শামীমা বিনতে রহমান
প্রশ্ন: আপনারা অস্ত্র জমা দিয়ে দেয়ার পর, এই সমস্ত অন্তরায়কে ফেইস করতে আবার যে অস্ত্র তুলে নিলেন, সেটা কবে থেকে?
সন্তু লারমা: এটা তো ২০০০ বল্লাম না, হ্যা। ওটা আমরা সীমিত রেখেছিলাম আর কি। এখন দেখতেছি না। সরকার কিছুই করতেছে না। এদের আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। ইউপিডিএফসহ যারা তাদের সাথে যুক্ত আছেন এদের সাথে সংঘাতটা চলতেছে।
প্রশ্ন: সশস্ত্র স্কোয়াডে কতজন আছেন?
সন্তু লারমা: এটা অনেক আছে। অনেক।
প্রশ্ন: সংখ্যাটা কত?
সন্তু লারমা: আছে। বেশ কয়েকশত আছে। আমি কোন দিন স্বীকার করি নাই যে আমরা ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছি, আমি কোন দিন কোথাও বলি নাই।
এই সাক্ষাৎকারেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, পরে যেটি শান্তি চুক্তি নামে পরিচিতি পায়, এর স্বাক্ষরকারী, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা তার রাঙ্গামাটির বাসভবনে বসে প্রথম প্রকাশ করেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তির মাধ্যমে অস্ত্র জমা দেয়ার পর, চুক্তি বাস্তবায়নে আবার সশস্ত্র স্কোয়াড কার্যক্রম পরিচালনার কথা।
সাংক্ষাৎকারের এই সংক্ষিপ্ত অংশটুকু নেয়া ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন প্রচারিত আমার ২০১১ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে। সেই সময় শান্তিচুক্তির ১৪ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সন্তু লারমা সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন নভেম্বরের শেষ দিকে।
আজকে আবার ২ ডিসেম্বর। ২০১৬ সাল। মানে পার্বত্য চট্টগ্রামে, ১৯৭৭ সাল থেকে আদিবাসিন্দা পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীদের ভূমি, বিচার, প্রশাসনিক কার্যক্রম এইসবের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বায়ত্ব শাসন এবং জাতিগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যানুযায়ী অধিকার ঠিকঠাক রাখার দাবিতে যে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে শান্তিবাহিনী, তার কাগজে কলমে সমাপ্তি ঘটে ২০ বছর পর, ১৯৯৭ সালে। চুক্তির মাধ্যমে। শান্তিচুক্তি নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত এই চুক্তির আজকে ২০ বছর।
বার্মা এবং উত্তরপূর্ব ভারতের সীমানা বেস্টিত পার্বত্য চট্ট্রগামের প্রায় ৫ হাজার বর্গমাইলের ভেতর ২০ বছর আগে, মানে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র বাহিনী শান্তিবাহিনী যখন সরকারের বিরুদ্ধ সশস্ত্র আন্দোলন করে যাচ্ছিল, তখন সেখানকার ঘটনা ছিল গণহত্যা।
সেনাবাহিনী এবং সেটেলার বাঙ্গালির যৌথ হামলায় পাহাড়িদের ওপর প্রথম গনহত্যা ঘটে ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার কলমপতি ইউনিয়নে। প্রায় ৩০০ পাহাড়ি খুন হন সেই হামলায়। এরপর ১৯৮৪ সালে একই জেলার বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়নে গণহত্যা, ৪০০ পাহাড়ী খুন হন।
পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা, লংগদু, লোগাং –পাহাড়ের এসব নামের সাথে একেকটা গণহত্যা- নৃশংস ঘটনার মেমোরি।
শান্তি চুক্তির মাত্র ১ বছর আগে, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন কল্পনা চাকমার অপহরণ, আর কখনোই ফেরত না আসা এবং অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা অচিহ্নিত থেকে যাওয়া, চাকমা, মারমা, ম্রো, ত্রিপরা, ব্যোম, লুসাইসহ পাহাড়ি বাসিন্দাদের আরো এক থমথমে স্মৃতি। আর পাহাড়ি নারীর ওপর ধর্ষণ, পুরুষ অপহরণ এইসব তখন শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করা হিসাবে জায়েজ করেছিল সেনা এবং গণতন্ত্র শাসিত সকল সরকার।
আর শান্তিচুক্তির পর এখনো অসংখ্য হামলা হচ্ছে, হামলার পেছনে বরাবরই সেনা, বিজিবি আর সেটালার বাঙ্গালিদের কথা এসেছে হামলাকারী হিসাবে। ১৯৯৭ সালে চুক্তির পর গত ১৯ বছরে পাহাড়ে হামলার ঘটনা কোন অংশেই কমে নাই। তবে হামলার ধরণ পাল্টেছে।
ব্রাশফায়ারে গুলি করে ৩০০/৪০০ পাহাড়ি এক বারে খুন করার ধরনের বদলে এখন বেশি ঘটছে আগুন, গুলি একসাথে। ২০০৮ সালের রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাই হাটে পাহাড়িদের ওপর যে আগুন আর গুলি চলেছিল, তাতে স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল সাফ করা। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির বাঘাইহাট থেকে সাজেকে চলে যাওয়া রাস্তার দুই পাশ থেকে মারমা, ত্রিপরা, লুসাই, পাঙ্খোয়া, চাকমা পাহাড়ি বাসিন্দা উচ্ছেদ করে ফেলা।
২০০৮ এর পর ২০১০ আর ২০১২ সালেও এই একই জায়গায়, এই বাঘাইছড়িতে ,পাহাড়ি বাসিন্দাদের ওপর হামলা হয়। খাগড়াছড়ি জেলা পার হয়ে রাঙ্গামাটি জেলায় ঢোকার মুখে উপজেলাটি, যার উপর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে রাঙ্গামাটির এখনকার জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা সাজেক ভ্যালিতে । তখনকার উচ্ছেদের কারন এখন, ৮ বছর পর খালি চোখেই বোঝা যায়।
বাংলাদেশ-ভারত সীমানা ভাগকারী সাজেক নদীর নামে নাম, সাজেক, সাজেক ভ্যালি এখন শুধু পর্যটকদের গন্তব্যই না, সামরিক বাহিনীর অর্থ উপার্জনেরও উৎস। এখানকার রিসোর্টগুলো পরিচালনা করছে বাংলাদেশ আর্মি। সাজেকের রুইলুই পাড়ায় পর্যটকের থাকার ব্যবস্থা রিসোর্ট রুনময়, সাজেক রিসোর্ট ২ টাই বাংলাদেশ আর্মি পরিচালিত।