে বয়স ছিল, বাংলা একাডেমি পুরস্কার এরকম বয়সে অনেকে তখন পেয়ে গেছেন, যারা মোটামুটি রেগুলার লিখছিলেন. . . 

শা.বি.র.: তো এই যে অনেক অনেক পুরস্কার পাইলেন, পুরস্কার আপনাকে কীভাবে ইন্সপায়ার্ড করে?

শা.আ: উমম, সাহিত‍্যের পাঠক তো খুব কম! পুরস্কার পেলে পাঠক জানতে পারে বইটা সম্পর্কে। আমাদের এখানে রিভ‍্যুয়ু হয় না, বইয়ের আলোচনা সমালোচনা হয় না। বইটা কী নিয়ে লেখা, বইটার কোন গুরুত্ব আছে কি-না, মানে বইটার নেগেটিভ-পজেটিভ কোন কিছুই পাঠকের জানার সুযোগ নাই। আগে কিন্তু রিভিয়‍্যুর চর্চা বা আলোচনার বিষয়টা ছিল। এখন গ্রুপওয়াইজ একজন আরেকজনেরটা করে। যদি তুমি কোন গ্রুপে বিলং না করো, সেক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তোমার বইয়ের কোন খবরই নাই। পুরস্কার একটা উপায়, যে তোমার বই চেনাচ্ছে পাঠককে। তখন বইটার প্রতি আগ্রহী হয় পাঠক।

শা.বি.র.: মানে পুরস্কার হচ্ছে শুধু লেখকের প্রাপ্তি না, বইয়ের পরিচিতি

শা.আ: আসলেই তাই। বইয়ের পরিচিতি বাড়ে, পাঠক কিছুটা বাড়ে।

হ‍্যা, এরকম তো মনে হয়ই যে, অনুবাদ বইটা আরেকজনের লেখা, আমার না। আসলে ভাষার কারণে। এটা তো অন্য একটা ভাষা, যে ভাষায় বইটা আমি চিন্তা করি নাই।

শা.বি.র.: আচ্ছা এবার আপনার লেখার অনুবাদ নিয়ে একটা প্রশ্ন করি, মাথায় আসছে এখন। আপনার উপন‍্যাস তালাশ অনুবাদ হৈসে, আরেকটা পাইপ লাইনে আছে সখী রঙ্গমালা । আপনার ছোটগল্পও অনেক অনুবাদ হৈসে। শবনম নাদিয়া অনেক অনুবাদ করেছেন, আরো বেশ কিছু অনুবাদ করেছেন আরিফা রহমান। আপনার যেসব ছোটগল্প এবং উপন‍্যাস ইংরেজিতে অনূদিত হৈসে, সেসবের অনুবাদ পড়ার পর আপনার ক‍্যামন লাগছে? নিজের লেখা কি অচেনা মনে হৈসিল? কোন দূরত্ব লাগছে কি কখনো আপনার নিজের ভাষায় লেখা এবং ইংরেজি ভাষায় সেই লেখার অনুবাদে? এই শেষের প্রশ্নটা নিয়ে আমি বেশি আগ্রহি। ধরেন আপনার লেখা গল্প ইংরেজিতে অনুবাদ হৈসে, সেইটা তো অবশ‍্যই প্রথমে একটা ভাল্লাগা ফিলিং দেয়। ফার্স্ট অব অল, ভালো লাগা, যে, আপনার লেখার হরাইজন বড় হচ্ছে, কিন্তু আপনার আসলে ক‍্যামন লাগে? লেখায় নিজের ভয়েসটা কি অনুবাদেও ফিল করতে পারেন? 

শা.আ.: তালাশই তো অনুবাদ হওয়া আমার প্রথম বই! তালাশের ফার্স্ট ড্রাফট পড়ছিলাম যখন জুবান থেকে পাঠালো। তখন কতগুলো গ‍্যাপ ছিল। সে অবস্থায় পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল— অন‍্য একজনের লেখাই পড়তেসি, নিজের লেখা মনে হয় নাই। ড্রাফটটা আমার পড়ার কারণ ছিল যে, মূল লেখার সাথে ফ‍্যাকচুয়াল বা অন‍্য কোন ঝামেলা আছে কি-না, সেইটা আইডেন্টিফাই করা। বুঝতে পারছ, ওইরকম একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমার তখন বইটা পড়া। তালাশের অনুবাদক বাঙালি, ওয়েস্ট বেঙ্গলের, দিল্লিতে থাকেন। তো উনি কিছু অংশ মিসড করে গেছিলেন। সখী রঙ্গমালার বেলায় আমি পড়তে গিয়েও পড়ি নাই। আমার মনে হৈসে, নাদিয়া তো বাংলা ভালো জানে, আর ও আমাকে অনেক প্রশ্ন পাঠাতো অনুবাদের সময়, যেইটা তালাশের অনুবাদক কখনোই করেন নাই। আর নাদিয়ার বেলায় যেটা হৈসে, ও অনেক লম্বা লম্বা লিস্ট পাঠাইতো—এইটার কি মিনিং, ওইটার কি মিনিং। তুমি তো দেখছো সখী রঙ্গমালায় অনেক রকমের শব্দ আছে . . .

শা.বি.র.: হ‍্যা, অনেক।

শা.আ: হ‍্যা, এরকম তো মনে হয়ই যে, অনুবাদ বইটা আরেকজনের লেখা, আমার না। আসলে ভাষার কারণে। এটা তো অন্য একটা ভাষা, যে ভাষায় বইটা আমি চিন্তা করি নাই। আরেকটা দিক—আমি যতটুকুই অনুবাদ পড়েছি আমার লেখার, সেইটা ড্রাফট। কারণ তখন দেখতে হৈসে, ওই রকম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেমন থাকে বাংলার সাথে ইংরেজির গ‍্যাপ। অনেক সময় দেখা যায় ট্রান্সলেটররা বাংলায় অনেক বেশি দক্ষ না, বা ইংরেজি ভাষাটা তার জন‍্য বেশি সুবিধার। সেক্ষেত্রে ওই রকমই, একদম মনে হয় অন‍্য আরেকজনের লেখা। আমি আমার লেখা বাংলাতেই শুধু ফিল করতে পারি… হা হা হা

ভূমধ‍্যসাগরের মধ‍্যে বা পাড় ঘেষা প্রত্নতাত্ত্বিক শহর দেখা, পানিতে ডুবাডুবি, সাঁতার, বারবিকিউ ইত‍্যাদির দিনমান বোটট্রিপ। ফটো: শামীমা বিনতে রহমান

শা.বি.র.: উমবার্তো একোর চক্করে আবার একটু আসি। আসলে উনার একটা লেখা অনুবাদ করতেছি বলে বারবার আইসা পড়তেসে। উনি যেমন ঘুরাঘুরিই করছিলেন উপন‍্যাস লেখার জন‍্য, যেমন দ‍্য নেইম অব দ‍্য রোজ লিখার জন‍্য মধ‍্যযুগের মনাস্ট্রিতে ঘুরছেন, বিল্ডিংয়ের মাপ-ঝোঁক করছেন, মানে একাডেমিক রিসার্চের মতো, আপনার ঘুরাঘুরিটা আপনার লেখায় কীরকম এফেক্ট রাখে? 

শা.আ: উমম, যেমন অসুখী দিনে তো আমি তিনবার শিলং গেছি। অঞ্জলি লাহিড়ীর ক‍্যারেক্টারের আদলে কিন্তু অনিতা সেন, উনার ভাই গেছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজে। তো প্রথমবার তো বেড়ানো টেড়ানো ছিল। কিন্তু পরে যখন আমি ভাবলাম লিখবো, তখন আমি একাই যাই। ততদিনে উনি মারা গেছেন। তারপরে আরেকবার গেছি, হ‍্যা। তখন উনার বাড়িতে বসে আমি লিখছিলাম শেষ অধ‍্যায়গুলি। কয়েকটা অধ্যায়ের ড্রাফটও করসিলাম। ওই বাড়িটার অনেক কিছুই আমার ভেতরে ঢুকে গেছিল, মানে ওইরকম একটা জায়গা, খুবই ডাইরেক্ট একটা সম্পর্কের মতো। কিন্তু কনস্ট্রাকটিভ ওয়‍্যেতে যে চিন্তাভাবনাটা আসতেছে, সেইটা না, মানে এইটা একটা অনুভূতির বিষয়। ফিল করার বিষয়। আর ডিটেইলের বিষয় তো আছেই।

ওলগা তোকারচুকের একটা ইন্টারভ‍্যুতে আমি পড়ছিলাম, কোন উপন‍্যাস নিয়ে আমার এই মুহূর্তে মনে নাই, দ্য বুকস অব জ্যাকব সম্ভবত। ওইখানে সেলাইয়ের একটা খুব সুন্দর বর্ণনা ছিল, কিন্তু পরবর্তী রিসার্চে বের হয়, যে সময়টা নিয়ে সে লিখছিল, সে সময়ের সুঁইটা হৈত কাঠের। এখনকার সুঁই যেমন সঞ্চালনের সময় দারুণ একটা ঝিলিক দেয়, তার একটা সুন্দর বর্ননা দিসিল সে প্রথম ড্রাফটে। কিন্তু বর্ণনাটা তাকে বাদ দিতে হৈসিল যখন সে রিসার্চে দেখল সুঁইটা কাঠের। ঐতিহাসিক উপন‍্যাস লেখায় গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তুমি প্রেজেন্টে বসে পাস্ট কনস্ট্রাক্ট করতেছ।

শা.বি.র.: সখী রঙ্গমালায় বেশ কিছু ডিটেইল আছে, ওইটা পড়তে পড়তে আমার মনে হৈসিল ডিটেইলের ক্ষেত্রে আপনি আসলে কী অ‍্যাফোর্টটা দেন . . .

শা.আ: ঐতিহাসিক উপন‍্যাস হলে একধরনের ডিটেইল আবার কনটেম্পরারি সময়ের হলে আরেক ধরনের। আমি তখন মিউজিয়ামগুলিতে ঘোরাঘুরি করি, গয়না টয়না কী রকম হৈতে পারে। মসলিন শাড়ির জন‍্যও আমি মিউজিয়ামে গেছিলাম। মসলিন শাড়ির একটা রেফারেন্স আছে সখী রঙ্গমালায়। আর রঙ্গমালার সাজটা . . .

শা.বি.র.: আমি আসলে বলতেসি কি যে ঐতিহাসিক উপন‍্যাস তো আসলে তাই-ই, আমরা তো সবসময় ইতিহাসকে ইগনোর করি, আমরা তো প্রেজেন্টে থেকে প্রেজেন্টই ভাবি, মানে আমি ইন জেনারেল বলতেসি। তো লেখক যখন ওই জায়গাটা উস্কে দিতে পারে যে লুক ব‍্যাক, ফিরে দেখ, ওইটাই তো আসলে ইতিহাস নির্ভর সাহিত‍্যের একটা সফলতা যে তুমি তাকাও এই দিকটায় আর কি। তো তাকাও এই দিকে বলার জন‍্য লেখকের নিজেরও লাইক . . .

শা.আ: দেখতে হয়, লেখককেও তাকাতে হয়। সখী রঙ্গমালায় যে জলটুঙ্গি ঘরটা, নোয়াখালি অঞ্চলে গিয়ে আমি দেখেছি— গরমের মধ‍্যে বসার জন‍্য এরকম সাঁকো থাকে, সাঁকো দিয়ে গিয়ে পুকুরের মাঝখানের একটা ঘরে ওঠে। পানির বাতাসটা লাগে ওইখানে। এই জিনিষটা ওই অঞ্চলে ছিল। পালাগানের মধ‍্যেও আছে। জলটুঙ্গি ঘরই ছিল, যদি এইভাবে বলো, ওইটা একটা ডেটিংয়ের জায়গা। এরকম কিছু। তো এই ডিটেইলগুলার জন্য অ্যাফোর্ট দেয়া লাগে। ওই সময়টার মধ‍্যে কী ছিল, ওই সময়টার মধ‍্যে কী রকম . . .

শা.আ: সব সময়ই প্রেজেন্টেশনটা এমন হয়, যেন মধ‍্যযুগে কোন আলো ছিল না। নামও দিসে অন্ধকার যুগ, মধ্যযুগকে। তখন অনেক ফান ছিল, অনেক মজা ছিল। ওই যে অ‍্যান্থলজি—বাংলা সাহিত্যে নারী, এর সম্পাদনা করাটা আমার খুব কাজে লাগছে যে, মধ‍্যযুগের সাহিত‍্য বেশ নাড়া চাড়া করতে হৈসে। তারপরে ধরো, প্রি ব্রিটিশ, জাস্ট ব্রিটিশদের আসার আগে সাহিত‍্যের যেসব ফর্ম ছিল, সেগুলির মধ‍্যে এত উইট, এত ওপেননেস ছিল, যেটা পরে ভিক্টোরিয়ান ভ‍্যালুজ ঢুকে বরবাদ করে দেয়। এই অন্ধকার যুগ ব‍্যাপারটা কিন্তু পুরা কলোনিয়াল একটা অ‍্যাটিচুড যে তোমরা অন্ধকারে ছিলা, আমরা আলো নিয়া আসছি। এরকমই কিন্তু, তাই না?

শা.বি.র.: টাফ না এইটা?

শা.আ: হ‍্যা টাফই। ওলগা তোকারচুকের একটা ইন্টারভ‍্যুতে আমি পড়ছিলাম, কোন উপন‍্যাস নিয়ে আমার এই মুহূর্তে মনে নাই, দ্য বুকস অব জ্যাকব সম্ভবত। ওইখানে সেলাইয়ের একটা খুব সুন্দর বর্ণনা ছিল, কিন্তু পরবর্তী রিসার্চে বের হয়, যে সময়টা নিয়ে সে লিখছিল, সে সময়ের সুঁইটা হৈত কাঠের। এখনকার সুঁই যেমন সঞ্চালনের সময় দারুণ একটা ঝিলিক দেয়, তার একটা সুন্দর বর্ননা দিসিল সে প্রথম ড্রাফটে। কিন্তু বর্ণনাটা তাকে বাদ দিতে হৈসিল যখন সে রিসার্চে দেখল সুঁইটা কাঠের। ঐতিহাসিক উপন‍্যাস লেখায় গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তুমি প্রেজেন্টে বসে পাস্ট কনস্ট্রাক্ট করতেছ। অতীত সময় নিয়ে এইরকম একটা চলতি ধারণা—ওদের মনে হয় কোন হাসি কান্না ছিল না, কোন স্বাভাবিক জীবনই ছিল না। ওরা একদমই যাচ্ছে তাই অবস্থায় ছিল। এই জিনিষটা যে কত ফলস! আমি মনে হয় এক জায়গায় বলছি বা লিখছি কোন ইন্টারভ‍্যুতে, যে, এই যে দূরের মানুষদের একদম জড় পদার্থ ভাবা, মানে একদমই অন্ধকারের প্রাণী ভাবা, এ জিনিষটা ব্রেক করা আমার ঐতিহাসিক উপন‍্যাস লেখার একটা প্রেরণা।

শা.বি.র.: কিন্তু আমরা এরকম কেন ভাবি?

শা.আ: সব সময়ই প্রেজেন্টেশনটা এমন হয়, যেন মধ‍্যযুগে কোন আলো ছিল না। নামও দিসে অন্ধকার যুগ, মধ্যযুগকে। তখন অনেক ফান ছিল, অনেক মজা ছিল। ওই যে অ‍্যান্থলজি—বাংলা সাহিত্যে নারী, এর সম্পাদনা করাটা আমার খুব কাজে লাগছে যে, মধ‍্যযুগের সাহিত‍্য বেশ নাড়া চাড়া করতে হৈসে। তারপরে ধরো, প্রি ব্রিটিশ, জাস্ট ব্রিটিশদের আসার আগে সাহিত‍্যের যেসব ফর্ম ছিল, সেগুলির মধ‍্যে এত উইট, এত ওপেননেস ছিল, যেটা পরে ভিক্টোরিয়ান ভ‍্যালুজ ঢুকে বরবাদ করে দেয়। এই অন্ধকার যুগ ব‍্যাপারটা কিন্তু পুরা কলোনিয়াল একটা অ‍্যাটিচুড যে তোমরা অন্ধকারে ছিলা, আমরা আলো নিয়া আসছি। এরকমই কিন্তু, তাই না?

শা.বি.র.: হ‍্যা তো, একদম। একদম কলোনিয়াল অ‍্যাটিচুড যে তোমরা ছিলা অসভ‍্য, অন্ধকারে, জ্ঞান-ফানহীন, আমরা তোমাদের সভ‍্য করসি, জ্ঞান দিসি

শা.আ: সবসময় অন্ধকারেই ছিলাম, এইভাবেই কিন্তু আমরা আমাদের পাস্টকে দেখতে চাই। বলিও যে, অন্ধকার যুগ। এইটা ভাঙ্গাও কিন্তু লেখকের একটা কাজের মধ‍্যে পড়ে, মানে যেই লেখক আগ্রহী, তার ক্ষেত্রে বলতেসি।

খ্রীস্টপূর্ব ১৪/১৫ থেকে চার শতক পর্যন্ত লাইসিয়াম শাসকদের অধীনে থাকা প্রাচীন শহর, সিমেনায়। এটা তুরস্কের কেকোভা আইল‍্যান্ডে। শাহীন আখতার সিমেনা ক‍্যাসলের প্রত্নতাত্বিক অবশেষে হাঁটছেন, এইটা অবশ‍্য বাইজেন্টাইন সময়কার, কিন্তু লাইসিয়াম সময়কার ফাউন্ডেশনের ওপর তৈরি। ক‍্যাসেলের ডান দিকে লাইসিয়াম সময়কার পাথরের কবরের সারি, কখনো পাহাড়ে, কোথাও ভূমধ‍্যসাগরের পানিতে আধা ডুবে থাকা। লাইসিয়াম নেক্রোপলিস। ফটো: নাজমুল হাসান অপু

শা.বি.র.: আচ্ছা, এবার আপনার সমসাময়িক লেখকদের নিয়ে প্রশ্ন করি। আমি একটু ভুলভালও করতে পারি, যাদের নাম মাথায় আসছে, তাদের নাম ই বলি—কফিল আহমেদ, কাজল শাহনেওয়াজ, চয়ন খায়রুল হাবিব, শাহাদুজ্জামান, সুমন রহমান, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ব্রাত‍্য রাইসু, মাশরুর আরেফিন, চঞ্চল আশরাফ, ইচক দুয়েন্দে, মশিউল আলম—এদের লেখা কেমন পড়াপড়ি হয়? আপনি কি আসলে কনটেমপরারিদের লেখা পড়েন? অনেক সময় এমন হয় যে . . . 

শা.আ: আমি বই-পড়াটা এমন স্বাধীনভাবে করতে চাই, খুবই ভাল্লাগার জায়গা থেকে, যার মধ্যে এমন থাকে না যে, কনটেমপরারিদের লেখা পড়া উচিৎ। আমার খুব বেশি পড়া হয় নাই বা কম পড়ছি।

এমন না যে আমি ইগনোর করছি বা ওরা ভালো লেখক না, আমি পাত্তা দিতেসি না, ব‍্যাপারটা তা না কিন্তু।

শা.বি.র.: কাজল শাহনেওয়াজ পড়ছেন?

শা.আ: ছোটগল্প পড়ছি। মশিউলের গল্প পড়েছি। এখানের কম বেশি সবারই কিছু পড়ছি। যেমন, রাইসুর কবিতা, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের অনুবাদ, কবিতার অনুবাদ। সাজ্জাদ শরিফের ‘সোলেমান গীতিকা’র কথা তোমাকে বলছি মনে হয়। খুব সুন্দর অনুবাদ সং অব সলোমনের।

শা.বি.র.: আমিও সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের অনুবাদ পড়ছিলাম প্রথম। টিএস এলিয়টের দ‍্য ওয়েস্ট ল‍্যান্ড এবং দ‍্য লাভ সং অব আলফ্রেড জে প্রুফক . . .। আবার, আপনার তো সবার লেখা পড়তে ইচ্ছা না-ও হৈতে পারে . . . নাকি?

শা.আ: ইচ্ছা অনিচ্ছার চাইতে বেশি যা, তুমি যদি দেখো দেশি-বিদেশি মিলিয়ে তোমার সামনে কত কিছু পড়ার। আর তোমার হাতে সময় কত কম। তখন তুমি সবসময় হিসাব করবা। নিজের পছন্দ আর প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিবা।

শা.বি.র.: আবার আমার কাছে লাগতেছে আপনি, মানে আজকে আপনি যেমন বলতেসিলেন যখন আপনি কোন কিছুতে আকৃষ্ট হয়ে ঢুকে যান, ঢুকে গেলে টানে খুব, মনে হয়ে যেন টানেলে ঢুকে যাওয়া, তখন আর চারপাশ খেয়াল করা হয় না . . . এরকম তো হয় . . .

শা.আ: এটাও মনে হয়। গত দেড় দুই দশক আমার আসলে চারদিকে তাকানোটা হয় নাই। এর মানে কিন্তু নিজের মধ‍্যে নিবিষ্ট হওয়া। নিজের মধ‍্যে নিবিষ্ট হওয়ার জন‍্যই আসলে এমনটা ঘটছে। এমন না যে আমি ইগনোর করছি বা ওরা ভালো লেখক না, আমি পাত্তা দিতেসি না, ব‍্যাপারটা তা না কিন্তু।

শা.বি.র.: আঁ-হ‍্যা, আমি বুঝতে পারতেসি আপনাকে একদম।

শা.আ: আমি আসলে ওই কনটেন্টের মধ‍্যেই ঢুকে থাকি, সেইটা আমাকে তখন আচ্ছন্ন করে রাখে। অনেক বাধ্য-বাধকতা থেকে স্বাধীনতাও দেয়। এরমধ্যে অবশ্য চোখের সমস্যা বেড়েছে। ফ্যামিলিতে শোক, অসুখ। 

তখন মনে হচ্ছিল — ও এই বিষয় নিয়ে লিখছে? আচ্ছা! অত পাত্তা দেয়ার কিছু নাই। আর কলাম টলাম তো পড়তামই না। আমরা তখন সাহিত‍্য পড়াটড়া মানুষ, বুঝছ হা হা হা . . . পরে দেখলাম যে, আমার খালাত বোনের মেয়ে-টেয়ে, এই জেনারেশন বড়ই হৈতেসে তসলিমা নাসরিনের লেখা পড়ে।

শা.বি.র.: এই প্রশ্নটা করার কারণ আছে। আপনি যখন লেখকদের সাক্ষাতকার দেখবেন না, আমি জানি না, লেখকরা ফেইক করে না কি, ওরা বলে হ‍্যা, আমি কনটেম্পরারি সবার লেখা পড়ি। এই কথাটা এত হাস‍্যকর লাগে!

শা.আ: হ‍্যা, একই গ্রুপে থাকলে কয়েকটা নাম বলেন তখন।

শা.বি.র.: হা হা হা. . . আচ্ছা, উপরের প্রশ্নটা পুরাই পুরুষ লেখক ঠাসা হয়ে গ‍্যাছে। তসলিমা নাসরিন এবং আপনি, আপনাদের লেখালেখি শুরুর বেশ আগু পিছু আছে, কিন্তু আপনারা কনটেম্পরারি বলা চলে। তসলিমার একটা হাইপার ফেইজ ছিল, এবং সেইটার শেষ দিকে, মানে নব্বই দশকের শেষ দিকে এসে আপনার প্রথম উপন‍্যাস বের হয় পালাবার পথ নেই। তসলিমা নাসরিনের লেখালেখির সাথে আপনার ইন্টারেকশন ক‍্যামন? তসলিমা নাসরিন আসলে এমন একজন লেখক, লেখালেখি নিয়ে কথা বলতে গেলে তার কথা বলতেই হবে। তো, আপনার সাথে ক‍্যামন ইন্টারেকশন ছিল? 

শা.আ: একদমই ছিল না। কোন ইন্টারেকশনই ছিল না। আমার সাথে পার্সোনালিও ছিল না। 

শা.বি.র.: পার্সোনালি ছিল না। কিন্তু লেখালেখির সাথে? 

শা.আ: লেখালেখির সাথেও খুব একটা ছিল না। কারণ, তসলিমা যখন ওই বিষয়গুলি লিখতেছে, তখন আমরা সিঙ্গেল মেয়ে হিসাবে অনেক স্ট্রাগলের মধ‍্যে। সেইটা পরের জেনারেশনের মেয়েদের অনেক আকৃষ্ট করছে—আমি খেয়াল করেছি। কিন্তু আমি বা আমাদের যে বন্ধুরা তখন একা বাসা নিয়ে থাকা, ইত্যাদি সমস‍্যা পোহাচ্ছি নাইন্টিজে, তখন এইগুলাই আমাদের কাছে বড় বিষয় ছিল, তসলিমার লেখা গুরুত্ব পায় নাই . . . 

শা.বি.র.: মানে আপনারা তখন অলরেডি সেই জীবন যাপন করে যাচ্ছেন, তসলিমার লেখা পড়ার আবার কী আছে, এরকম ব‍্যাপারটা?

শা.আ: তখন মনে হচ্ছিল — ও এই বিষয় নিয়ে লিখছে? আচ্ছা! অত পাত্তা দেয়ার কিছু নাই। আর কলাম টলাম তো পড়তামই না। আমরা তখন সাহিত‍্য পড়াটড়া মানুষ, বুঝছ হা হা হা . . . পরে দেখলাম যে, আমার খালাত বোনের মেয়ে-টেয়ে, এই জেনারেশন বড়ই হৈতেসে তসলিমা নাসরিনের লেখা পড়ে। আমার মনে হয় না যে, আমাদের জেনারেশনে ওইভাবে প্রভাবটা পড়েছে। আমাদের থেকে পরের জেনারেশনে এই প্রভাবটা বেশি। 

ফ্লুইড। প্রবহমান। আমি অ‍্যাক্টিভিস্ট হিসাবে কাজ করেছি, তারপর আবার করি নাই। আবার আড্ডা দিতে বসলে তো পলিটিক‍্যাল বিষয় নিয়ে কথা বলি। পলিটিক‍্যাল না, এটাও বলতে চাই না। সত‍্যিকার অর্থে এই ছকের মধ‍্যেও পড়ি না। ননফেমিনিস্ট অনেক আচরণ করি কখনো কখনো, ওইগুলা নিয়া আমার মাথা ব‍্যথা নাই। আমি ফেমিনিস্ট আবার ফেমিনিস্টও না। 

শা.বি.র.: বুঝতে পারছি হা হা হা . . . যে জীবন আপনি নিজেই যাপন করতেসেন, সেই জীবন নিয়ে বেশি কিছু বলার কী আছে, এরকম না? আচ্ছা আরো কিছু নাম বলি লেখক সমাজের। সাগুফতা শারমিন তানিয়া, ইমরুল হাসান, অদিতি ফাল্গুনি, রাশিদা সুলতানা, আফসানা বেগম, লুনা রুশদী —ইনাদের লেখা আপনার ক‍্যামন পড়া হয়? 

শা.আ: সমসাময়িক লেখকদের লেখা পড়া নিয়ে একটু আগে যা বল্লাম, সেটাই এখানে রিপিট করতে চাই। সবার লেখাই আমি কম বেশি পড়েছি। এখানে তোমার নামটা ঢুকাতে চাই। তোমার লেখা ছোট গল্প সবই আমার পড়া, পড়ার অপেক্ষায়ও থাকি, খুব কম লিখছ তো.. এখনকার মধ্যে লুনা রুশদীও খুব কম লেখে। সাগুফতার ভাষায় উচ্ছলতা আছে। বর্ণালী সাহা, রাশিদা সুলতানার লেখা পড়ি আমি। আর অন্যদেরও কিছু কিছু পড়েছি। আমার সমসাময়িক বা তার পরের লেখকদের ভাষা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট যেমন.. চলতি ভাষার শুদ্ধতা, কারুময়তা। আরেক দিকে ওয়েস্ট বেঙ্গলের সাহিত‍্য-ভাষাকে ডিনাই করে অনেকেই লিখছেন এখানে, চমৎকার একটা শৈলী তৈরি হৈসে বা হৈতেসে। এই পরের ট্রেন্ডটাই আমাকে টানে বেশি। কাছের লাগে নিজের।

ওল্ডটাউন, আন্তালিয়া, তুরস্ক। ফটো: নাজমুল হাসান অপু

শা.বি.র.: পরের প্রশ্ন শেষ প্রশ্ন। আপনি কি নিজেকে ফেমিনিস্ট মনে করেন?

শা.আ: আর্টিস্ট কীভাবে একটা ফ্রেমের মধ‍্যে থাকে! কথাটা আমাকে ভেবে বলছি না, জেনারেলি বলতেসি। আমি নানা ইজমের মধ‍্যেই আছি, একটা থেকে আরেকটায় স্রোতের মতো যাচ্ছি। ফ্লুইড। প্রবহমান। আমি অ‍্যাক্টিভিস্ট হিসাবে কাজ করেছি, তারপর আবার করি নাই। আবার আড্ডা দিতে বসলে তো পলিটিক‍্যাল বিষয় নিয়ে কথা বলি। পলিটিক‍্যাল না, এটাও বলতে চাই না। সত‍্যিকার অর্থে এই ছকের মধ‍্যেও পড়ি না। ননফেমিনিস্ট অনেক আচরণ করি কখনো কখনো, ওইগুলা নিয়া আমার মাথা ব‍্যথা নাই। আমি ফেমিনিস্ট আবার ফেমিনিস্টও না। 

শা.বি.র. : হা হা হা  . . .অনেক আড্ডা হৈসে। চলেন, এবার সমুদ্রে যাই, সূর্য ডুবিডুবি হয়ে আসছে।

শাহীন আকতারের সাথে আড্ডার প্রথম পর্ব

শাহীন আখতার: এই প্রতিক্রিয়াটা আমাকে একটা ভয়ের জায়গায় নিয়ে গেছিল এবং আমার মনে হয় এরপরই আমার মধ‍্যে উপন‍্যাস লেখার ভাবনাটা আসে/ আড্ডা পর্ব ১

শাহীন আখতারের বইসমূহ:

উপন‍্যাস: 

এক শ এক রাতের গল্প (২০২২), অসুখী দিন (২০১৮), ময়ূর সিংহাসন (২০১৪), সখী রঙ্গমালা (২০১০), পালাবার পথ নেই (২০০০ সালে ঢাকায় প্রকাশ, ২০০২ সালে কোলকাতা)। এরমধ‍্যে আর্ন্তজাতিক খ‍্যাতি পাওয়া উপন‍্যাস, তালাশ। 

তালাশ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৪। ওই বছরই বইটি প্রথম আলোর বর্ষ সেরা পুরস্কার পায়। এটি এখন জার্মান ভাষায় অনুবাদের প্রক্রিয়াধীন। ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে ২০১১ সালে। The Search নামে। অনুবাদ করেন এলা দত্ত (Ella Dutta), জুবান (Zubaan) নিউদিল্লি  থেকে প্রকাশিত। কোরিয়ান ভাষায় অনুবাদ হয় ২০১৮ সালে। অনুবাদক সিং হি জন (Seung Hee Jeon)। কোরিয়ান ভাষায় অনুদিত তালাশের জন‍্য তিনি ২০২০ সালে এশিয়ান লিটারেরি অ‍্যাওয়ার্ড পান।

সখী রঙ্গমালার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে সদ‍্য, সেপ্টেম্বর মাসে। ইংরেজি অনুবাদে নাম Beloved Rongomala.  অনুবাদ করেন শবনম নাদিয়া (Shabnam Nadiya), ওয়েস্টল‍্যান্ড বুকস (Westland Books)।

ছোটগল্প: 

শ্রীমতির জীবনদর্শন (১৯৯৭), বোনের সঙ্গে অমরলোকে (২০০১), ১৫টি গল্প (২০০৪), আবারও প্রেম আসছে (২০০৬), শিস ও অন‍্যান‍্য গল্প (২০১৩), ভালোবাসার পরিধি (২০২০)

সম্পাদিত বই:

জানানা মহফিল/ বাঙ্গালি মুসলমান লেখিকাদের নির্বাচিত রচনা (১৯০৪-১৯৩৮), যৌথ সম্পাদনা, মৌসুমী ভৌমিক, আরেকজন সম্পাদক। ১৯৯৮ সাল। ইংরেজি অনুবাদ হয় বইটির ২০০৮ সালে। অনূদিত নাম: Women in Concert – An Anthology of Bengali Women’s Writings ( 1904-1938).

সতী ও স্বতন্তরা/ বাংলা সাহিত‍্যে নারী (তিন খন্ড)। ২০০৭। 

কাভার ফটো: নাজমুল হাসান অপু। কাস, তুরস্ক।