fbpx
সুদ ফ্রী ঋণের ফ‍্যান্টাসি এবং সালমান রুশদীর ফ্রি রেডিও

সুদ ফ্রি ঋণের ফ‍্যান্টাসি এবং সালমান রুশদীর দ‍্যা ফ্রি রেডিও

শামীমা বিনেত রহমান

পোস্টমডার্ন গল্প হিসাবে খ‍্যাতি পাওয়া সালমান রুশদির দ‍্যা ফ্রি রেডিও গল্পে মূলত তিনটা চরিত্র: তরুণ রিকশাঅলা  রামানি, তার থেকে কমপক্ষে বছর দশেকের বড় চোরের বিধবা বউ এবং গল্পটা যিনি বলতেসেন – ন‍্যারেটর, রামানির মৃত বাপ-মার ঘনিষ্ঠ পরিচিত।

সালমান রুশদীর ছোটগল্প দ‍্যা ফ্রি রেডিও পড়ে আমি তখন বর্ণনাকারী চরিত্র, মানে ন‍্যারেটর, সাবেক স্কুল শিক্ষক পরিচয় ছাড়া যার কোন নাম উল্লেখ নাই, তিনি আত্ম পর্যালোচনামূলক বা সেল্ফ রিফ্লেক্টিভভাবে কখনো ‘আমি’, কখনো ‘আমরা’ হিসাবে গল্পটা বলতেসেন, তাকে নিয়ে ভাবসিলাম। এই চরিত্রটা আমাদের আশেপাশের, পাশের ফ্ল‍্যাটের বা পাশের বাড়ির আঙ্কেল চরিত্রের মতো, যিনি তার শ্রেণী এবং সমাজে বিরাজমান নীতি নৈতিকতা অ‍্যাবজর্ব করে সেটা দিয়ে অন‍্যকে দেখেন। গল্পে কয়েকবার তিনি রামানিকে ‘গাধার বাচ্চা’, ‘মোটা মাথা’, ‘গাধা’ এইরকমভাবে বর্ণনা করেন,  আবার চোরের বিধবা বউ এবং রাজনৈতিক মিশনে থাকা হাতে আর্মব‍্যান্ড লাগানো তরুণদের দেখেন চতুর হিসাবে। 

এই ভাবাভাবির মধ‍্যে নিউজ সাইটে আনমনে চোখ যায়, হেডলাইনে দেখি ঢাকার শাহবাগে বাসের পর বাসে নারী পুরুষ এসে থামছেন।

এক টেলিভিশনের লাইভ কাভারেজে শাহবাগে একটা বাসের ভেতর ঢুকে একজন রিপোর্টার ইন্টারভ‍্যু করছেন সিটে বসে থাকা আগতদের। একজন বলেন, তারা সবাই মানিকগঞ্জের জরিনা কলেজ এলাকা থেকে আসছেন। একজন একটা কাগজের মতো আইডিকার্ড দেখান, যেখানে অহিংস গণঅভ‍্যুত্থান বাংলাদেশ নামের একটা দলের নাম লেখা। একজন বল্লেন, ‘আমাদের বলসে ঢাকায় এসে সমাবেশ করে ফিরে যাওয়ার পর সুদ বিহীন ঋণ পাওয়া যাবে ১ লাখ থেকে এক কোটি টাকা। যার ব‍্যবসা যেমন, যার প্রয়োজন যেমন, সেরকম।’

আরেকজন জানান, উনি সমাবেশ টমাবেশের কথা জানেন না। উনি জানেন এইখানে আসলে, উপস্থিত থাকলে সুদ বিহীন ঋণ পাওয়া যাবে। রিপোর্টার জিজ্ঞেস করেন, যারা আসতে বলসেন, তারা কোথায়? তখন একজন একজন করে আলাদা আলাদা ইন্টারভ‍্যুতে বলেন, যে তাদের নিয়ে আসছে, তার নাম জানেন না,তবে  সে আছে পেছনের বাসে। রিপোর্টার কনটাক্ট নাম্বার চাইলে ওরা বলেন, উনি আছেন পিছনের বাসে। তার কোন ফোন নাম্বার নাই।

সংবাদপত্র এবং টিভি মিডিয়া বলছে, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্ণীপুরসহ দেশের বিভিন্ন মফস্বল, গ্রাম অঞ্চল এবং শহরের বস্তিগুলা থেকে তারা আসছেন। ইনারা সবাই বিশ্বাসে ভর করে আসছেন যে শাহবাগে গিয়ে উপস্থিত থাকলে মিনিমাম একলাখ টাকা লোন পাওয়া যাবে, সুদ দেয়া লাগবে না। সুদ ফ্রি ঋণ।  সুদ ফ্রি লোনের আসায় টিভি ফুটেজে দেখা মুখগুলার মধ‍্যে কোন অপরাধবোধ বা খারাপ লাগা ছিল না, য‍্যান এটা ঘটবেই, যার ডাকে আসছেন তারে চেনা না চেনায় কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ এই ঘটনা ঘটবে, অবভিয়াস। 

রিকশাঅলা রামানির কাছেও অবভিয়াস ছিল, সে একটা ফ্রি রেডিও পাবে যদি সে ভ‍্যাসেকটমি করে। একটা ফ্রি রেডিও পাবে ভাইবা-ভাইবা সে সত‍্যি সত‍্যি একটা ইমাজিনেটিভ রেডিও নিয়া ঘোরা শুরু করে এবং তার আশেপাশের লোকজনও ভাবতে শুরু করসিলো রামানি ফ্রি রেডিও পাইতেইসেই।

আমি ভাবতে থাকি, এই রামানির মুখ ক‍্যানো রিফ্লেক্টেড হচ্ছে সুদ ফ্রি ঋণের আশায় শাহবাগে আসা বাসভর্তি নারী-পুরুষের মুখে? 

 দ‍্যা ফ্রি রেডিও গল্পটাতে কোন সময়কাল, স্থানের নাম নাই। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘হিলস লাইক হোয়াইট এলিফ‍্যান্টস’ গল্পে যেমন কনভার্সেশনাল ডায়ালগ বা কথপোকথনে চরিত্রগুলার ব‍্যাকগ্রাউন্ড বোঝা যায়, সেইরকম এই গল্পে বর্ণনাকারীর পর্যবেক্ষণ এবং সেই পর্যবেক্ষণ থেকে তার বোঝাবুঝি-জাত বর্ণনায় বোঝা যায় গল্পের এলাকা ভারতের কোন একটা প্রদেশের মফস্বল, যেখানে রেডিও আকাশবানী শোনা যায়। এলাকায় বটগাছের তলায় আসা স্বাস্থ‍্য মন্ত্রণালয়ের একটা সাদা ক‍্যারাভ‍্যান, স্থানীয় স্বাস্থ‍্য অফিসার এবং তাতে হাতে আর্ম ব‍্যান্ড পরা তরুণ ছেলেদের কার্যক্রমের বর্ণনা বোঝায় সময়টা ১৯৭৫-৭৭ সালের কোন এক সময় যখন ভারতে তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধীর তত্ত্বাবধানে এবং নেতৃত্বে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের অংশ হিসাবে পুরুষদের ভ‍্যাসেকটমি কর্মসূচি মানে পুরুষত্বহীন করার কার্যক্রম চলেছিল। সেই কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারীদের জন‍্য সরকার থেকে উপহার হিসাবে রেডিও দেয়ার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল। সেই সময়টা, রেকর্ডস বলছে, তখন ভারতে, দুই বছরই ছিল জরুরী অবস্থা। 

গল্পটা বলি, গল্পটা এরকম: 

একদম গল্পের শুরুর লাইনটা এমন: “আমরা সবাই জানতাম ওর ভালো কিছু হবে না যতক্ষণ চোরের বিধবা বউ ওর শরীরে, মাংসে তার নখ গেঁথে রাখসিল, কিন্তু ছেলেটা ছিল নির্দোষ, একেবারে একটা গাধার বাচ্চা, এমন লোকজনদের শেখানো যায় না।”

ন‍্যারেটরের বর্ণনায় এই গাধার বাচ্চাই প্রধান চরিত্র, রিকশাঅলা রামানি। বাপ-মা মরে গেছেন, কিন্তু বাপ মরে যাওয়ার আগে তার জন‍্য একটা ব্রান্ড নিউ রিকশা রেখে গেসিলেন, সেই রিকশা রামানি এখন চালায়। গল্প-কথকের বর্ণনায়, তার গালে দাড়ি-মোছ উঠার আগেই সে চোরের বিধবা বউয়ের প্রেমে পড়ে গেছে। এবং তার ধারণা, উপার্জন করে দুই বেলা খাবার যোগাড় করতে পারা সুপুরুষ রামানিকে টার্গেট করে প্রেমে ফেলেছে চোরের বিধবা বউ, যার জন‍্য তার স্বামী একটা কানা কড়িও রেখে যায় নাই, পাঁচটা সন্তান ছাড়া। চোরের বিধবা বউয়েরও কোন নাম নাই এই পরিচয় ছাড়া।

মৃত চোরের বউ সুন্দর এইটা গল্প-কথক অস্বীকার করতে পারেন না, কিন্তু তিনি মানতেই পারেন না রামানির সাথে তার সম্পর্ক। রামানির রিকশায় ভাড়া দিয়ে প্রথম যেদিন মৃত চোরের বউ তার পাঁচ বাচ্চা নিয়ে উঠে, তার মনে হৈসিল এই ভাড়ার টাকাটা চোরের বউয়ের ইনভেস্টমেন্ট রামানির সাথে প্রেম করার। ওই দিনের ঘটনার পরই অবশ‍্য রামানি আর চোরের বিধবা বউকে একসাথে দেখা যায় সবখানে।

সদ‍্য তরুণ বয়সি রামানি যখন রিক্সা চালায়, তার পায়ের কাপ মাসলে, চুলে অনেক নারীই চোখ দেয়। তার সমবয়সিদের কাছ থেকে সে এইসব শুনেছে এবং বিশ্বাস করে আপ্লুত হয়। তার সমবয়সি নতুন যুব আন্দোলনের আর্ম ব‍্যান্ড পরা তরুণরা তাকে বলে শশী কাপুর, অমিতাভ বচ্চন তার তুলনায় কুষ্ঠ রোগি, তার বোম্বে (তখন মুম্বাই ছিল বোম্বে নামে পরিচিত) গিয়ে ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রিতে নাম লেখানো উচিৎ। রামানি বিশ্বাস করে। 

গল্প-কথক আবার এদের পছন্দ করেন না কারণ তিনি খেয়াল করসেন, যুব আন্দোলনের এইসব তরুণরা রামানিকে ফিল্মের হিরো বলে ফুলায়-ফাঁপায় আর তার টাকায় ফ্রি ফ্রি বিয়ার এলকোহল খায় ইরানিয়ান ক‍্যান্টিনের পেছনে। চোরের বিধবা বউও তাকে পাবলিকলি শ্রী কৃষ্ণের মতো সুন্দর বলে আর  ফিল্ম স্টার হওয়ার স্বপ্নে উজ্জীবিত করে।

যেহেতু ন‍্যারেটর/ গল্প-কথক রামানির বাপ-মাকে চিনতেন, তাই তিনি নিজে দায়িত্ব নিলেন চোরের বিধবা বউ’র সাথে কথা বলার। তবে কথা বলার আগে তিনি একটা হিসাব চালান, যে, স্কুল শিক্ষক হওয়ায় সামাজিক ভাবে তার একটা ভালো অবস্থান আছে, আর তার কাছে এসে যদি চোরের বিধবা বউ কথা বলে, তাইলে সেও জানে তার সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ‍্যতা বাড়বে। তিনি নিশ্চিত হন যে তিনি ডাকলে চোরের বউ আসবে।

মৃত চোরের বউ যখন বটতলার দোকানে আসে, তিনি তাকে ডাকেন। সে আসে। তিনি তাকে রামানির সাথে দেখা করতে নিষেধ করেন এবং বিধবা আশ্রমে কোথাও যাইতে বলেন, ওইখানে গিয়া এই প্রার্থনা করতে যে এখন আর বিধবা বলিদান প্রথা নাই। 

চোরের বিধবা বউ তীব্র ক্ষিপ্ত হয়, চিল্লায়া তাকে বলতে থাকে বিষাক্ত বুড়া, আরো আগে তার মরে যাওয়া উচিৎ ছিল; তারপর বলতে থাকে: ‘লেট মি টেল ইয়‍্যু, মিস্টার টিচার সাহিব, রিটায়ার্ড, আপনার রামানি বলসে আমাকে বিয়ে করার কথা, এবং আমি বলি নাই, কারণ আমি আর কোন সন্তান চাই না, এবং সে ইয়াং, তার নিজের বাচ্চা থাকা উচিৎ। সো, এইটা আপনি এখন পুরা দুনিয়ারে বলেন এবং আপনার কোবরা বিষ বন্ধ করেন।’    

এরপর থেকে ন‍্যারেটর রামানির থেকে মনোযোগ উঠায়া নেন। তখন শহরে ঘটতে থাকে নতুন ঘটনা। একটা সাদা ক‍্যারাভ‍্যান আসে বটতলায়, স্থানীয় স্বাস্থ‍্য কর্মকর্তা এবং হাতে আর্ম ব‍্যান্ড পরা রাজনৈতিক দল করা তরুণরা এতে কাজ করতে থাকলো। ওরা জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন‍্য পুরুষদের ভ‍্যাসেকটমি করায়। আর বাচ্চা উৎপাদনের সামর্থ অস্ত্রপচার করে রোধ করার উপহার হিসাবে পুরুষদের দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে একটা ট্রানজিস্টর রেডিও পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন একটা ট্রানজিস্টর রেডিও পাওয়া একটা স্বপ্নের মতো। রামানি একটা রেডিও উপহার হিসাবে পাবে বইলা এইসময় স্বপ্ন দেখতে থাকে। সে বিশ্বাস করতে থাকে, সেই বিশ্বাস এইরকম যে সে ধরেই নেয় সে নিশ্চিতভাবেই এইটা পাইতে যাইতেসে। এই বিশ্বাসের কারণে তাকে তার জীবনের যে কোন সময়ের চাইতে সবচে সুখী দেখায়।

এর কিছুদিন পর, রামানি এবং চোরের বিধবা বউ বিবাহ করে ফেলে। ন‍্যারেটর রামানিকে জিজ্ঞেস করে সে সাদা ক‍্যারাভ‍্যানে গেছে কি-না, রামানি বলে, সে চোরের বিধবা বউকে ভালোবাসে। তখন ন‍্যারেটর তাকে বলে, আরে গাধা, ওই মহিলা তো তোমারে তোমার পুরুষত্ব থেকে বঞ্চিত করসে।

তখন রামানি বলে, ‘ব‍্যাপারটা অতটা খারাপ না। এটা প্রেম করা বা অন‍্য কিছুতে বাধা দেয় না, মাফ করবেন টিচার সাহিব, এরকম কথা বলার জন‍্য। এটা কেবল বাচ্চা হওয়া বন্ধ করে আর মাই উম‍্যেন ডিডন্ট ওয়ান্ট চিলড্রেন অ‍্যানিমোর। সো, সবকিছু হানড্রেড পার্সেন্ট ঠিকঠাক আছে। আর তা ছাড়া এটা তো জাতীয় স্বার্থেও করসি। এবং শিগগ্গিরিই ফ্রি রেডিও আসতেসে।’

উপহার হিসাবে ফ্রি রেডিও দেয়া ততদিনে সরকারের তামাদি প্রতিশ্রুতি, সেইটা বছর খানেক ধরেই বন্ধ হয়ে আছে, কিন্তু রামানি সেইটা জানে না। কারণ রামানিকে তার হাতে আর্ম ব‍্যান্ড পরা নতুন যুব আন্দোলনের বন্ধুরা এইটা বলে নাই। সে বিশ্বাস করতে থাকে ফ্রি রেডিও পাওয়ার কথা। এইরকম একটা জানা তথ‍্য, সবাই জানে আর রামানি জানে না, এই রাগে ক্ষোভে স্কুল শিক্ষক ন‍্যারেটরও সেইটা তারে আর বলেন নাই।

রামানি ঘোরে ডুবে যায়, ভাবে ভ‍্যাসেকটমির উপহার হিসাবে অচিরেই একটা ফ্রি রেডিও পাচ্ছে সে। সে কল্পনা করতে থাকে, সেই রেডিও তার সাথেই আছে। সে শহরের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময়, সবখানে একটা অদৃশ‍্য রেডিও বহন করতে থাকে। সে একটা হাত কানে দিয়ে রেডিও সম্প্রচারের মতো করে কথা বলে। অনেকে প্রায় এরকমভাবে বিশ্বাস করতে থাকে যে রামানি রেডিওটা পাচ্ছেই। আর ন‍্যারেটরের রাগ রামানির রাজনৈতিক কর্মী তরুণ বন্ধুদের উপর যায় না, সব ক্ষুব্দতা গিয়ে পড়ে চোরের বিধবা বউয়ের ওপর। তার মনে হয় রামানিকে বিয়ে করার আগেই সে রামানিকে তার নিজস্বতা থেকে লুটপাট করে ফেলসে। 

এরপর শহরে সাদা ক‍্যারাভ‍্যান আবার ফিরে আসে। রামানি ভাবে সরকারি কর্মকর্তারা তার বাড়ি এসে উপহারের রেডিও দিয়ে যাবে। সেইটা না হওয়ায় সে তিন দিনের মাথায় ক‍্যারাভ‍্যানে যায়। সে এটার ভেতর ঢোকে আর তারপর  উত্তপ্ত বাক‍্য বিনিময় এবং মারপিটের শব্দ আসতে থাকে ক‍্যারাভ‍্যান থেকে। আর্ম ব‍্যান্ড পরা যুব সংগঠনের ছেলেরা, যারা তাকে সিনেমার হিরো বলে ফুলাইতো ফাঁপাইতো, তারাই তাকে ফ্রি রেডিও দাবি করার কারণে মেরে ভ‍্যান থেকে বের করে দেয়। কপালে-মুখে রক্ত নিয়ে রামানি বাইরে আসে।  বাস্তবের মতো, সত‍্যের মতো ইমাজিনেশনের মৃত‍্যু ঘটে রামানির। 

কয়েক দফায় গল্পটা পড়ে মনোলগের মতো ভাবতেসিলাম, রামানি ক‍্যানো বিশ্বাস করসিলো যে সে একটা ফ্রি রেডিও পাবে? বিশ্বাসের প্লাটফরম খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, সত‍্যি-সত‍্যি সরকারের ওইরকম একটা প্রতিশ্রুতি ছিল, কিছু পুরুষ ফ্রি রেডিও পাইসিলোও। আবার সরকারে ছিল এমন একটা রাজনৈতিক দল, যারা অনেক বছর ক্ষমতায় ছিল, উন্নয়নও করসিলো। আর রামানি রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকা কয়েকজনের কাছ থেকে শুনসিলো, অমুক ভাই, তমুক ভাই এরকম ভ‍্যাসেকটমি করাইসিলো এবং ফ্রি রেডিও পাইসে। কিন্তু সে নিজে ওই তথ‍্য যাচাই করে নাই যে এই অফার এখনো আছে, নাকি নাই। জাস্ট বিশ্বাস করে গেছে।

২৪ নভেম্বর দিবাগত রাত এবং ২৫ নভেম্বর সকালে সুদ ফ্রি ঋণের আশায় এত লোকজন শাহবাগে এসে জমা হন, খবর পড়ে, দেখে, আমি ভাবতে থাকি, কীসের টান, কোন বিশ্বাসের ভিত্তি এইখানে? তারা নগদ টাকা পাবেন ফ্রি-ফ্রি, এইরকম কোন আশ্বাস না, তারা ঋণ পাবেন, ঋণ মানে যেই টাকা আবার ফেরত দিয়ে দিতে হবে, সেই ঋণ পাওয়ার সুযোগ এতো লোভনীয় ক‍্যানো? ঋণ কে দেয়? – ব‍্যাংক, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারি এনজিও, মহাজন। এবং এরা কেউ সুদ ফ্রি ঋণ দেয় না। সুতরাং সুদ ফ্রি ঋণ পাওয়া রামানির রেডিও পাওয়ার মতোই একটা আকর্ষনীয় ব‍্যাপার, যেইটা প্রত‍্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিবর্তন আনার সামর্থ তৈরি করে।  কিন্তু সুদ ফ্রি এই ঋণের টাকার যোগান হবে কোত্থেকে? বিভিন্ন মিডিয়ার খবর বলসে, অহিংস গণঅভ‍্যুত্থান বাংলাদেশ এমন কথা তাদের বলসে যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেড় দশকের মেয়াদে যত টাকা বিদেশে পাচার হৈসে, সেই টাকা দেশে ফিরায়া এনে দেয়া হবে। আহ! ইউটোপিয়া! এমন যদি হতো!

আমি ভাবি, এই কল্পনা বাস্তব হওয়ার বিশ্বাসের গ্রাউন্ড তৈরি হৈতে কি এইসব কীওয়ার্ড ভূমিকা রাখসিলো, যেমন: হাসিনার দূর্নীতি, বিদেশে পাচার হওয়া টাকা, বাংলাদেশের পাচার টাকা ফেরাতে সম্মত আইএমএফ ও বিশ্বব‍্যাংক, ঋণ, সুদ, ড. মুহম্মদ ইউনুস . . .? বিভিন্ন মিডিয়ায় ভেসে বেড়াতে বেড়াতে এইসব কীওয়ার্ড কি কোনায় থাকাদের কাছেও পৌঁছে গ‍্যাছে?

জুলাই আন্দোলন দুর্নীতিবাজ ব‍্যবসায়ি, রাজনীতিক, আমলা, পুলিশ, বিচারপতি, সাংবাদিক আরো যা যা আওয়ামী সুবিধাভোগি আছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা, তাদের বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনার যেসব প্রতিশ্রুতি আর তাতে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকেই কি প্লট করসে অহিংস গণঅভ‍্যুত্থান বাংলাদেশ? হাতে আর্ম ব‍্যান্ড পরা রামানির রাজনৈতিক কর্মী বন্ধুদের মতো?

হয়তো।

হয়তো অনেক কিছু, হয়তো রাজধানী শহরে বিশাল এক শোডাউনে করে তলায় পড়ে থাকা থেকে আওয়াজ উঠাইতে চাইসিলেন আওয়াজে না থাকা ফরওয়ার্ড পার্টি কাম অহিংস গণ অভ‍্যুত্থান বাংলাদেশের প্রধান আ.ব.ম মুস্তফা আমীন। সেই জন‍্য তিনি এবং তার দল যাচাই না করে অল্পে বিশ্বাস করে ফেলা মানুষদের চাতুরি করে ঘোরে ফেলসেন। হয়তো তারা উভয়ই তাদের অবস্থান পরিবর্তন হওয়ার ঘোরের ভেতরেই ছিলেন, ২৫ নভেম্বরই হৈতে যাচ্ছিল সেই কল্পনার বাস্তবায়ন। কিন্তু মধ‍্যরাতে পুলিশ এবং বিশ্ববিদ‍্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুই পক্ষের ঘোরে পানি ঢেলে দ‍্যান।

 মানে বাস্তব এসে হাজির হয় ঘোরগ্রস্থদের চোখের সামনে। 

দ‍্যা ফ্রি রেডিও গল্পের শেষ দিকে রামানি তার রাজনৈতিক বন্ধুদের হাতে মাইর খেয়ে ফ্রি রেডিও পাওয়ার ঘোর থেকে বের হয়ে আসলেও সে আরেক ঘোরে ঢুকে পড়ে। রিক্সা বেইচা তার বউ, মানে চোরের বিধবা বউ আর তার পাঁচ সন্তান নিয়া পাড়ি জমায় বোম্বে, হিরো হওয়ার স্বপ্নে। 

গল্পের শেষদিকে এসে গল্প-কথক জানান, কয়েক মাস পর তিনি রামানির কাছ থেকে একটি চিঠি পান। তার অনুমান চিঠিটা একজন পেশাদার চিঠি লেখক দ্বারা লেখা ছিল, কারণ রামানি লিখতে পারে না। তিনি রামানির নতুন জীবনের গল্পে ভরা আরও চিঠি পান। চিঠিগুলা অনুসারে, রিকশা চালকের প্রতিভা উন্মোচিত হয় বোম্বে এবং সে একজন ধনী চলচ্চিত্র তারকার চমৎকার জীবনযাপন করতেসে সেইখানে।

জাদু বাস্তবতা বা ম‍্যাজিক‍্যাল রিয়েলিজমের ট‍্যাগঅলা গ‍্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘ডেথ কনস্ট‍্যান্ট বিয়ন্ড লাভ’য়ের মতো ঘোর এই গল্পে আছে, কিন্তু রামানির ঘোর নেলসন ফারিনার থেকে অন‍্যরকম। নেলসন ফারিনা তার প্রথম স্ত্রী খুন, ড্রাগ ডিলিং, চোরাকারবারি এইসব অপরাধের শাস্তি থেকে মুক্ত হওয়ার জন‍্য অন‍্য নাম নিয়া মানে সরকারিভাবে সিল-সাপ্পরঅলা একটা ফেইক আইডি পাইতে মরিয়া থাকে আর রামানি তার ঘোরের ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে এক আইডেন্টিটি থেকে আরেক আইডেন্টিটি, এক পার্সোনালিটি থেকে আরেক পার্সোনালিটিতে রূপান্তর হৈতে থাকে।

দ‍্যা ফ্রি রেডিও প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে সালমান রুশদীর বই ‘ইস্ট,ওয়েস্ট’য়ে। সংকলনটা প্রকাশ করে জোনাথন কেপ প্রকাশনী।