ইউক্রেনিয়ান কবি সারহেই জাদান (Serhiy Zhadan)’র Take Only What Is Most Important ইংরেজি শিরোনামের এই কবিতা শিরোনামসহ পুরা কবিতা ইউক্রেনিয়ান ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন Virlana Tkacz এবং Wanda Phip। ইংরেজি থেকে অনুবাদ শামীমা বিনতে রহমান।
শুধু তাই নাও সাথে যেটা সবচে জরুরি
কেবল সেটাই সঙ্গে নাও যেটা সবচে দরকারি। চিঠিগুলা নাও।
শুধু সেসবই নাও যেসব তুমি বহন করতে পারবা।
আইকনগুলা আর এমব্রয়ডারিটা নাও, রূপাটা নাও,
কাঠের ক্রুশবিদ্ধ যিশুটা নাও এবং সোনালী রেপ্লিকাগুলা।
কিছু ব্রেড নাও, বাগান থেকে কিছু সবজি, তারপর যাও।
আমরা আর কখনো ফিরে আসবো না।
আমরা আর কখনো আমাদের শহর দেখবো না।
সব চিঠি নাও, সবগুলা, খারাপ খবরের প্রতিটা শেষ অংশ।
আমরা কখনোই আর গলির মুদি দোকান দেখতে পাবো না।
আমরা কখনোই আর সেই কুয়া থেকে পানি তুলে খেতে পারবো না।
আমরা কখনোই ঘনিষ্ঠজনদের চেহারা দেখতে পাব না আর।
আমরা রিফ্যুইজি। আমরা ছুটতে থাকবো রাতভর।
সূর্যমুখীর ক্ষেত ছাড়িয়ে আমরা যেতে থাকবো।
আমরা কুকুর থেকে পালাবো, দায়িত্ব রাখবো গরুর।
আমরা আমাদের খালি হাত জড়ো করে পানি তুলবো,
ক্যাম্পের ভেতর অপেক্ষায় বসে থাকবো, যুদ্ধের ড্রাগনদের উৎপাত করবো।
আমরা আর কখনোই ফেরৎ আসবো না এবং বন্ধুরা আর কখনো ফিরে আসবে না।
কোন ধোঁয়াটে রান্নাঘর থাকবে না, কোন নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজ থাকবে না,
কোন ঘোর-ঘোর আলো থাকবে না ঘুমালু শহরের ভেতর,
কোন সবুজ চত্বর না, কোন শহরতলীর ভাগাড় না।
সূর্যটা একটা সস্তা ট্রেনের জানালার ওপর ল্যাপ্টানো থাকবে,
চুন দিয়ে ঢাকা কলেরাক্রান্তদের কবর দ্রুত পেরিয়ে যাবে।
তোমার পায়ের গোড়ায় রক্ত থাকবে,
বরফ ঢাকা সীমান্তে ক্লান্ত প্রহরী থাকবে,
একজন পোস্টম্যান খালি ব্যাগসহ গুলি খেয়ে পড়ে গ্যাছে,
একজন পুরোহিত একটা অসহায় হাসিসহ পাঁজরে ঝুলিয়ে রেখেছে
একটা কবরস্থানের নিরবতা,
একটা কমান্ড পোস্টের কোলাহল,
এবং নিহতদের অসাম্পাদিত তালিকা,
সেটা এত লম্বা যে সময় আঁটবে না
সেখান থেকে তোমার নিজের নাম যাচাই করে বের করা।
সারহেই জাদান এই কবিতা লেখেন ২০১৪ সালে, কবিতার বইয়ে অর্ন্তভূক্ত হয়ে প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। জাদান সম্পর্কে উৎসাহি এবং ‘আরো জানতে চাই’ ধরনের ঠেলা প্রথম আমি পাই ২০১৯ সালে ‘পোস্ট সোভিয়েত’ আর্টকালচার ভিত্তিক অনলাইন প্রকাশনা কালভার্ট জার্নালে প্রকাশিত তার একটা সাক্ষাৎকার ভিত্তিক লেখা থেকে। সেখানে জাদানকে ‘ইউক্রেনের সবচে খ্যাতিমান উপন্যাসিক, কবি, স্কা ব্যান্ডের (জ্যামাইকান-ক্যারিবিয়ান পাংক-রক, হিপহপ, মিক্সড জঁনরা) ফ্রন্টম্যান, এবং পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট’ হিসাবে উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হয় ২০১৪ সালের ইউক্রেনিয়ান রেভ্যুলোশনের পর গত পাঁচ বছরে ইউক্রেন এবং তিনি নিজে কতটা পরিবর্তিত হয়েছেন এবং কোন ভাষায় সাহিত্য হচ্ছে, এসব। জাদান তখন বলেন, ২০১৪ থেকে তার লেখায় শুধু যুদ্ধ আসছে, যুদ্ধ বিধ্বস্ত পূর্ব ইউক্রেনের শহর, এরমধ্যে যেভাবে তিনি বেঁচে আছেন, আর এই বেঁচে থাকায় যুদ্ধ তার লেখায় যেভাবে আসে, তা তাকে উদ্বিগ্ন করে রাখে সবসময়।
২০১৪ সালে যে ইউরোময়দান আন্দোলন হয়, যেটা ইউক্রেনিয়ানরা তাদের ‘মর্যাদার আন্দোলন’ মনে করে এই অর্থে যে, তারা পুতিন সমর্থিত ইউক্রেনিয়ান সরকার প্রধান ভিক্টর ইয়ানুকোয়িচের পতন ঘটায়ে পুতিন প্রভাবমুক্ত সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় যেতে পেরেছিল, পুতিনের ইমপিরিয়ালিস্ট ক্ষমতার সম্প্রসারণ ঠেকায়ে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছিল; সেই আন্দোলনে হারকিভ (Kharkiv) থেকে সক্রিয় অংশ নেন সারহেই জাদান। প্রতিপক্ষের পিটুনি খেয়ে হাসপাতালেও থাকতে হয় তাকে ওইসময়। এর আগেও তিনি, ২০০৫য়ে ‘অরেঞ্জ রেভ্যুলশন’য়েও ব্যাপক সক্রিয় ছিলেন।
কিন্তু ২০১৪র প্রক্ষাপটে ইউরোময়দান আন্দোলনই একমাত্র নয়। ওই আন্দোলনের বিজয় যেইদিন আন্দোলনকারীরা দেখে, তার দুই দিন পরই রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রধান ভ্লাদিমির পুতিন ক্রিমিয়া দখলের জন্য সৈন্য পাঠান এবং ১৯৯১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর ইউক্রেন তার সীমানায় প্রথম দখল প্রক্রিয়া দেখতে পায়। ক্রিমিয়া দখল প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যে পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস এলাকার ডনিয়েটস্ক এবং লুহানস্কে রাশানভাষীরা ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আন্দোলন শুরু করে, রাশিয়ার সামরিক শক্তির সহায়তায় যেটা ইউক্রেন সরকারের সাথে যুদ্ধে রূপ নেয়। আট বছর ধরে চলা ডনবাস এলাকায় রাশিয়ার ওপেন সিক্রেট যুদ্ধ চালানো আরো পরিষ্কার হয় চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি, যখন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে লুহানস্ককে লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিক বা এলপিআর এবং ডনিয়েটস্ককে ডনিয়েটস্ক পিপলস রিপাবলিক বা ডিপিআর হিসাবে স্বীকৃতি দেন।
সারহেই জাদান জন্মান পূর্ব ইউক্রেনের এই লুহানস্কে, রাশিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা এক গ্রামে। লুহানস্কের অন্যান্য বাসিন্দার মতো তারও প্রথম ভাষা রাশান, কিন্তু তিনি সাহিত্য করেন ইউক্রেনিয়ান ভাষায়।
২০১৪ সালের অনেক আগেই জাদানের পরিবার লুহানস্ক ছেড়ে হারকিভে চলে আসেন কিন্তু তার নিজ গ্রামের সাথে সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। যুদ্ধের সময় তিনি অনেকবার সেখানে গেছেন, দেখেছেন শহর ছেড়ে আপনজনদের চলে যাওয়া, নিজভূমি থেকে উদ্বাস্তু হওয়া।
২৪ ফেব্রুয়ারি, চলতি বছরে পূর্বাঞ্চলের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল শহর ছাড়ায়ে পুতিনের যুদ্ধ যুখন পুরা ইউক্রেনে ছড়ায় পড়ে, তখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেইসবুকে দেখি প্রবাসি ইউক্রেনিয়ান এবং যুদ্ধ বিরোধী বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ফেইসবুকাররা শেয়ার করছিলেন এই কবিতার ইংরেজি ভার্সন। যেন এই ডিস্টোপিয়ান গল্প জাদান আগেই জানতেন।
জাদানের এই কবিতা Take Only What Is Most Important, নির্বাচিত কবিতা সংকলনের অংশ হিসাবে What We Live For, What We Die For বইয়ে নিবন্ধিত হয়। ইংরেজিতে অনুদিত হয়ে বইটা প্রকাশ পায় ২০১৯ সালে। এই বইয়ের কবিতাগুলায় এক ধরণের অদ্ভুদ অনুভূতি আছে – সাদামাটা, মানে সেনসেশনবিহীন সাধারন, নিত্যদিনকার যাপনের শব্দ আর দৃশ্য, বাক্য-ভাব বেয়ে বেয়ে এক তুমুল সেনসেশনের চক্করে নিয়ে যায় পাঠ শেষে। যেমন চার্লস বুকাওয়াস্কির কবিতা পাঠে কোন কোন পাঠকের এমন হয়। জাদান অনুবাদকও। তিনি বুকাওয়স্কির কবিতাও অনুবাদ করেছেন।
জাদানের কবিতা এবং উপন্যাস ১৭টা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ৫টা উপন্যাস এবং ডজনের ওপর কবিতার বই, একইসঙ্গে প্রচুর ছোটগল্প এবং রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখেছেন এবং লিখে যাচ্ছেন তিনি। তার পাংক রক ‘জাদান অ্যান্ড ডগস ব্যান্ড’ থেকে পাঁচটা অ্যালবাম বের হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর দ্বিতীয় দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি জাদানের কবিতার ওপর ভিত্তি করে একটা গান ‘হাউজেস’ ইউটিউবে প্রকাশ পায়। ইউক্রেনিয়ান জনপ্রিয় হিপ-হপ গ্রুপ টিএনএমকের (TNMK) সাথে তাতার শিল্পী এলভিরা সারিখেলাইল (El’vira Sarikhalil) গানটি গান।’দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ক্রিমিয়ার প্রতিরোধ দিবস’ হিসাবে ২৬ ফেব্রুয়ারিতে গানটা রিলিজ হওয়ার ব্যাপারটা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। লিটহাবের ২ মার্চ সংখ্যায় জাদানের কবিতা ছাপানোর লেখায় এই গান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রতিক্রিয়া উল্লেখ করা হয়। তিনি লিখেন, ‘এই গান ২০১৪র ক্রিমিয়া সম্পর্কে, কিন্তু এখন এটা আর শুধুই ক্রিমিয়া না।’
৪৮ বছর বয়সী জাদান এর মধ্যে অনেক পুরস্কারই পেয়ে গেছেন। বিবিসি বুক’র পুরস্কার ‘অ্যাওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ তার মধ্যে অন্যতম।
এই ঘনঘোর যুদ্ধের মধ্যে সারহেই জাদান তার শহর হারকিভ, যেটা সোভিয়েত সময়ে একটা সময়কাল পর্যন্ত ইউক্রেনের রাজধানী ছিল, যেখানে রাশিয়ার চাপায় দেয়া যুদ্ধের প্রথম দিনই বোমা পড়েছিল, সেই শহরেই আছেন। তার টুইটার এবং ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে ইউক্রেনিয়ান ভাষায় যুদ্ধে শহরের পরিস্থিতি নিয়ে আপডেইট দিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত।
কাভার ফটো: প্যালেস্টাইনের গাজা এবং সিরিয়ার যুদ্ধে বিধ্বস্ত, উদ্বাস্ত শিশুদের করা গ্রাফিতি-স্ট্রিটআর্ট মুরাল। ২০১৫ সালের। Finding place: Street art by displaced youth from Syria and Gaza শিরোনামে অ্যমেরিকার পোর্টল্যান্ডে হওয়া এক্সবিশনের খবর হিসাবে পরিবেশিত খবরে আর্টওয়ার্কটার ফটোগ্রাফের সাথে দেখা। ফটো ক্রেডিট: aptART. খবরের সোর্স: pdxmonthly.com/
সম্পর্কিত সংযোগ:
“Everything changed.” Ukraine’s literary star Serhiy Zhadan on 5 years since Euromaidan’. By Amos, Howard. The Calvert Journal. Feb 20 2019.
“You’ve got to live somewhere you aren’t afraid to die.” Contemporary Ukrainian Poetry From Kharkiv. Literary Hub. March 2 2022.