শামীমা বিনতে রহমান
গাইবান্ধার বাঙ্গালি নদী পার হয়ে গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পাড়ার দিকে যাওয়ার সময়ও এটা বোঝা যায় নাই যে, যে জায়গাটা নিয়ে এত কথা হচ্ছে, ৩ জন লাশ হয়েছেন, সেটা এত বিশাল এক অখন্ড জমি। ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি। এত বিশাল, অখন্ড জমি সরকারের অধীনে দেশের আর কোথাও নাই।
এই বিশাল জমিতে সাঁওতালরা তাদের অধিকার সরকারি কাগজে কলমে ফেরত পাবার দাবিতে আনড় থাকলেও সরকারি পরিকল্পনা জানাচ্ছে, এখানে ইকোপার্ক, ফাইভ স্টার হোটেল, মৎস প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র এবং তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার বহুমূখী প্রকল্পের প্রস্তুতি চলছে। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে “গুড অ্যকুয়াকালচার প্র্যাক্টিসেস” নামে শুরু হওয়া প্রকল্পটির মৎস কর্মকর্তা আকরাম হোসেন জানান, প্রাথমিকভাবে খামারের ভেতরে থাকা ৮ থেকে ১৬ বিঘা বিস্তৃত পুকুর বানিজ্যিকভাবে মাছ চাষের জন্য সংস্কার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “ একটা একটা করে প্রজেক্ট বাড়বে। প্রথমে মাছ চাষ ভালো হলে ফিস ফিড মিল ( মাছের খাবারের জন্য) বসবে, এরপর বসবে ফিস প্রসেসিং (রপ্তানীর জন্য মাছ প্রক্রিয়া করা), এরপর এখানে বসবে ফাইভ স্টার হোটেল। একটা ইকোপার্ক হবে। এবং এরপর বসবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। টোটাল ৬২৩ কোটি টাকার প্রজেক্ট। তবে এর বাইরে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র”।
বাংলাদেশে ১৬টি চিনিকল, যার একটি হলো রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড, যেটির সুগার বা চিনি তৈরির কাঁচামাল ইক্ষু বা আখ উৎপাদিত হয় গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ফার্মে আর সেখানকার বেশিরভাগ আদি বাসিন্দাই সাঁওতাল, বাঙ্গালিও আছে। গত ৬ নভেম্বর সেখানে আখ বীজ লাগানোর জন্য রংপুর সুগারমিল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে পুলিশ, কর্তৃপক্ষ এবং সাঁওতালদের মধ্যে প্রথমে সংঘর্ষ এবং পরে এক পাক্ষিকভাবে আগুন এবং গুলির ঘটনা ঘটে। এতে ৩ জন সাঁওতাল মারা যান এবং আহত হন অসংখ্য। এ ঘটনায় ৩৮ জন সাঁওতালের নাম উল্লেখসহ প্রায় ৪০০ জনকে আসামি করে গোবিন্দগঞ্জ থানায় মামলা করেছে পুলিশ। রংপুর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ২ জন হাতকড়া অবস্থায় চিকিৎসায় ছিলেন, পরে হাইকোর্টের নির্দেশে হাতকড়া খুলে নেয়া হলেও গাইবান্ধা কারাগারের ভেতরে ছিলেন ৩ দিন। কেউ কেউ হাসপাতালের চিকিৎসা না নিয়ে ঘরোয়া চিকিৎসায় ক্ষত সারাচ্ছেন। সাঁওতালরা এই ঘটনার জন্য সরাসরি দায়ি করেছেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ এবং সাপমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাকিল আলম বুলবুলকে।
পদাধিকার বলে প্রকল্পের প্রধান কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের কারিগরি বিভাগের প্রধান ( চিফ টি.এস.) আখতার হোসেন বলেন, “আকরামকে চুক্তিভিত্তিকভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, প্রকল্পটির যাচাই বাছাই (ফিজিবিলিটি) পর্বে। এবং সে-ই এখন পর্যন্ত নিয়োগ প্রাপ্ত একমাত্র ব্যক্তি এই প্রকল্পের। প্রকল্পটির যেহেতু যাচাই বাচাই পর্যায়ে আছে, তাই এখনো নাম চুড়ান্ত হয় নি, তবে শুধুমাত্র মাছের প্রকল্পের নাম চুড়ান্ত হয়েছে, সেটি হলো “গুড অ্যাকুয়াকালচার প্র্যক্টিসেস”। আর ইকো পার্ক, ফাইভ স্টার হোটেল, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এগুলোর যাচাই-বাছাই পর্ব চলছে। এরপর চুড়ান্ত হবে নাম এবং জমা দেয়া হবে প্ল্যানিং কমিশনে”।
চলতি বছরের জুলাই মাসে নিয়োগ পাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন অ্যান্ড ফিশারীজ বিভাগ থেকে ডিগ্রী অর্জনকারী আকরাম হোসেন, “১৮ টা মামলা মাথায় নিয়ে ছাত্রলীগ করা”র বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা উল্লেখ করে বলেন, “ এখন আমাদের লক্ষ্য হলো সাঁওতালদের কাজে যুক্ত করা। তাদের বুঝাচ্ছি, এই খামার তাদের খামার। জমি বড় কথা নয়, খামার রক্ষা করাই বড় কাজ। পুকুর সংস্কারে, ফলজ বাগান, আখের বীজ লাগানো, এখনকার ফসল কাটা, এগুলোতে তাদেরকে ধাপে ধাপে যুক্ত করার কাজ চালাচ্ছি”।
সাহেবগঞ্জ খামারের ভেতরে রংপুর সুগার মিলস লিমিটেডের অফিসে বসে কথা বলতে বলতে তিনি ঘুরে দেখাতে থাকলেন বিভিন্ন একতলা ইটের তৈরি পরিত্যাক্ত ঘর। তিনি বলেন, “ সাঁওতালদের থাকার জায়গার কোন অভাব হবে না। এই ঘরগুলোতে তারা কাজের সময়টাতে থাকবে। যে কয় মাস কাজ করবে, সেই কয় মাস এই বাড়ি গুলোতে থাকবে। এতে করে পরিত্যাক্ত ঘরগুলোরও ব্যবহার হবে। এসব ঘর পড়ে আছে অনেক বছর ধরে”।
৬ নভেম্বর সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে প্রায় আড়াই হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলা এবং গুলির ঘটনার ৬ দিন পর ওখানে গিয়ে দেখা যায় ট্রাক্টর দিয়ে ঘরবাড়ি থাকা জায়গাগুলোকে চাষযোগ্য জমি তৈরি করা হচ্ছে। এরমধ্যে পুড়ে যাওয়া ঘরের খুঁটির নিচের অংশ, খাবার- পোড়া, আধ পোড়া অসংখ্য ঝিনুক পড়ে আছে। ট্রাক্টরের ট্রাকার দিয়ে জমির মধ্যে ভাঁজ ভাঁজ দাগ দেখার পর এখানে কারো ঘর ছিল কি-না ভাবতে কষ্ট হলেও ভিডিও চিত্র খবরের সাথে অভ্যস্থদের মনে পড়তে পারে ফিলিস্তিনের ওয়েস্ট ব্যাংকে জায়গা দখলের জন্য ইসরাইলের বুলডোজার ব্যবহারের কথা। ওইসব ভিডিওচিত্র দেখায়, কীভাবে ইসরাইলের বুলডোজার ফিলিস্তিনের ওয়েস্ট ব্যাংকের ঘরবাড়ি ভাংতে ভাংতে গুড়িয়ে মিশিয়ে দেয় মাটির সাথে আর সাথে সাথে নেয় তার দখল।
পার্শ্ববর্তী আরেক সাঁওতাল গ্রাম মাদারপুরে আশ্রয় নেয়া বিমল সরেন জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ এবং শাকিল আলম বুলবুল মাজার ছুঁয়ে, কোরান ছুঁয়ে আশ্বাস দেয়ার কারনে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ থেকে সাড়ে চার মাস আগে এসে টিন দিয়ে ঘর তোলেন। তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন বাপ-দাদার ভিটে মাটি সরকারি কাগজপত্রে ফেরত পাবেন। এই জন্য তিনি সপ্তাহে ২ শ টাকা করে দিতেন চেয়ারম্যান বুলবুলকে।
মাদারপুর গ্রামের পরিত্যাক্ত স্কুল ঘরে খড় বিছিয়ে তারা থাকছেন অনেকেই। অনেকে থাকছেন গীর্জার সামনে। মাটি গর্ত করে চুলা বানানো হয়েছে। গ্রামের বাইরে দিয়ে পুলিশি পাহারায় চিনি কল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কাটাতারের বেড়া দেয়া হচ্ছিল। গোবিন্দগঞ্জ থানার এস আই আমীর সোহেল জানান, সাঁওতালদের নিরাপত্তার জন্যই কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হচ্ছে। তাদের সন্তানরা যাতে ঠিক মতো স্কুলে যেতে পারে আর কোন হামলা যাতে না হয় সেই জন্যই এই বেড়া।
এই পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থার প্রসঙ্গ তুলতেই, হামলার প্রত্যক্ষদর্শী, যার ঘরবাড়ি পোড়া যায় নি এবং যিনি এই গ্রামেরই বাসিন্দা, সজনি মুরমু বলেন, “ না না, পুলিশেরাই আমাদের গুলি দিছে। আগুন জ্বালায়া দিছে। যখন আগুন লাগে তখন আমি এখানে দাঁড়ায়া দেখতেছিলাম। প্রশাসনের লোকেরা এবং পুলিশ প্রথমে আগুন দেয়, পরে গুলি চালায়। তারপর আবার, আমরা যে লাশগুলা খুঁজবো, ওই লাশগুলা খুঁজতেও আমাদের ওই দিকে যাইতে দেয় নি। আজো পর্যন্ত আমাদের ওইদিকে যাইতে দিচ্ছে না। আপনারা আসছেন বলে ওই যে ওরা যাইতে পারতিছে। নাইলে ওই যে ওখানে পুলিশ আছে, ওরা বাঁশি ফুটায় আর বলে সরে যাও, সরে যাও-এরকম করে”।
গীর্জার সামনে গিয়ে দেখা মেলে ইসাক কিসকুর সাথে, সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ন এবং এই হামলার ঘটনায় নিজের বায়োলজি বক্সের ব্যবহার করে একজন গুলিবিদ্ধ সাঁওতালের বুক থেকে গুলি বের করেছিলেন তিনি, হামলার দিন। দেখালেন গুলি। ৭ দশমিক ৫ মিলিমিটার ব্যাসার্ধের গুলি। পাশে থাকা দিপল সরেন দেখালেন, ছররা গুলির কার্তুজ।
দিপল সরেন বলেন, “ মঙ্গল মার্ডির কথা শুনছিলেন না, ধান ক্ষেতে যার লাশ পাওয়া গিয়েছিল বলে পুলিশ বলেছে, ওই যে খবরে আসছিল। কিন্তু আমরা তো কেউ মঙ্গল মার্ডির লাশ ধানক্ষেতে দেখি নাই। আমরা তার ডেড বডি দেখছি, বুকের মধ্যে লম্বা সেলাই দেওয়া”।
“মঙ্গল মার্ডি আর আমি এক সঙ্গে দাঁড়ায় ছিলাম ওই দিন। বিকাল বেলায় যখন আগুন লাগিয়ে দেয় তখন তিনি দৌড়ায়া আমাদের গ্রামে আসেন। আমরা একসাথে আরো অনেকের সাথে দাঁড়িয়েছিলাম। এরপর তিনি হঠাৎ করে বলেন, উনার বাড়িতে ৩ হাজার টাকা আছে আর জমির কাগজ আছে। উনি ওইগুলি আনতে গেলেন আর এরপর তো লাশের খবর আমরা জানছি ২ দিন পরে, পুলিশের কাছ থেকে”।
দশম শ্রেনীতে পড়া দিপল সরেনের সাথে আরো যারা হামলার ঘটনার বিভিন্ন দিক বর্ননায় অংশ নিচ্ছিলেন, তারা জানালেন, মঙ্গল মার্ডির শরীরে গুলি ছাড়াও আঘাতের চিহ্ণ দেখতে পেয়েছেন।
উত্তরবঙ্গে সাঁওতালরা বেশি ঘন রাজশাহী, রংপুর এবং দিনাজপুর এলাকায়। ২০১৬ সালে দেশের সবখানে যখন উন্নয়ন আর উন্নয়নের কথাবার্তা, সাঁওতালরা আঙ্গুল গুনে গুনে ফেরত যান ব্রিটিশ সময়ে। কারণ ওই সময়কার আইনেই তখনকার পাকিস্তান সরকার তাদের জমি উন্নয়নের জন্য অধিগ্রহণ করে।
সরকারি কাগজপত্র বলছে, পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রামপুর, সাপমারা, মাদারপুর, নারাংগাবাদ, চকরাহিমপুর এলাকার ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে। ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই তারিখে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকার একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেন। আর তাতে লেখা ছিল, “ ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর সম্পত্তি রংপুর সুগার মিলের ইক্ষু ফার্ম করার জন্য দেয়া হলো। উক্ত সম্পত্তিতে ইক্ষু চাষের পরিবর্তে যদি কখনো অন্য ফসল উৎপাদিত হয় তাহলে অধিগ্রহণকৃত ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর সম্পত্তি পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন সরকার বরাবর সারেন্ডার করবে। সরকার উক্ত সম্পত্তি গ্রহণ করে পূর্বের অবস্থায় ফেরত যেতে পারবেন”।