fbpx

চরণ সরেন: ‘ আর আমার ডাইন পাশে তীর খাওয়া পুলিশ আছিল ৩ জন. . . হা হা হা . . .’

২০১৬ সালের নভেম্বরে যখন রংপুর সুগার মিলস কর্তৃপক্ষ স্থানীয় পুলিশ এবং জেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ প্রশাসন সঙ্গে নিয়ে গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল ও স্থানীয় বাঙ্গালিদের দাবি করা আদি ভূমি থেকে গুলি আগুনে উচ্ছেদ করে, চরণ সরেন ছিলেন হামলা প্রতিরোধকারী সাঁওতালদের একজন। ঘটনায় ৩ জন সাঁওতালের খুন হওয়া এবং অসংখ‍্যজনদের আহত হওয়ার পরম্পরায় নিজেকে প্রথম আবিস্কার করেন সরকারি হাসপাতালের শয‍্যায়, গুলিবিদ্ধ এবং হাতে হাতকড়া লাগানো অবস্থায়। সেটাই ছিল তার প্রথম হাসপাতাল অভিজ্ঞতা, সেই অভিজ্ঞতায় তিনি এটাও আবিস্কার করেন যে আদি ভূমি আর নিজের ঘরটুকু রক্ষা করতে গিয়ে তিনি হয়ে পড়েন আসামিও।

শামীমা বিনতে রহমান

 

 

চরণ সরেনের সঙ্গে আড্ডা, একেবারেই কোন সাক্ষাৎকার নয়।

 

তখন দুপুর ধাপ করে নেমে বিকাল হচ্ছিল মাদারপুর গ্রামে। গুলি-আগুনে নিজের ঘরবাড়ি থেকে উদ্বাস্তু হওয়া চরণ সরেনের তাঁবুর সামনে সেই ট্রানজিশনের হলুদ আলো কোন বিষাদের গল্প বলছিল না, বরং বেসরকারি সংস্থার দেয়া সারি-সারি সাদা তাঁবুর সামনে ফসলি ক্ষেতের নাড়ার খাড়া-খাড়া অংশের মতো ধারালো, ত্রিমাত্রিক হাসি আর তামাসা ফুটছিল।

 

ওই বাঁধা দেয়াতে গুলি খাইলাম। যখন তো গুলি করলো, তখনি তো পড়ি গেলাম। এই নিয়ে গ‍্যাল রংপুরত। তে জীবনে তো যাই নাই কী করি কয়, মেডিক‍্যালে। তে আর মাইনসের হাতে দেখি ত নাহ, আমার হাতে কড়া, উমার হাতে ত নাই . . . হি হি হি. . . হু হু হু . . . হা হা হা  . . . কারণটা কি?

আমরা আড্ডা দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি দেখাচ্ছিলেন তার পায়ের বিভিন্ন জায়গায়, হাতে ছররা বুলেটের আটকে থাকা ছোট ছোট স্প্রিন্টার। শক্ত শক্ত-ছোট ছোট গোল গোল টুকরার মতো। আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করলে স্পষ্ট বোঝা যায়।

ধুসর ডটের মতো যে দাগ দেখা যাচ্ছে, সেটা পুলিশের ছোঁড়া ছররা বুলেটে ক্ষত দাগ, চিকিৎসার পর।

চরণ সরেনের নাম অবশ্য ভুলে যাওয়ারই কথা। গুলি খেয়ে মরে যাওয়া মঙ্গল মার্ডি, শ্যামল হেমব্রম, রমেশ টুডোর কথাই বেশিরভাগ সুধীজনেরই মগজে নাই হয়ে গেছে, যেহেতু চলছে গণতন্ত্রের মুখোশ জিইয়ে রাখার নির্বাচন-নির্বাচন, সার্চ কমিটির হেড লাইন মিডিয়াতে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ট্রাম্পের পুংদন্ডের আকৃতি বিষয়ক টুইট, নারী উদ্যোগে আন্দোলন, ম্যাক্সিকো, পুতিন ইত্যাদি বৈশ্বিক জটিলতায়ও রংপুর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফেরত আসা চরণ সরেন ভালোই আছেন। সেটাই তার জীবনে প্রথম হাসপাতালের অভিজ্ঞতা।

 

এসব প্রশ্নের সাথে তার  হা হা হা . . . হো হো হো. . . হ‍্যা হ‍্যা হ‍্যা হাসি শুনতে-শুনতে, দেখতে দেখতে আপনার মনে পড়ে যেতে পারে শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার আব্দুল মজিদের হাঁটতে হাঁটতে পায়ের স‍্যান্ডেল ফট করে ছিঁড়ে যাওয়া এবং তারপর এক ঝাঁ ঝাঁ শব্দের জগতে ঢুকে পড়ার বাস্তবতার কথা।

গত বছর, মানে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর রংপুর চিনি কল কর্পোরেশন এবং পুলিশ এক তরফাভাবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে গুলি ও আগুন চালায়ে গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে থাকা সাঁওতাল- বাঙ্গালিদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দেয়। তখন গুলি খাওয়া, না-গুলি খাওয়া, আহত, মৃত বেশিরভাগ সাঁওতালই আসামী হয়ে যান বিভিন্ন মামলায়। চরণ সরেন, ওই দিন পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হয়ে রংপুর হাসপাতালে ভর্তি হন, পরে হাতে হাতকড়া লাগানোর পর বুঝতে পারেন, তিনি আসামিও।

চরণ সরেনের ডান পায়ের হাঁটু থেকে নিচের দিকে এরকম অসংখ্য ছররা বুলেটের ক্ষত-দাগ। তিনি বলছিলেন, পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হয় তার।

চলতি বছর, ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি একটা মামলা থেকে আপাত: জামিন পেয়েছেন।

 

হ‍্যা, হাসপাতালে অন‍্য রুগীগোরে হাতে তো কড়া নাই, হাত কড়া নাই, আমার হাতে কেন? চিন্তা কইরলাম। চিন্তা কৈরে দ‍্যাখতেসি যে, পুলিশ … অ‍্যা আমার পায়ে লাগছে গুলি, পুলিশ লাগাইছে হামার হাতত হ‍্যান্ডকাপ, আমি তো চুরিও করি নাই, কিছুই করি নাই,  . . .

 

তো, আড্ডায়, আমরা  কথা বলতেসিলাম আসলে গুলির শক্তি বেশি না, তীরের শক্তি বেশি। কিন্তু সে আলাপে ঢোকার আগেই প্রথমবার হাসপাতালে যাওয়া আর প্রথমবার আসামী হওয়ার টাটকা স্মৃতি আর সেই স্মৃতির ভেতর বিস্ময়, ঘোর, অমিল-বেমিল চরণ সরেনকে আটকে রাখে কিছু বিস্ময় সূচক প্রশ্নে, যেমন: ‘আমি তো চুরিও করি নাই, কিছুই করি নাই, তা ফির হ্যান্ডকাফ লাগাইলো, তায়ও মেডিক্যালো!!??’ এসব প্রশ্নের সাথে তার  হা হা হা . . . হো হো হো. . . হ‍্যা হ‍্যা হ‍্যা হাসি শুনতে-শুনতে, দেখতে দেখতে আপনার মনে পড়ে যেতে পারে শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার আব্দুল মজিদের হাঁটতে হাঁটতে পায়ের স‍্যান্ডেল ফট করে ছিঁড়ে যাওয়া এবং তারপর এক ঝাঁ ঝাঁ শব্দের জগতে ঢুকে পড়ার বাস্তবতার কথা।

 

চরণ সরেন - পুলিশের গুলিতে আহত এবং পুলিশের করা মামলায় আসামি
নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে, পুলিশের করা মামলায় আসামি হয়ে অস্থায়ি জামিন মেলার পর নিজের ঘরের বদলে বেসরকারি সংস্থার দেয়া তাঁবু-ঘরের পাশে, মাদারপুর গ্রামে, গোবিন্দগঞ্জ।

 শা.বি.র: গুলি খাইলেন ক‍্যামনে? 

চরণ সরেন: ওই বাঁধা দেয়াতে গুলি খাইলাম। যখন তো গুলি করলো, তখনি তো পড়ি গেলাম। এই নিয়ে গ‍্যাল রংপুরত। তে জীবনে তো যাই নাই কী করি কয়, মেডিক‍্যালে। তে আর মাইনসের হাতে দেখি ত নাহ, আমার হাতে কড়া, উমার হাতে ত নাই . . . হি হি হি. . . হু হু হু . . . হা হা হা  . . . কারণটা কি?

শামীমা: হা হা হা . . . তারপর? হ‍্যা, আর মানুষের হাতে নাই, আপনার হাতে, হাসপাতালে

চরণ সরেন: হা হা হা  . . . হ‍্যা, হাসপাতালে অন‍্য রুগীগোরে হাতে তো কড়া নাই, হাত কড়া নাই, আমার হাতে কেন? চিন্তা কইরলাম। চিন্তা কৈরে দ‍্যাখতেসি যে, পুলিশ … অ‍্যা আমার পায়ে লাগছে গুলি, পুলিশ লাগাইছে হামার হাতত হ‍্যান্ডকাপ, আমি তো চুরিও করি নাই, কিছুই করি নাই, তা ফির হ‍্যান্ডকাপ লাগাইলো, তায়ও মেডিক‍্যালও। হা হা হা  . . .

শা.বি.র.: হা হা হা 

: জীবনের উপরে উঠে গ‍্যাছে। (আড্ডায় অংশ নেয়া আরেক সাঁওতাল)

শা.বি.র.: তারপর?

চ.স.: জীবনের উপর . . . আমি বলি জীবনের উপর হাঁটতে পারি না আর ফির হ‍্যান্ডকাপ লাগাই থুইছে!

শা.বি.র.: তারপর?

চ.স: ওই ওঙ্কে থাইকলো। পরের দিন, তিন দিন না চাইর দিন পরে ওই গ‍্যালো জ‍্যোতি বড়ুয়া (জ‍্যোতির্ময় বড়ুয়া)। অয় যখন দিলো, মানে ছবি তুল্লো, এখান নাম্বার দিয়ে গ‍্যাল . . .আর আমার ডাইন পাশে তীর খাওয়া পুলিশ আছিল, তিন জন . . . হা হা হা. . .

শা.বি.র.: হা হা হা  . . . হাসপাতালে?

চ.স.: হ, হাসপাতালে

শা.বি.র.: তারপর? আপনার ডাইন পাশে ছিল ৩ পুলিশ?

চ.স.: ওরাও তীর খাওয়া

শা.বি.র.: আপনি কি তীর মারছিলেন?

চ.স.: না, আমি মারি নাই। আরো লোকজন মারছে

শা.বি.র.: তো ক‍্যামন লাগলো ব‍্যাপারটা? আপনিও গুলি খাইলেন, ওই পুলিশে মারলো গুলি আর সাঁওতাল মারলো তীর।তো পুলিশও আছে, আপনিও আছেন, ক‍্যামন লাগলো ব‍্যাপারটা?

চ.স.: তা উমার হাত দ‍্যাখলাম, না তো, উমার হাতে কড়া নাই, আরে!  উমরাও তো তীর খাওয়া, উমাগো কড়া লাগান! তা উমাক লাগায় নি, আমাকে লাগাইছে।