পর্ব ১: “ওই ড্রাগ করতাম সারাক্ষণ। ওই সারারাত একটু খাইতেসি, একটু লিখতেসি . . . হি হি হি . . .
অনেক কেউ কেউ কাজল শাহনেওয়াজের গল্প-কবিতা পড়েন না, আবার অনেক কেউ কেউ যারা পড়েন, তারা এরকমও মনে করেন, তিনি তার সময়ের গল্প ভবিষ্যতের পাঠকদের বলতেসেন। মানে তার গল্প বলার ভঙ্গি, শব্দ, শব্দ-শব্দ-বাক্য/ফ্রেইজ, আস্ত এক প্যারাগ্রাফকে একটা বাক্য বানায়ে ফেলা বা গল্প বলার টানা বাক্যের মধ্যে একটা গাড়ির বিজ্ঞাপন অথবা একটা লিস্টের ইনসার্ট, পাঠ-অভিজ্ঞতাকে লিনিয়ার, সেন্ট্রিজম, বাইনারির বাইরে একটা ইনবিটিউন, একটা থার্ড স্পেসে নিয়ে যায়। থার্ড স্পেসের নতুন-নতুনের কনফ্লিক্ট আর মেটামরফসিসের প্রক্রিয়া হয়তো কাউর কাউর পড়ার কৌতুহলে গতির গিয়ার এক্সিলারেট করে না, তাহাদের নয়, যাহাদের হয়, তারা দেখতে পাবেন এই ভিজ্যুয়াল বক্সে কাজল শাহনেওয়াজের গল্পের ফর্ম, কনটেন্ট আর ন্যারেটিভ স্টাইলের পেছনের ল্যাবরিন্থ – কখনো ইউফোরিক, কখনো “বাসেত চরিতনামা”।
আড্ডা বেশিরভাগ সময়ই এক প্রশ্নের উত্তরে অন্য অনেক কই-কই জানি ঝিলিমিলি প্রসঙ্গে ঢুকে গেছে। তাৎক্ষণিক মগ্নতায় খেই হারায়া যাওয়া মনে হৈতে পারে, সেই খেই আবার কখনো কখনো সাংবাদিক সুলভ ইন্টারভ্যু টোনে ধাক্কা খাইসে। এইটা পুরা আড্ডাও না, আবার ইন্টারভ্যুও না, এইটা একটা ফর্মাল-ইনফর্মাল -মিক্সড কথপোকথন, তবে আড্ডার টোনটাই বেশি।
কাজল শাহনেওয়াজের সাথে শামীমা বিনতে রহমানের একটা ফর্মাল-ইনফর্মাল মিক্সড আড্ডা 🙂
সময়কাল ২০২৩’র শেষ ভাগ থেকে ২০২৪’র শুরুর ভাগ।
তিন পর্বের ধারাবাহিক এই জুম ভিডিও আড্ডা ধারণ করা হয়েছিল কয়েকদিনে বিভিন্ন দফায়। তাই আমরা সচেতনে পোশাকের কন্টিনিয়্যুশন ঠিক রাখলেও আমার বাঁধা চুল খোলা হয়ে যায় এক আড্ডায় আর তখন কাজল শাহনেওয়াজ ওরফে কাজলভাইর খোলা মাথা প্রটেক্টিভ ঢাকনা বা ক্যাপে ঢেকে যায়। সেইটা তিন নাম্বার পর্বে। দুই নাম্বার পর্বে তার দুই গল্প সঙ্কলনের গল্পগুলার কনটেক্সট, ব্যাকগ্রাউন্ড, লেখার পদ্ধতি আর শে উপন্যােসের ডিটেইল আর ফেমিনিজম নিয়া গিঁটাগিঁটি, এবং আরো কিছু। আর সময় আর ড্রাগ তো আছেই।
প্রথম পর্ব, মানে এই পর্বটা কাজল শাহনেওয়াজের লেখক সেল্ফ তৈরি হওয়া, সেইটার গ্রাউন্ড গত শতকের এইটিজ, নাইনটিজ, তার লেখক সঙ্গ, বিপ্লবী কাম ব্যর্থ বিপ্লবীদের সঙ্গ, ড্রাগের ভেতর ঢোকা, প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে অটোনোমাস জোন তৈরি করা, বিবাহিত নারীর সঙ্গে প্রেম, তসলিমা নাসরিনের নিষিদ্ধ এম আর (ম্যানস্ট্রুয়াল রেগুলেশন) করার টাকায় বিরিয়ানি খেয়ে ফূর্তি করা ইত্যাদি ইত্যাদি। একদিকে তিনি আড্ডা দেন আবিদ আজাদ, মুস্তফা আনোয়ার, রিফাত চৌধুরী, চয়ন খায়রুল হাবিব, আহমেদ মুজিব কচি ইনাদের সাথে, আরেকদিকে মিশতে থাকেন চাকরি-ভিত্তিক কমিউনিটির আনাচে-কানাচে ভিন্ন নামে আড়াল থাকা বিপ্লবীদের সাথে। বাংলাদেশ হওয়ার পর রাষ্ট্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন পন্থী বিপ্লবীরা, মাও সেতুং য়ের পথ-চলতিরা যেভাবে চোখের কোনা থেকে স্বপ্ন হারায়ে ফেলে বেঁচে থাকার ফাইট করে যাচ্ছিল, সেইটা কাজল শাহনেওয়াজ বলেন গত শতকের আশির দশক বা এইটিজ ফর্ম হওয়ার একটা ধরণ হিসাবে। তার এই বলাগুলা ব্যাপক ইনট্রিগিং, যেন চোখের তারায় আর মুখের ভাষায় ভিজ্যুয়ালাইজড হচ্ছিল কীভাবে তিনি হিরোইনসেবিকে প্রধান ক্যারেক্টার বানান, বা বিপ্লবী, ব্যর্থ-বিপ্লবী, ধান্দাবাজ, বেকুব মিলিটারি অফিসার, কাছিমপ্রেমি, রিহ্যাববাসী, রিহ্যাব-ফেরত – এইসব তার গল্পে কীভাবে আসে।
এইটিজ, নাইনটিজ – এই সময়টা ভেষজ গাঞ্জার পাশাপাশি নন-ভেষজ হেরোইন আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেটের নতুন উল্লাস ছিল। আমি এই প্রথম একজন লেখকের সাথে রেকর্ডেড আড্ডায় পাইলাম তিনি তার “ফুল ফোটার মতো” গল্প, শব্দ, বাক্য তৈরি হওয়ার দিনগুলিতে এইসব এক্সট্রা-বেসিক কনসামশনকে হাওয়া করে দিয়ে বা মার্জিনের বাইরে রেখে কথা বলেন নাই। বরং খুবই অর্গানিকভাবে, পরম্পরায় আসছে। তবে আড্ডার ১৪ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের মাথায় প্রথম যখন ড্রাগ প্রসঙ্গটা আনসিলেন, বলতেসিলেন “. . . আমার স্বাধীনতাটা আমি পেয়ে গেলাম, তখন আমি এটাকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা শুরু করলাম। মানে এই-ই ইয়ে করা . . . ড্রাগ করা এটা করা সেটা করা এসব”, তখন ড্রাগ উচ্চারণের আগে “এই – ই – ইয়ে” জায়গায় দুই-আড়াই সেকেন্ড সময় নিসিলেন। কিন্তু সেই অস্বস্থি আর পরে ব্যারিকেড হয়ে দাঁড়ায় নাই। প্রসঙ্গে, প্রসঙ্গে, প্রসঙ্গান্তরে চলে আসছে সেইভাবে, যেইভাবে একটা গল্পে গল্পের কনটেক্সট তৈরি হয়। আমি যখন গত শতকের লেইট নাইনটিজের একটা সিন বলতেসিলাম, তখন তিনি, সেই সময়ে ঢুকে বাইর হন এইভাবে:
কা.শা.: তখন আমি ওই যে ইয়ে করি, গল্প লিখি, কিন্তু একেকটা গল্প লিখতে ছয় মাস লাগে, আট মাস লাগে। প্রচুর খরচ হয় একটা গল্প লিখতে। প্রচুর ড্রাগ যায়, এই সেই। এবং আমি ইয়ে করি, আমি সারারাত ওই দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া লিখি। আমার বুক সমান উঁচু একটা শেল্ফ ছিল, ওই শেল্ফের ওপর আমি লিখতাম। তো দাঁড়ায়া লেখার ইয়াটা তখন . . .
শা.বি.র.: শেল্ফের উপরে দাঁড়ায়া লিখতেন?
কা.শা.: শেল্ফের উপরে উঠতাম না। আমি দাঁড়ায়া শেল্ফের উপর কাগজটা রাইখা লিখতাম আর কি। বুক সমান উঁচু।
শা.বি.র.: কেন, দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া লিখতেন ক্যানো?
কা.শা. : ওই দাঁড়ায়াই লিখতাম। ওই ড্রাগ করতাম সারাক্ষণ। ওই সারারাত একটু খাইতেসি, একটু লিখতেসি . . . হি হি হি . . .
শা.বি.র.: হা হা হা . . .
কাজল শাহনেওয়াজ
কাজল শাহনেওয়াজকে যখন বল্লাম আপনার একটা লেখক বায়োগ্রাফি দেন, তখন তিনি তাতে লেখেন: “জীবনের উচ্চ ও নীচ, সফল ও অসফল, সামান্য ও অসামান্য – সব কিছুতেই অপরিসীম আকর্ষণ নিয়ে বসবাস করেন। কবিতায় কল্পনা ও গদ্যে বাস্তবতা দিয়ে শুরু করেছিলেন লেখালেখি। বর্তমানে বাংলার ভূমি-ইতিহাস-রাজনীতি প্রধান আগ্রহ।”
এখন তিনি ব্যস্ত দিঘলী নামে আত্মজীবনী মূলক বই লেখায়। আড্ডায় বলসেন, আরো একটা নভেলা টাইপ টাইম-ট্রাভেলিং ফিকশন আর তিনটা ছোটগল্প লেখার সাথে যুক্ততার সাম্প্রতিক ব্যস্ততা। তিনি জন্মান বিক্রমপুরের লৌহজং থানার দিঘলি গ্রামে (পদ্মা নদীতে নাই হয়ে গেছে), ১৯৬১ সালের পয়লা জুন। বাবার চাকরি এবং নিজের পড়াশুনা, চাকরি, লেখালেখির সূত্রতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় ছিলেন, তবে কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিং ছিল তার লেখালেখির প্রাক এবং শুরুর পর্ব। এরপর অনেক অনেক জায়গা। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি প্রকৌশলে পড়াশুনা। সেচ প্রকৌশলী হিসাবে চাকরি শুরু করলেও তিনি ঝুঁকতে থাকেন প্রোগ্রামিং এবং কোডিংয়ে এবং শিফট করলেন স্টার্টআপে। সাইবার শক্তি নামে সফটওয়্যার কোম্পানি খোলেন।
বর্তমানে তিনি ঢাকাবাসি।
বই:
ছোটগল্প:
কাছিমগালা (১৯৯৩), গতকাল লাল (২০০৭), গল্পসমগ্র (২০১৮)।
কবিতা:
ছাঁট কাগজের মলাট (১৯৮৪), জলমগ্ন পাঠশালা (১৯৮৯), রহস্য খোলার রেঞ্চ (১৯৯২), আমার শ্বাসমূল (২০০৭), কাঠকয়লায় আঁকা তোমাকে আমার (২০০৯), তালগাছ হাতির বাচ্চা (২০১১), একটা পুরুষ পেপে গাছের প্রস্তাব (২০১৫), একটা ব্যাঙনি আমাকে পিঠে চড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে (২০১৯),কবিতাসমগ্র (২০১৮)।
উপন্যাস
শে (২০২১)
সম্পাদনা
বিকল্প কবিতা (যৌথ সম্পাদনা), ১৯৮৯
ফৃ, লিটল ম্যাগাজিন, ৩টা সংখ্যা (১৯৯৫-৯৮)
ফৃ গ্রন্থিকা সিরিজ (পাতলা মলাটের এক ফর্মার বই ২০টা+ সংখ্যক), ১৯৯৮-৯৯, ২০০৭, ২০১১, ২০১৫।
Ω