fbpx

বাঁশখালী হত্যাকাণ্ডের ১ মাস

কারা গুলি করেছে, কীভাবে গুলি করেছে?

শামীমা বিনতে রহমান

ঠিক ১ মাস আগে, গত ৪ এপ্রিল, দেশের দক্ষিণ-পূর্বে , বঙ্গোপসাগরের পাড় ঘেঁষা গণ্ডামারা গ্রামে ৪ বাসিন্দা খুন হন ‘পুলিশ’ অথবা ‘পুলিশ এবং এস আলমের লোক’র গুলিতে। গণ্ডামারা আর বড়ঘোনা চট্টগ্রামের বাঁশখালি উপজেলার শেষ দুই গ্রাম, যার পর পরই সমুদ্র, আর এখানেই শুরু হয়েছে এখন পর্যন্ত বেসরকারি উদ্যোগে দেশের সবচে বড় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ। ১ হাজার ২শ ২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এখানে ২০১৯ সালের দিকে।

এই খুন ঘটনার খবর এবং পরবর্তী ফলোআপ খবর গণমাধ্যমে এসেছে ‘সংঘর্ষ’, ‘পাল্টাপাল্টি সমাবেশ’, ‘পুলিশের ওপর হামলা’, ‘১৪৪ ধারা ভঙ্গ’ ইত্যাদি শব্দসহ।এই খবর পরিবেশনে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) মো. হাবিবুর রহমানের বক্তব্য থেকে। তার বক্তব্যই গুলির প্রেক্ষাপট এবং কারণ বোঝার জন্য পাঠক-দর্শকের কাছে প্রধানতম উৎস ছিল।গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী, গুলিবিদ্ধ সাধারণ মানুষের স্বর অন্যতম তথ্যসূত্র ছিল না। প্রথম আলো পত্রিকায় ৪ এপ্রিল, ঘটনার দিন প্রকাশিত খবরে তাকে উদ্ধৃত করা অংশটুকু ছিল এরকম:

‘বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে গ্রামবাসী পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডাকলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এরপর পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশের গাড়িবহর আটকে দেয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধীপক্ষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোড়ে। দুই পক্ষের সংঘর্ষে ব্যাপক গুলিবিনিময় হয়। এ ঘটনায় তিনজনের মৃত্যুর খবর শুনেছি।’

সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালি উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নে হাদীর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ যেটি ‘বসত ভিটা, কবরস্থান রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’র আয়োজনে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রতিবাদে সমাবেশ স্থল ছিল এবং গুলি চলে-সেই স্থান, এস আলমের প্রকল্প কার্যালয় ও সাইট অফিস এবং গ্রাম ঘুরে জানা গেছে কী ভাবে, কোন অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন এলাকাবাসী। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, তারা কাদের গুলি করতে দেখেছেন।

এই ভিডিও চিত্রগুলা যখন ধারণ করা হয়, তখন আহতরা কেউ ২০ দিন, কেউ ১৮ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ফেরত এসেছেন। ঘটনার ভয়ঙ্করতা তাদের বিহবল করে রেখেছিল তখনো। গুলি-ঘটনার অভিজ্ঞতা বর্ননা করছিলেন যতটা ক্ষোভ থেকে, তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্ময় থেকে। এরকম ঘটনা তারা বেশিরভাগই জীবনে প্রথমবারই অভিজ্ঞতা করলেন।

যেমন পূর্ব গণ্ডামারা গ্রামের কুলসুমা বেগম। চার এপ্রিল গোলাগুলির সময় তিনি তার বাড়িতেই ছিলেন, শব্দ শুনে ৭ বছরের বাচ্চা নিয়ে ঘরের ভেতর দরজা পার হয়ে ঢুকে পড়েছিলেন। কিন্তু ‘পুলিশ’ এসে দরজার ভেতর ঢুকে তাকে গুলি করে। তিনি বলেন ‘সিনা’য় গুলি করেছে। সিনা দেখাতে গিয়ে তিনি দেখান, ব্লাউজের কাপড়ের ভেতরে, স্তনের ওপর গুলি। একটা ছোট্ট গর্ত। গর্ত দেখে মনে হয়েছে রাবার বুলেটের ক্ষত। স্তনে গুলি খাওয়ার পর ওখানে হাত দিতেই হাতেও গুলি খান কুলসুমা।

গণ্ডামারা, বড়ঘোনা গ্রাম দুটি এইরকম। সেখানে মানুষ ভাব প্রকাশ করেন এমনভাবে যেন অর্ধেক কথা উচ্চারণ করলে, বাকী অর্ধেক কথা ভঙ্গীতেই বোঝা সম্ভব। আবার কোন কোন শব্দ তারা উচ্চারণ করেন না। যেমন কুলসুমা সিনায় গুলি লাগা বলতে ঠিক কী বোজাচ্ছিলেন কোন মতেই বোঝা সম্ভব হয় নাই, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি গুলির ক্ষত স্থান দেখান নাই।

আহত মুজিবর রহমান যখন ফেরত আসলেন হাসপাতাল থেকে, তখন রীতিমতো তাকে দেখতে আসা মানুষের ভীড় জমে গেছে। প্রতিবাদ সমাবেশস্থল স্কুল মাঠের পাশেই তার বাড়ি, কিন্তু তিনি গুলিবিদ্ধ হন স্কুল মাঠ থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে, লবন মাঠে। কাজ করার সময়। তার থুতনি দিয়ে গুলি ঢুকে আরেক পাশের চোয়াল দিয়ে বের হয়ে গেছে।

ওই দিন গুলিতে খুন হওয়া আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী কোহিনুর আক্তার জানান, তার স্বামী বা তিনি তারা কেউই, কোনভাবেই জানতেন না যে সমাবেশ স্থলে একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি ছিল।

প্রত্যক্ষদর্শী নুর ইসলাম দেখান মাটির ঘরের ভেতর রক্ত এবং গুলির দাগ। তার বিশ্বাস, পুলিশ এরকম বেধড়ক গুলি চালাতে পারে না সাধারণ মানুষের ওপর। ‘এস আলমের গুন্ডারা’ই গুলি চালিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। সেদিন তিনি অনেক পুলিশ দেখেছেন। প্রশ্ন করেন “বাঁশখালী থানায় এত পুলিশ আছে নাকি?”

হাতেগোনা স্কুল এবং প্রচুর নুরানী মাদ্রাসা বিস্তৃত এ এলাকায় ২০১৩ সালের অক্টোবরে দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জমি কেনা শুরু করে সেখানে। এই প্রকল্পে অর্থ সহায়তায় চীন দেশের দুটি প্রতিষ্ঠান যুক্ত আছে এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেনার জন্য এস আলম গ্রুপের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে।
৪ এপ্রিল গুলিতে খুন হন মর্তুজা আলী, আনোয়ার হোসেন, জাকের হোসেন ও জাকির আহমেদ।