সরকার, কোম্পানি, কর্পোরেশন, মিলিটারি, এলিটগোষ্ঠী দ্বারা আদিবাসীদের ভূমি দখল করে তাদেরই নিজ ভূমি থেকে উপড়ে ফেলে উদ্বাস্তু করে ফেলা, অথবা আদিবাসী ভূমির এক অংশ দখল করে ‘উন্নয়ন’ করে পরিবেশ-প্রতিবেশ নষ্ট করা, বা নিজেদের ভূমিতে রেখেই মিশেল ফুকোর ভাষায় ‘ডোসাইল’বা সিস্টেমের বাধ্য, অনুগত এবং অনুগামি করে ক্ষমতা পরিচালিত করার ঘটনা বাংলাদেশের মতো বিদেশেও প্রায় একই।
ক্যানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় সেকয়্যেপম্যাক আদিবাসীরা প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের জমির ওপর দিয়ে সরকারের তেল পরিবহনের প্রজেক্ট ট্রান্স মাউন্টেন পাইপলাইন বসানো বন্ধ করার দাবিতে। টাইনি হাউজ ওয়ারিয়রস নামে সেকয়্যেপম্যাকদের সংগঠনটি প্রকল্পে থাকা তাদের জমির ৫১৮ কিলোমিটার (পুরা সেকয়্যেপম্যাক আদিবাসী এলাকা ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গকিমি) জায়গার যেই যেই দিক দিয়ে পাইপ বসানোর পরিকল্পনা আছে, সেই সেই জায়গায় চাকাঅলা ছোট ছোট ঘর বানিয়ে সরকারের অনুমোদন পাওয়া অ্যামেরিকান কোম্পানি কাইন্ডার মর্গানের নির্মাণ কাজ আটকে দিয়েছে। ২০১৭ সাল থেকেই এইভাবে প্রতিরোধ জারি রেখেছে টাইনি হাউজ ওয়ারিয়রস। নিজস্ব আইন-কানুনের ভিত্তিতে নিজেদের জমির ওপর নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই তাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য আর সেই লক্ষ্যে তাদের ল্যান্ড ব্যাক (Land Back) আন্দোলন। মানে ক্যানাডায় উপনিবেশের (ব্রিটিশ-ফরাসী) আগে যেই জমি আদিবাসীদের ছিল এবং উপনিবেশ উত্তর সময়ে যেসব জমি সরকার-কোম্পানি-এলিটদের দখলে গেছে, সেই সবজমি ফেরত আনা এবং তথাকথিত ‘উন্নয়নমূখী’ এবং ‘মডার্ন’ জ্ঞান নয়, তাদের নিজস্ব জ্ঞান, জানা-বুঝার ভিত্তিতে ভূমির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। পোস্টকলোনিয়াল আন্দোলন।
এই আন্দোলনে তাদের দুইটা শ্লোগান সোস্যাল মিডিয়ায় তাদের একাউন্টে দেখা যায়: ‘আমাদের জমি আমাদের বাড়ি (Our Land is Our Home)’ এবং ‘আমাদের পানি আমাদের প্রাণ (Our Water is Our life)’। বাংলাদেশে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জে সরকারি প্রশাসনের সমর্থনে স্থানীয় পুলিশ এবং পলিটিক্যাল মাস্তানদের গুলি-আগুন-লুটপাটে খুন হয়ে-আহত হয়ে-ঘরবাড়ি হারিয়ে-তীব্র ভয় পেয়ে রংপুর সুগার মিলস কর্পোরেশনের ভেতরে থাকা নিজেদের আদি জমি থেকে উৎখাত হন আদিবাসী সাঁওতালরা। তখন তারা শ্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আমার মাটি, আমার মা/কেড়ে নিতে দিবো না’; মাটির দেয়ালে, গাছের মোটা কাণ্ডে লিখেছিলেন ইংরেজিতে Return the Santals Land।
গত বছরে ক্যানাডায় আদিবাসীদের বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে টাইনি হাউস ওয়ারিয়রসের সহ প্রতিষ্ঠাতা ক্যানাহুস ম্যানুয়েল এবং নাওমি ক্লেইন এই লেখাটি লেখেন, যৌথভাবে। ওই বছরের ১৯ নভেম্বর দ্যা গ্লোব অ্যান্ড মেইল য়ে অপিনিয়ন বিভাগে লেখাটি প্রকাশিত হয়। মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জায়েদ বিন সাত্তার।
সংক্ষেপে বললে ২০২০ সালে কানাডার বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের করা আন্দোলনের কারণগুলো ছিলো এরকম- নোভা স্কশিয়াতে লবস্টার নিয়ে, কুইবেকে মুজ হরিণ সংরক্ষণ নিয়ে, অন্টারিওতে আবাসন প্রকল্প তৈরির বিরুদ্ধে আর ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে তেলের পাইপলাইন তৈরি নিয়ে। হঠাৎ করে শুনলে কারণগুলোর মাঝে তেমন কোন সামঞ্জস্য খুঁজে না পাওয়া গেলেও একটু ভেতরে গিয়ে দেখলে সবগুলো ঘটনার পেছনের দর্শণ ও উদ্দেশ্য যে একইরকম সেটি বেশ সহজেই বোঝা যাবে।
‘Land Back’ – আদিবাসীদের আন্দোলনের এই স্লোগানের মাঝেই তাদের শত বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য বেশ পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। ‘Land Back’ কথাগুলোর মূলভাব দাঁড়ায় এরকমঃ আদিবাসীদের যেসকল জমি শুরু থেকে আইনগত ভাবে তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে দেয়া হয়নি সেগুলোর উপর আদিবাসীদের নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করা। রায়া(র)সন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়োলো হেড ইনস্টিটিউট (ইন্সস্টিটিউটটি আদিবাসীদের দ্বারাই পরিচালিত) ‘Land Back’ আন্দোলনটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছে- ‘আদিবাসীদের আইনগত অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা: অধিকার ও কর্তব্যবোধের মাঝে জীবন-যাপন’। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের আদিবাসীরা তাদের নিজেদের জমির উপর অধিকার ফিরে পাবার জন্য এই আন্দোলনটি শুরু করেছে এবং তারা তাদের এই আন্দোলনটিকে কেবল একটি স্থানীয় পর্যায়ের আন্দোলন হিসেবে দেখছে না বরং স্থানীয় গন্ডির বাইরেও আদিবাসীদের আদি বসতভিটার উপর নিজেদের অধিকার ও নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করার জন্য দেশব্যপী যে বৃহত্তর প্রচেষ্টা চলমান সেটিরও অংশ হিসেবে দেখছে। নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠা এই আদিবাসী আন্দোলনের নেতারা এখনকার প্রতিষ্ঠিত আদিবাসী সংগঠনগুলোকে সাথে নিয়ে আদিবাসী স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন কিছু করার ব্যাপারে আর আগ্রহী নয় বরং তারা তাদের নিজেদের কৌশলে আগানোর ব্যাপারে আগ্রহী। কারণ এই পুরাতন সংগঠনগুলো আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার চাইতে এককালীন অর্থ এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে সরকার ও অন্যান্য পক্ষের সাথে (বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ) আদিবাসীদের জমি হস্তান্তর করার ব্যাপারে আলাপ আলোচনায় বেশি উৎসাহী।
পুরাতন সংগঠনগুলো আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার চাইতে এককালীন অর্থ এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে সরকার ও অন্যান্য পক্ষের সাথে (বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ) আদিবাসীদের জমি হস্তান্তর করার ব্যাপারে আলাপ আলোচনায় বেশি উৎসাহী
আদিবাদীদের এরকম আন্দোলন যে একেবারে নতুন ঘটনা তা কিন্তু নয়, যেমনঃ ২০১২ সালে আদিবাসীদের সার্বভৌমত্ব এবং নিজেদের পরিবেশগত সুরক্ষার বন্দোবস্তের উপর কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের আনা আইনী অভিঘাতের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা ‘Idle No More’ নামে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো। অতীতে সংঘটিত এরকম আন্দোলনের ফলে আদিবাসীদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষার ইস্যুতে দেশব্যাপী যে জনসম্পৃক্ততা ও জনসচেতনতা তৈরি হয়েছে তার উপর ভিত্তি করেই ‘Land Back’ আন্দোলনটি গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য আদিবাসীদের জমি ও সেখানকার প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিরোধের টেকসই একটি সমাধান আনা। নিচের কিছু ঘটনা থেকে এ ব্যাপারে আরো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।
অন্টারিওর ক্যালিডোনিয়াতে হডেনোশনি আদিবাসীরা তাদের জমিতে (যেগুলো আইনগতভাবে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি) ম্যাকেঞ্জির আবাসন প্রকল্পের (প্রস্তাবিত) কার্যক্রম বন্ধের জন্য ‘১৪৯২ ল্যান্ড ব্যাক লেনে’ তিন মাসের বেশি সময় ধরে অবরোধ তৈরি করে রেখেছিলো। একইভাবে সেকুয়াপ্যামক আদিবাসীরা ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে ‘Tiny House Warrior’ আন্দোলনের সময় ছোট ছোট ঘর তৈরি করে প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত স্থানে অবরোধ তৈরি করেছিলো । ঐ আন্দোলন ছিলো তাদের বসবাসের এলাকার বিভিন্ন পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে একটি তেলের পাইপ লাইনের সম্প্রসারণ কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার বিরুদ্ধে। কুইবেকেও এধরণের আন্দোলন হয়েছিলো। সেখানে ব্যারিয়ার লেকের আলগ্যাওনকুয়েন্স আদিবাসীরা ভেরিন্ড্রি বন্যপ্রানী সংরক্ষণ অঞ্চল থেকে মুজ হরিণ শিকারীদের আন্দোলনের মাধ্যমে সরিয়ে দিয়েছিলো যেন সেখানে মুজ হরিণের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে না যায়। মিকমা(হ) জেলেরাও তাদের নিজেদের বসবাসের এবং মাছ ধরার এলাকার উপর তাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একইরকম আন্দোলনে নেমেছিলো।
আদিবাসীদের নিজেদের জমি ফেরত পাবার এসব আন্দোলনের মূল বুদ্ধিবৃত্তিক নেতা ছিলেন আর্থার ম্যানুয়েল এবং মোহক রাসেল ( ম্যানুয়েল ছিলেন আমার বাবা এবং এই প্রবন্ধের সহলেখক নাওমি ক্লেইনের আদর্শিক গুরু। ২০১৭ সালে ম্যানুয়েল মারা যান)। তাদের হাত ধরে নতুন আন্দোলনকারীরা ২০০৮ সালে Defenders of the Land নামে নতুন একটি স্বল্প পরিচিত সংগঠন গড়ে তোলে। আদিবাসীদের অধিকার ইস্যুতে ম্যানুয়েল, Unsettling Canada (রোনান্ড ডেরিকসনের সাথে সহলেখক হিসেবে) এবং The Reconciliation Manifesto ( রোনাল্ড ডেরিকসন ও গ্রান্ড চিফ রোনাল্ড ডেরিকসনের সাথে সহলেখক হিসাবে) নামে দুটো বই লিখেছিলেন। নিজেদের(আদিবাসীদের) জমির উপর অধিকার ও স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে সরকার ও আদিবাসীদের স্বার্থ-বিরোধী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর উপর চাপ প্রয়োগ, তাদের বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ের কৌশল নির্ধারণ এবং আদিবসীদের প্রতি সমব্যথী কানাডার সাধারণ জনগণের সাথে আদিবাসীদের কৌশলগত জোট তৈরির মাধ্যমে জমি ফেরত পাবার আন্দোলনকে শক্তিশালী করার পেছনে ম্যানুয়েলের এ লেখাগুলো মূল দিক নির্দেশনা হিসেবে কাজ করেছে। ম্যানুয়েল প্রায়ই একটি কথা বলতেন ‘যারা তোমাদের জমির অধিকার কেড়ে নিয়েছে তাদের কাঁধে মাথা রেখে কান্নাকাটি করা বন্ধ করতে হবে’।
যারা তোমাদের জমির অধিকার কেড়ে নিয়েছে তাদের কাঁধে মাথা রেখে কান্নাকাটি করা বন্ধ করতে হবে।
গত শীতে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের জমি ও অধিকারের প্রশ্নে ম্যানুয়েলের এসব চিন্তা ও বিশ্লেষণের যথার্থতা টের পাওয়া গিয়েছে। তরল প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবহনের পাইপলাইন তৈরির বিরুদ্ধে ওয়েটসোয়েটেনদের করা অবরোধ সরিয়ে দিতে কানাডা সরকার ভারী অস্ত্র-সস্ত্র সজ্জিত আধাসামরিক পুলিশ বাহিনী পাঠিয়েছিলো। কিন্তু এরপরে যা ঘটেছিলো তা বেশ আশ্চর্যজনক। ওয়েটসোয়েটদের জমি থেকে অবিলম্বে মোতায়েনকৃত আধাসামরিক পুলিশ বাহিনী প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন (Shut Down Canada) গড়ে ওঠে। কয়েকদিনের মাঝে পুরো দেশের রেল ও সড়ক পথে অবরোধ দেয়া হয় এবং বড় বড় শহরগুলোতে বিক্ষোভ শুরু হয় । এমনকি ব্রিটিশ কলম্বিয়ার আইনসভাও সেসময় অবরোধ করা হয়। পুরো দেশের জনগণ আন্দোলনের পক্ষে চলে যাওয়ায় কানাডা সরকার তাদের পাঠানো আধাসামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সরকার জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকারের ঘোষণাপত্র (ঘোষণাপত্র অনুসারে আদিবাসীদের পূর্বানুমতি ব্যতীত তাদের এলাকায় কোন প্রকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে না ) মেনে চলার অংশ হিসেবে এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বরং সরাসরি পুলিশ মোতায়েন না করে পরোক্ষভাবে পুলিশি হয়রানির মাধ্যমে আদিবাসীদের প্রকল্পের স্থান থেকে উৎখাতের কৌশল নিয়েছিলো সরকার। তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো কিছু ডানপন্থী নেতা এবং স্থানীয় গণমাধ্যম। তারা সকলে মিলে প্রকল্পের গরীব শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে খেঁপিয়ে তুলতে থাকে। শ্রমিকদের এই বলে উস্কানি দেয়া হচ্ছিলো যে , প্রকল্পগুলো বন্ধের জন্য আদিবাসীদের করা আন্দোলনের কারণে এই করোনা অতিমারী ও বেকারত্বের সংকটের মাঝে তাদের (শ্রমিকদের) কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়েছে এবং তাদের এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দরকার। এ ধরণের উস্কানির ফলাফলও সাথে সাথেই পাওয়া গিয়েছে। এরকম উস্কানির ফলেই নোভা স্কশিয়াতে শেতাঙ্গ জেলেরা আদিবাসী মিকমা জেলেদের উপর হামলা চালিয়ে তাদের বিভিন্ন যানবাহন এবং মাছ (লবস্টার) সংরক্ষণাগারে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। এসব ঘটনা পুলিশের সামনে ঘটলেও পুলিশ সেখানে কোন প্রকার প্রতিরোধের চেষ্টা করেনি।
নতুন প্রজন্মের আন্দোলনকারীরা এখন বিশ্বাস করে যে নানান আইন, বক্তব্য আর আশ্বাসের মারপ্যাচের মাঝে ‘Land Back’ এর মত আন্দোলনই এধরণের প্রকল্প (যেসব প্রকল্প আদিবাসীদের স্বাভাবিক ও চিরায়ত জীবনধারাকে ব্যহত করে এবং এবং আমাদের বসবাসের পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলে) বন্ধ করার জন্য একমাত্র কার্যকর পন্থা।
ক্যালিডোনিয়াতেও আদিবাসীদের উৎখাতের জন্য সরকার একইরকম কৌশল নিয়েছিলো। ব্যাপক মাত্রায় প্রাদেশিক পুলিশ মোতায়েন এবং গণগ্রেফতারের মাধ্যমে উৎখাত প্রক্রিয়াকে বেশ জোরেসোরে এগিয়ে নেয়া হচ্ছিলো। একদল আদিবাসী নারীর উপর রাবার বুলেট ছুঁড়ে পুলিশ আন্দোলনকারীদের (1492 Land Back Lane এর আন্দোলনকারীদের) উস্কানি দেয়ার চেষ্টা করেছিলো যেন তারা সহিংস হয়ে উঠে এবং একটা ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু সেরকম কোন পরিস্থিতি তৈরি না হওয়ায় এবং আন্দোলনকারীরা তাদের অবস্থান থেকে না সরায় পুলিশ সেবার পিছু হটে। একই কৌশল দেখা গিয়েছে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ট্রান্স মাউন্টেন পাইপলাইন প্রকল্পের ক্ষেত্রে। প্রকল্পের জমির উপর নিজেদের অধিকার জানান দিতে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা দেয়ার কৌশল হিসেবে আদিবাসী সেকয়্যেপম্যাক আন্দোলনকারীরা (Tiny House Warriors) সেখানে ছোট ছোট ঘর তৈরি করেছিলো। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা তৈরি হয় এবং প্রকল্পের মূল স্বত্বাধিকারী প্রকল্পের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কানাডা সরকার প্রকল্পটি কিনে নেয়। প্রকল্প সরকারের হাতে চলে যাবার ফলে প্রকল্পের কাজ বেশ দ্রুততার সাথে এগোতে থাকে। সেই সাথে পুলিশ, স্থানীয় আন্দোলনবিরোধী গোষ্ঠী এবং রাজনীতিবিদরা আন্দোলনকারীদেরকে নানা ভাবে ভয়-ভীতি দেখানো শুরু করে এবং তাদের প্রতি সহিংস আচরণ করতে থাকে। আন্দোলনকারীদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে হামলা, অসদাচরণ এবং এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে এরমধ্যেই পাঁচজন আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সামনে এরকম আরো গ্রেফতারের সম্ভাবনা রয়েছে। ক্যামলুপসের নর্থ থমপস নদীর কাছে তেলের পাইপ লাইন প্রকল্পের খনন কাজ শুরু হবার পরে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। খনন কাজ নির্বিঘ্ন করার জন্য সেখানেও বহু আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যেহেতু বাইরে থেকে প্রচুর শ্রমিক এবং অন্যান্য লোকজন এই প্রকল্পে কাজ করার জন্য এসেছে তাই এই প্রকল্পের আশে-পাশের এলাকায় করোনা ঝুঁকি বেড়ে যাবার বিষয়টি সামনে আনা হলেও সেটি উপেক্ষা করেই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করার মত ব্যাপার হলো ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মত জায়গাতে এধরনের কাজ হচ্ছে। এখানকার ক্ষমতাসীন দল এনডিপি গত নির্বাচনের আগে এই তেলের পাইপলাইন স্থাপন প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধের জন্য সকল ধরনের আইনী পদক্ষেপ নেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো এবং এরাই উত্তর আমেরিকাতে প্রথমবারের মত জাতিসংঘের আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের জন্য আইন প্রণয়ন করেছিলো; কিন্তু জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক এই প্রকল্প বন্ধের ব্যাপারে এখন তাদের সেরকম কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে এরকম পরিস্থিতিতে নতুন প্রজন্মের আন্দোলনকারীরা এখন বিশ্বাস করে যে নানান আইন, বক্তব্য আর আশ্বাসের মারপ্যাচের মাঝে ‘Land Back’ এর মত আন্দোলনই এধরণের প্রকল্প (যেসব প্রকল্প আদিবাসীদের স্বাভাবিক ও চিরায়ত জীবনধারাকে ব্যহত করে এবং এবং আমাদের বসবাসের পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলে) বন্ধ করার জন্য একমাত্র কার্যকর পন্থা। ‘Land Back’ এবং ‘Shut Down Canada’ আন্দোলন যে কেবল নিদৃষ্ট কিছু আন্দোলনের প্রতি কানাডা সরকারের অবস্থানকে পরিবর্তন করেছে তাই নয় সেই সাথে পুরো ‘ইন্ডিয়ান অ্যাক্ট’ আইনকে চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে। পাশাপাশি এসব আন্দোলনের মাধ্যমে আদিবাসীদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সরকারের সাথে আলোচনায় বসার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রধান আদিবাসী সংগঠনগুলোর নেতাদের ব্যর্থতার দায় সবার সামনে তুলে আনা গেছে।
কানাডার জনগণ, বিশেষত তরুণেরা যারা বর্তমানের জলবায়ু সংকটের মাঝে বড় হচ্ছে তারা বুঝতে শুরু করেছে যে আদিবাসীরা যদি তাদের ভূমির অধিকার ফিরে পায় এবং সেসব স্থানে আগের মত প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি হয় তবে সেটি আমাদের সকলকেই ভালো থাকতে সাহায্য করবে।
ক্যানাহুস ম্যানুয়েল (Kanahus Manuel):
ক্যানাডিয়ান আদিবাসি অ্যক্টিভিস্ট। আদিবাসিদের ভূমি-পানি-বাতাস-বন -পরিবেশ – আদিবাসি জ্ঞান এসবের ওপর দখলদারিত্ব এবং হুমকির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তিনি ‘টাইনি হাউস ওয়ারিয়র’ অ্যক্টিভিস্ট গ্রুপের সহপ্রতিষ্ঠাতা। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে এই গ্রুপের সদস্য হিসাবে ক্যানাডিয়ান সরকার এবং কাইন্ডার মর্গান যে পরিশোধিত ও অপিরশোধিত তেল পরিবহনের পাইপ লাইন (আলবার্তা থেকে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, ১,১৫০ কি.মি., ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় সেকয়্যেপম্যাক টেরিটরিতে ৫১৮ কি.মি.) বসানোর কাজ করে আসছিল, তা প্রতিরোধ করার অংশ হিসাবে তিনি ১০টি টাইনি হাউস বা ছোট ঘর নির্মাণ করে গ্রুপের সদস্যসহ ওই ঘরগুলাতে থাকাথাকির মাধ্যমে সরকারি ও কর্পোরেশনের পাইপ বসানোর কাজ আটকে দেন। এর জন্য তাকে সরকার গ্রেফতারও করে। নিজের যাপন করা জীবনেও তিনি প্রচলিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে তার অবস্থান জারি রেখেছেন। তার চারটা বাচ্চা, যাদের অন্যরা ‘ফ্রিডম বেবি’ হিসাবে ডেকে থাকে কারণ সিস্টেমের পরাধীনতার বাইরে তাদের বড় করছেন তিনি। তিনি বাচ্চাদের হাসপাতালে জন্ম দেন নি, সরকারি ব্যবস্থার জন্ম নিবন্ধনের মধ্যে যান নি, এমন কি বাচ্চাদের ক্যানাডিয়ান স্কুলেও ভর্তি করেন নি। ভাইস ক্যানাডার সাথে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘নিবন্ধন না করা মানে এই প্রতিষ্ঠানগুলাকে বিচ্ছিন্ন করা। . . . কারণ আমাদের নিজস্ব, আদিবাসি জ্ঞানের ওপর নিজেদের নির্ভর করতে হবে, এইসব সিস্টেমের ওপর না।’
ভাইস ডটকমে ক্যানাহুস ম্যানুয়েলের ইন্টারভ্যু:
নাওমি ক্লেইন (Naomi Klein):
ক্যানাডিয়ান লেখক, সাংবাদিক, অ্যক্টিভিস্ট, বিশেষ করে কর্পোরেট গ্লোবালাইজেশন, বিশ্বায়ন-পরবর্তী ক্যাপিটালিজম ব্যবস্থার কড়া সমালোচক, বিশ্লেষক, তাত্ত্বিক এবং পরিবেশবাদী আন্দোলন, নারীবাদী আন্দোলনের সোচ্চার স্বর। তার নো লোগো (No Logo, 1999) এবং দ্য শক ডকট্রিন (The Shock Doctrine, 2007) বই ক্যানাডার গন্ডির বাইরে দুনিয়া জুড়ে তাকে পরিচিত করে তোলে।
ইংরেজিতে প্রকাশিত লেখার লিংক:
উল্লেখ বাঞ্চনীয়: লেখাটি ২০২০ সালের হলেও ছবিগুলো বেশিরভাগই এই বছরের, যেহেতু টাইনি হাউজ ওয়ারিয়রসের আন্দোলন চলছে এখনও, তাই সাম্প্রতিক ছবি প্রাসঙ্গিক। এবং কাভার ফটোগ্রাফের সাথে এই লেখার টেকস্টের কনটেকস্টের সাথে মিল নাই, কিন্তু এই লেখার মূল স্পিরিটের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এবং ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বরের নৃশংস ঘটনা এবং সাঁওতালদের আদি জমি ফেরত চাওয়ার আন্দোলনের সাথে যুক্ত এবং সম্পর্কিত। কাভার ছবি: শামীমা বিনতে রহমান, ডিসেম্বর, ২০১৬, জয়পুর গ্রাম, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা।