প্রশান্ত ত্রিপুরা
লিমাতে পরিচয়
লেখার সাথে আমার পরিচয় ২০৬২ সালে। মানে, সেটাতো ভবিষ্যতে! হ্যাঁ, ঠিক তাই, আমরা আজ থেকে উনপঞ্চাশ বছর পরের একটা সময়ের কথা বলছি। আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি স্বপ্নের দুনিয়ায়, যেখানে সবই সম্ভব। কাজেই গল্পটা শুনতে থাকুন। তবে লেখার পরিচয় দেওয়ার আগে আমি নিজের পরিচয়টা একটু দিয়ে নেই।
আমার নাম নখা। নখা ত্রিপুরা। আমি একজন নভোচারী, মঙ্গলগ্রহে আসা যাওয়া করি, তবে বিভিন্ন মিশনের ফাঁকে সুযোগ পেলে আদি-আদিবাসীদের সাথে সময় কাটাই পৃথিবীতে। আদি-আদিবাসী হল তারা, যারা ২০৩২ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আদিবাসী নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু এরপর পৃথিবীতে দুঃসময় নেমে আসে, কারণ অন্য একটা গ্যালাক্সি থেকে আসা একটা প্রজাতি পৃথিবী দখল করে নেয়। তারা হুবহু মানুষের মত দেখতে, সেভাবেই নিজেদের জেনেটিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদেরকে আলাদা করে চেনার একমাত্র উপায় হল তাদের চোখ, যেখানে কখনো খুশির ঝলক বা আশার ঝিলিক দেখা যায় না, যেমনটা মানুষের বেলায় দেখা যায়। মানুষের চেহারায় ঘুরে বেড়ানো এই ভিনগ্রহীদের ডাকা হয় মচোভি নামে, যা হল ‘মড়া চোখের ভিনগ্রহী’ কথার সংক্ষেপ।
রেমাক্রি এলাকায় আদি-আদিবাসী ও আদিবাসী মানুষেরা মিলে যে দুর্গ গড়ে তোলে, সেখানেই আমি বড় হয়েছি। এরকমই আরেকটা দুর্গ রয়েছে সাজেকে, যেখানে আমার থেকে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট লেখার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। তার বাবা মা দু’জনেই ত্রিপুরা পরিচয় দিতেন, তবে তার বাবার মা নাকি পাংখোয়া ছিলেন। লেখার বাবা-মা বেঁচে আছেন, তবে আমার বাবা-মা দু’জনেই মারা যান আমার বয়স যখন নয় বছর, তখন, মচোভিদের ঘাঁটিতে গেরিলা হামলা চালাতে গিয়ে।
শুরুর দিকে মচোভিরা পৃথিবীর প্রধান মহানগরীগুলি দখল করে নেয়। এসব জায়গার মানুষদের শরীর ও মস্তিষ্কের দখল নিয়ে নেওয়া মচোভিদের জন্য খুবই সহজ ছিল খাদ্যাভ্যাস, জীবন যাপন পদ্ধতি, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদির ফলে তাদের বিশেষ কিছু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়াতে। এদিকে, আদিবাসী বলতে ২০৩২-এর আগে যাদের বোঝাত, তাদের অনেকের মধ্যেই এই প্রতিরোধ ক্ষমতাগুলি অটুট ছিল, ফলে মচোভিরা তাদেরকে সহজে কাবু করতে পারে নি। বিষয়টা মঙ্গলগ্রহে থাকা বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করার পর মচোভিদের প্রতিরোধে সক্ষম যেসব আদিবাসী সম্প্রদায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিল, তাদেরকে আদি-আদিবাসী বলার রেওয়াজ চালু হয়। আদি-আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে গড়ে তোলা হয় পৃথিবীতে মচোভিদের প্রতিরোধের প্রধান দুর্গগুলি। তবে মহানগরীগুলিতেও মচোভিদের নজর এড়িয়ে বেশ কিছু মানুষ প্রতিরোধের গোপন দুর্গ গড়ে তুলেছিল, যাদেরকে সাধারণভাবে ‘আদিবাসী’ বলে ডাকা শুরু করে মঙ্গল থেকে মচোভিদের প্রতিহত করতে আসা মানুষেরা।
আমার বাবা ছিলেন বাংলাদেশের তিন্দু নামের একটা জায়গায় জন্মানো আদি-আদিবাসী, জাতিতে ত্রিপুরা, এবং মা ছিলেন চিম্বুক পাহাড়ের কাছে জন্মানো আরেক আদি-আদিবাসী, যার বাবা ছিলেন একজন খুমি, এবং মা ম্রো। আমার জন্ম ২০৩৩ সালে, এবং যখন বোঝা গেল আদি-আদিবাসীদের রয়েছে মচোভিদের প্রতিরোধ করার বিশেষ ক্ষমতা, রেমাক্রি এলাকায় আদি-আদিবাসী ও আদিবাসী মানুষেরা মিলে যে দুর্গ গড়ে তোলে, সেখানেই আমি বড় হয়েছি। এরকমই আরেকটা দুর্গ রয়েছে সাজেকে, যেখানে আমার থেকে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট লেখার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। তার বাবা মা দু’জনেই ত্রিপুরা পরিচয় দিতেন, তবে তার বাবার মা নাকি পাংখোয়া ছিলেন। লেখার বাবা-মা বেঁচে আছেন, তবে আমার বাবা-মা দু’জনেই মারা যান আমার বয়স যখন নয় বছর, তখন, মচোভিদের ঘাঁটিতে গেরিলা হামলা চালাতে গিয়ে।
তাই কারো সাথে কখনই প্রেম বা বিয়ের বন্ধনে জড়াব না, এমনই ছিল আমার পণ। কিন্তু লেখাকে প্রথম দেখার মুহূর্তেই আমার ভেতরে কিভাবে যেন বিরাট ধরনের ওলটপালট হয়ে যায়, এমন একটা অনুভূতি আমার সমগ্র সত্তাকে গ্রাস করে ফেলে যেরকম অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আর কখনো হয় নি।
লেখার কথা আমি আগে কারো কাছে শুনি নি।
আমি আসলে রেমাক্রি ছাড়ার পর ব্যস্ত ছিলাম পৃথিবীর বিভিন্ন আদি-আদিবাসী অধ্যুষিত ও মচোভি-মুক্ত এলাকার দুর্গগুলোতে প্রশিক্ষণ নিতে। ২০৬২ সালে লিমাতে গিয়েছিলাম মচোভিদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযানে নামার জন্য মঙ্গলে প্রশিক্ষণে যাবে, এমন একটা দলে যোগ দিতে। আমাকে মনোনীত করা হয় দলনেতা হিসাবে। আমি জানতাম দলে আদিবাসী ও আদি-আদিবাসী, দুই ধরনের মানুষই থাকবে, তবে কারো নাম পরিচয় জানতাম না আগে। লিমাতে গিয়ে দলের সবার মত লেখার সাথেও পরিচয় হল। কিন্তু তার সাথে সাক্ষাত ছিল আমার জন্য একটা বিশাল ধাক্কা, যার জন্য মোটেও আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
আগে আমার জীবনের ব্রত ছিল একটাই, পৃথিবীকে মচোভিমুক্ত করা। আর তা করার জন্য পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে, বা দূর কোন গ্রহে, যখন যেখানে দরকার, ছুটে যেতে সদা প্রস্তুত ছিলাম আমি। তাই কারো সাথে কখনই প্রেম বা বিয়ের বন্ধনে জড়াব না, এমনই ছিল আমার পণ। কিন্তু লেখাকে প্রথম দেখার মুহূর্তেই আমার ভেতরে কিভাবে যেন বিরাট ধরনের ওলটপালট হয়ে যায়, এমন একটা অনুভূতি আমার সমগ্র সত্তাকে গ্রাস করে ফেলে যেরকম অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আর কখনো হয় নি। লেখা যে একজন ত্রিপুরা মেয়ে, সেটা তখনো আমার জানা ছিল না। কাজেই সেও ত্রিপুরা, আমিও ত্রিপুরা – এমন কোন চিন্তা থেকে তার প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষণ বা আগ্রহ জন্মেছিল, বিষয়টা এরকম কিছু ছিল না। বরং দেখার মুহূর্তেই যে অনুভূতি হয়েছিল, তা ঠিক ভাষায় বোঝানো যায় না। লেখাকে দেখার মুহূর্ত থেকেই আমার মনে হতে থাকে তার সাথে আমার বুঝি জন্ম জন্মান্তরের পরিচয়। লিমাতে আমাদের দেখা হবে, আমরা একসাথে মঙ্গলে যাব, এ বুঝিবা ছিল নিয়তির লিখন। যে ধরনের কথা আমাদের পূর্বসূরীদের অনেকে বলত বলে শুনেছি, পড়েছি।
যাহোক, লেখার প্রতি আমার প্রথম-দর্শনে-প্রেম ব্যাপারটা দলের প্রধান প্রস্তুতি-উপদেষ্টা মার্শা !কিং র নজর এড়াল না (ডঃ !কিং-এর আদি নিবাস ছিল কালাহারি এলাকায়, জাতিতে !কুং সান; ‘!’ অক্ষরটা ওদের ভাষার একটা ধ্বনি।)। তিনি একদিন প্রশিক্ষণের ফাঁকে আমাকে ডেকে ককবরকে বললেন (ভাষাটা তিনি শিখেছিলেন ত্রিপুরার জম্পুই পাহাড়ের দুর্গে এক বছর থাকার সময়), ‘আমি তোমার মনের কথা বুঝি। কিন্তু মনে রেখো, মিশনটা ঠিকমত শেষ করাই বড় কথা।’
আমিও জানতাম, তাই মুখ ফুটে কিছু বলি নি কখনো। এভাবে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। অবসরে আমরা গল্প করি। ‘উই-সুকুই’ খেলি (ত্রিপুরাদের সুকুই খেলার Wii-সংস্করণ, যেটা সবার নিয়মিত ব্যায়াম অনুশীলনের অংশ।) এভাবে প্রশিক্ষণ চলার তেরদিনের মাথায় লেখা হঠাৎ একদিন লানচের সময় আমাকে বলে বসে, ‘তুমি কি আমাকে ভালবাস? আমাকে পেতে চাও? আমাকে পাবে এক শর্তে। তোমাকে আগে নিশ্চিত করতে হবে, তোমার বাবা-মা, তাদের বাবা-মা, সবাই আমাকে ভালবাসবে। এই নাও একটা চিঠি। এখানে সব লেখা আছে।’
প্রথম চিঠি, আমার ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন
‘নখা, তোমার সাথে প্রথম দেখার মুহূর্তেই আমি বুঝেছিলাম, তুমি যেমন মনের গভীরে ঠিক আমাকেই খুঁজছিলে, আমিও…।’ এটুকু পড়ার পর হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি নিজেকে আবিস্কার করি হোস্টেলে, চেয়ারে বসা অবস্থায় পড়ার টেবিলে ভাঁজ করা দু’হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হোস্টেল মানে মার্টিন হল, নটরডেম কলেজের ছাত্রাবাস।
তিনি খুব আকর্ষণীয়ভাবে, আবেগের সাথে, পড়ান কলম্বাসের তথাকথিত আমেরিকা আবিস্কারের পর কিভাবে ইউরোপীয়রা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন কিভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার জীববৈচিত্র্য পাল্টাতে শুরু করে, আদিবাসীদের লোকজ জ্ঞান জড়ো করে ইউরোপের বিজ্ঞানীরা কিভাবে নিজেদের ‘আবিস্কার’ বলে চালাতে শুরু করে – এরকম অনেক বিষয়।
সেখানে আমি থাকি আরো দু’জন বন্ধুর সাথে – একজন মধুপুরের চুনিয়া গ্রামের তুরা ম্রি, আরেকজন রাজশাহীর কাঁকনহাটার ইরা হেমব্রম। আমার সামনে খোলা ল্যাপটপ। ‘বিজ্ঞান ও ইতিহাস’ কোর্সের একটা এসাইনমেন্ট নিয়ে কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কোর্সটা পড়ান আনা টপ্পো, আমাকে খুবই স্নেহ করেন। তিনি খুব আকর্ষণীয়ভাবে, আবেগের সাথে, পড়ান কলম্বাসের তথাকথিত আমেরিকা আবিস্কারের পর কিভাবে ইউরোপীয়রা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন কিভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার জীববৈচিত্র্য পাল্টাতে শুরু করে, আদিবাসীদের লোকজ জ্ঞান জড়ো করে ইউরোপের বিজ্ঞানীরা কিভাবে নিজেদের ‘আবিস্কার’ বলে চালাতে শুরু করে – এরকম অনেক বিষয়।
তিনি একটা এসাইনমেন্ট দিয়েছেন, “আগামী দুই বছরে, অর্থাৎ ২০২০ সাল নাগাদ, পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। ধরা যাক, এই বিপুল জনসংখ্যার মধ্যে গড়ে প্রতি পরিবারের একটি গাড়ি, একটি ফ্ল্যাট, একটি টিভি…অর্থাৎ শাপলা চত্ত্বরের কাছে গিয়ে রাস্তায় ঝটিকা জরিপ চালিয়ে ‘উন্নত’ জীবনযাত্রা সম্পর্কে পথচারীদের যে গড়পরতা ধারণাগুলো তোমরা নিয়ে এসেছ, তার সবই। এই পৃথিবী কি এমন জীবনযাত্রার ভার সইতে পারবে? সেদিন থানচি থেকে আসা ম্রো জুমিয়া দম্পতি সেমিনারে যে কথাগুলো বলেছিলেন, তাঁদের কথা, ক্লাসের পড়া, এবং কলেজের ই-লাইব্রেরি ঘেঁটে পাওয়া তথ্য – এগুলো মিলিয়ে একটা পেপার লিখে নিয়ে আসবে ৫০০০ শব্দের মধ্যে।” এই এসাইনমেন্টের উপরই কাজ করছিলাম, এবং ফাঁকে লেখার সাথে কথা বলছিলাম ফেসবুকে। ওর বাড়ি সাজেক। আমার সমবয়সী। খুবই মেধাবী। এখন পড়াশুনা করছে বেইজিং-এর একটা কলেজে, যেটাতে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকেই পড়তে আসে মাধ্যমিক শেষ করেই। ওর ইচ্ছা মঙ্গলগ্রহ-ভিত্তিক যে ‘স্পেস বায়োলজি ল্যাব’ চালু হওয়ার কথা ২০৩০ সাল নাগাদ, সেখানে যোগ দেওয়া। তো, ঘুম থেকে উঠে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে দেখি, ফেসবুকে একটা মেসেজ নূতন এসেছে, পাঠিয়েছে লেখা। সে লিখেছে, ‘ই-মেইলে একটা চিঠি পাঠিয়েছি। পড়ে দেখো। খুব জরুরী।’ আমি দেরি না করে ইমেইল খুলে পড়তে শুরু করলাম লেখার পাঠানো চিঠি।
তুমি প্রত্যেকটা কথা খুব মন দিয়ে পড়বে, এবং এই মেইল পড়া হলেই মুছে ফেলবে। ঘটনা হল, . . .একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে দূর গ্যালাক্সি থেকে মচোভিরা প্রথমে এসেছিল অণুজীবের আকারে, তারপর কিভাবে যেন অনেক মানুষের শরীর ও মনের দখল নিয়ে নেয়, এবং আস্তে আস্তে তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় চিঠি, ভালবাসার মন্ত্র
‘প্রিয় নখা, তোমার সাথে আমার ঠিকই দেখা হয়েছিল লিমায়। চমকে উঠলে? আমি জানি বিষয়টা বোঝানো এবং বিশ্বাস করানো কঠিন। কিন্তু আজ তোমাকে এমন আরো কিছু বিষয় বলব, যেগুলো আরো অবিশ্বাস্য। আমার তাড়া আছে, তাই খুব সংক্ষেপে বলছি। বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি। তুমি প্রত্যেকটা কথা খুব মন দিয়ে পড়বে, এবং এই মেইল পড়া হলেই মুছে ফেলবে। ঘটনা হল, মচোভিরা আমাদের আশেপাশেই ঘুরছে। তারা কয়েকশ বছর হল – কেউ বলে তিন বা পাঁচ হাজার বছর আগে থেকেই – পৃথিবীতে নিজেদের বিস্তার করে চলছে। মঙ্গলের বিজ্ঞানীরা ঠিক নিশ্চিত নন কিভাবে এটা ঘটেছে। তবে তারা একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে দূর গ্যালাক্সি থেকে মচোভিরা প্রথমে এসেছিল অণুজীবের আকারে, তারপর কিভাবে যেন অনেক মানুষের শরীর ও মনের দখল নিয়ে নেয়, এবং আস্তে আস্তে তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, মচোভিদের কারণেই রাষ্ট্র ও বাজার ব্যবস্থার এত দ্রুত বিস্তার ঘটেছে মানুষের ইতিহাসে। তাছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ধর্ম, সব প্রতিষ্ঠানেই মচোভিরা বিশ্ব জুড়ে তাদের প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। মচোভিরা মানুষের শরীর মনের দখল নিয়ে নেয় অভিনব পন্থায়। নির্দিষ্ট কিছু প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস বহন করে তাদের জেনেটিক কোড। জীবাণুগুলোর মধ্যে আছে ‘ই কলো’ নামের একটা ব্যাকটেরিয়া, এবং ‘রেসেক্লাও’ পরিবারের বেশ কিছু ভাইরাস। তিন থেকে দশ বছর বয়সের শিশুদের মস্তিস্কে তারা ঢুকে পড়ে, তবে সুপ্ত অবস্থায় থাকে বহু বছর।
একটা জিনিস মনে রেখো, বাইরের চেহারা দেখে মচোভিদের চেনা যায় না। বাইরের পরিচয়ে তারা পাহাড়ি, বাঙালি, চাকমা, বড়ুয়া, মুসলমান, খ্রিস্টান যে কোনো কিছু হতে পারে, কিন্তু তারা মানুষ না মচোভি, তা বুঝতে হলে তাদের চোখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখতে হবে।
পূর্ণবয়স্ক মানুষ যারা মচোভিতে পরিণত হয়েছে, তাদের সংস্পর্শ থেকে জীবাণুগুলো ছড়ায়। মচোভিরা বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে, যেমন বইয়ের মধ্যে জীবাণুগুলো ঢুকিয়ে দেয়, বা দূর নিয়ন্ত্রিত চৌম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে বাতাসে ভেসে বেড়ানো জীবাণুদের সক্রিয় করে ধূলাবালির সাথে শিশুদের শরীরে প্রবেশ করায়। …আমার হাতে সময় কম, কিন্তু যে কারণে তোমাকে লেখা, সেটা হল, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাতেও সম্প্রতি মচোভিদের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। তারা কয়েকটা দুর্গের দখল নিয়ে ফেলেছে। দেশের অন্যান্য প্রান্তে এবং পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায়ও এটা হচ্ছে। কিন্তু মচোভিদের এই সম্প্রসারণ যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে। খুশির খবর হল, পাহাড়ি এলাকায় সহজলভ্য কিছু গাছের শেকড়ের রস থেকে বানানো একটা ঔষধ আবিস্কার করা হয়েছে, যা নিয়মিত সেবন করলে শিশুদের মস্তিষ্ক থেকে মচোভিবাহী ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসগুলো সম্পূর্ণ দূর করা যায়। তবে চ্যালেঞ্জ হল, এক নাগাড়ে বেশ কয়েকবছর নিয়মিত সেবন করাতে হবে এই ঔষধ। তা করার জন্য আমাদের দরকার অনেক স্বেচ্ছাসেবী, যারা বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিক্ষকের ভূমিকায় কাজ করবে। মচোভিদের নজরদারি এড়িয়ে এটা করতে হবে, কারণ তারা অনেক জায়গাতেই মচোভি হয়ে যাওয়া মানুষদেরই স্কুলের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে। একটা জিনিস মনে রেখো, বাইরের চেহারা দেখে মচোভিদের চেনা যায় না। বাইরের পরিচয়ে তারা পাহাড়ি, বাঙালি, চাকমা, বড়ুয়া, মুসলমান, খ্রিস্টান যে কোনো কিছু হতে পারে, কিন্তু তারা মানুষ না মচোভি, তা বুঝতে হলে তাদের চোখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখতে হবে। যাহোক, আরেকটা কথা, শিশুদেরকে প্রতিষেধক ওষুধ খাওয়ানোর পাশাপাশি একটা মন্ত্র পড়াতে হবে।
শিশুদের শেখাতে হবে গভীর বিশ্বাসের সাথে, মনপ্রাণ দিয়ে, প্রতিদিন ওষুধ খাওয়ার সময় মন্ত্রটা উচ্চারণ করতে। মন্ত্র উচ্চারণের সময় যে শিশুদের চোখে আলোর ঝিলিক দেখবে, বুঝে নেবে তাদের মধ্যে মচোভির জীবাণু তেমন ছড়িয়ে পড়েনি। আর ভাল কথা, সকল শিশুকেই আমাদের সারিয়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। কে পাহাড়ি, কে বাঙালি, কে আদিবাসী, কে আদি-আদিবাসী – এসব বাছবিচার করে একদমই সময় নষ্ট করা যাবে না। যাহোক, এবার মন্ত্রটা মনোযোগ দিয়ে পড়, যাতে ভুলে না যাও। পড়: “আমি লেখাকে ভালবাসি”…।
তোমার কাছে এটা আমার শেষ চিঠি। কিছু শব্দ বলে দিয়ে যাচ্ছি, সেগুলো কাজ করবে আগামীতে যাওয়ার চাবি, পোর্টালের পাসওয়ার্ড হিসাবে। প্রথম চাবি কি জান?
শেষ চিঠি, আগামীর পাসওয়ার্ড
…এই পর্যায়ে আমি সত্যিই জেগে উঠি।
আমি বুঝতে পারি, এতক্ষণ আসলে স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিলাম আমি। খুশি হলাম সেটা বুঝতে পেরে। “আমি লেখাকে ভালবাসি” – কথাগুলো পড়ার সময় আমি স্বপ্নের মধ্যেই চিৎকার করে উঠেছিলাম, কারণ লেখাকে অন্য কেউ চাইবে, লেখা অন্য কারো হবে, আমার মন সেটা মানতে পারছিল না। বড়পাড়া গ্রামে যে বাসায় আমি উঠেছি, সেখানে আমার সোলার পাওয়ারে চলা ল্যাপটপ খুলে লেখার ছবি দেখে নিলাম একবার। লেখার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল রাঙামাটিতে, টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। ও সাজেকের মেয়ে। অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশুনা শেষ করে ঠিক করেছে, নিজের এলাকায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হবে। আমার একসময় পরিকল্পনা ছিল ইঞ্জিনিয়ার হব, সেভাবেই পড়াশুনা করছিলাম খুলনায়, কিন্তু মাঝখানে অনেক কিছু ঘটে যায়…একসময় আমি ঠিক করি আমি বড়পারা গ্রামে শিক্ষকতা করব। সে সূত্রেই টিচার্স ট্রেনিং কলেজে যাওয়া প্রশিক্ষণের জন্য, যেখানে আমার দেখা লেখার সাথে। প্রথম দেখাতে প্রেম যাকে বলে…কিন্তু আমরা ঠিক করেছি, বিয়ে এখন আমরা করব না। আমরা একে অপরের কাছে চিঠি লিখি নিয়মিত। হাতে লেখা পুরানো রীতির চিঠি। আমি আজকে আসা চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলাম, পড়তে গিয়ে চমকে উঠলাম আবার! লেখা লিখেছে:
‘ই কলো’কে মনে রাখবে ইউরোপিয়ান কলোনিয়ালিজম হিসেবে। আর ‘রেসেক্লাও’কে মনে রাখবে ‘রেসিজম, সেক্সিজম, ক্লাস ডমিনেশন ও আদার ডিজিজেস’ হিসেবে।
নখা,
তোমার কাছে এটা আমার শেষ চিঠি। কিছু শব্দ বলে দিয়ে যাচ্ছি, সেগুলো কাজ করবে আগামীতে যাওয়ার চাবি, পোর্টালের পাসওয়ার্ড হিসাবে। প্রথম চাবি কি জান? ককবরকে ‘লেখা’ শব্দের অর্থ। ভেবে নাও, তারপর পোর্টালে যখন যে ভাষায় প্রশ্ন ভেসে উঠবে, সে ভাষায় শব্দটা উচ্চারণ করবে। আর যে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস পরিবারের নাম বলেছি, সেগুলো দিয়েও বানানো হয়েছে পাসওয়ার্ড, যেগুলো মনে রাখতে হবে। ভবিষ্যতের কিছু অস্ত্র চালনায় এগুলোর দরকার হবে।
‘ই কলো’কে মনে রাখবে ইউরোপিয়ান কলোনিয়ালিজম হিসেবে। আর ‘রেসেক্লাও’কে মনে রাখবে ‘রেসিজম, সেক্সিজম, ক্লাস ডমিনেশন ও আদার ডিজিজেস’ হিসেবে। আর যেসব গাছের শেকড় নিয়মিত সেবনের কথা বলছিলাম, সেগুলির কিছু নমুনা রাখা আছে রেমাক্রি ও সাজেকের কিছু গ্রামে। সেগুলো খুঁজে নেবে। গাছগুলোর গায়ে লেখা আছে কিছু শব্দ – সমতা, মানবতা, সহভাগিতা (সমাস) ও প্রকৃতির জন্য ভালবাসা (প্রভা)। সমাস আর প্রভা, এই দুইটি শব্দ মনে গেঁথে নাও, যাতে সংকেতগুলো ভুলে না যাও।
এবার আমার শেখানো পুরো মন্ত্রটাও মনে গেঁথে নাও ভাল করে: “আমি লেখাকে ভালবাসি। আমি ভালবাসি স্বপ্ন দেখতে। আমি লেখাকে চাই। আমি স্বপ্নের কাছে যেতে চাই।” মন্ত্রটা যেন কোনভাবেই ভুলে না যাও। এগুলো যে শিশুরা গভীর আস্থায় উচ্চারণ করবে, তারা আগামীর পোর্টাল পার হতে পারবে। দেখা হবে লিমাতে, ২০৬২ সালে।