fbpx

পুলিশের ভয়: পালিয়ে থাকা গুলিবিদ্ধ ২ সাঁওতাল নারী-পুরুষের গল্প

শামীমা বিনতে রহমান

 

“হৃদয়ের ক্ষত, আছে যার যত/ মান্নান মিয়ার তিতাস মলম” জেমসের এই গান মনে ভাসলো গোবিন্দগঞ্জে যাওয়ার পথে যখন দিনাজপুরের রানীগঞ্জে, অটো রিকসা একটু থামলো আর ক্যানভাসারের মাইক থেকে ভেসে আসছিল “লালন শাহ” মলমের কথা- “ চুলকানি. . . আঙ্গুলের আগায়. . . রানের চিপায়. . .”।

মলম এই অঞ্চলে বেশ চলে। এক দুপুরে মাথা ব্যথা করছিল, এরকম জানাতেই একজন মলম নিয়ে আসলেন, কপালে মাখার জন্য। বললেন, ব্যথা ভালো হয়ে যাবে।

তবে মলমের জোরে না, মনের জোরে, মনে হোল, প্রত্যাখ্যানের একটা প্রচণ্ড শক্তি সত্তরের বেশী বয়সী এক নারী আর এক পুরুষকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও হাসপাতাল প্রত্যাখ্যানের জোর দিয়েছে। দুই জনই ভিন্ন জায়গায় থাকেন এবং কেউ কারো আত্মীয় নন। কিন্তু ২ জনই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একই।

একজনের পায়ের মধ্যে অসংখ্য ছররা গুলির আঘাত। আর আরেকজনের বাম হাতের বাহু দিয়ে গুলি ঢুকে বাম দিকের বুকের ভেতর গেঁথে যায়।

20161114_170558n
“বাঘে ছুঁইলে আঠারো ঘা/ আর পুলিশ ছুঁইলে ছত্রিশ ঘা” তাই গুলি হজম করে হাসপাতালের প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা থেকে দূরত্ব টেনেছেন এই নারী।
20161114_182917
গুলি খাওয়ার মুহুর্ত বর্ননা করলেন এই সাঁওতাল পুরুষ, “যখন গুলি করবার ধরলো তো, ও দিক থেইকা, উত্তরের দিক থেকে। তাহলে আমি ঘরে ঢুকে ট্রাঙ্ক নিয়ে পালাবার ধরছি। যখনই ঘর থেকে বার হবো, হবার সাথে সাথে লাগে গ্যালো। এ বুক থেকে বারায়া গেল, সাইড থেকে আর কি”।

 

৬ নভেম্বর রংপুর সুগার মিলস লিমিটেডের সাহেবগঞ্জ ফার্ম এলাকায়, মিল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ ওখানকার আদি বাসিন্দা সাঁওতালদের উচ্ছেদ করতে আগুন ও গুলি চালালে ৩ জন সাঁওতাল গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যান। আহতদের মধ্যে ১ জন ঢাকায় এবং ২ জন রংপুর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে থাকেন। ভর্তি হবার পরপরই তারা আসামী হয়ে যান এবং হাতকড়া পরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে সেখান থেকে কারাগারে এবং এরপর আবার জামিনে গ্রামে ফেরত গেছেন তারা।

20161114_144341
সাঁওতালদের লাগানো আখে ফুল ফুটেছে সাহেবগঞ্জ ফার্মে
20161112_132037n
এইসব বিদেশী কৃষি যন্ত্র দিয়ে সাহেবগঞ্জ ফার্মে উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালদের ঘরবাড়ির জায়গা আখ চাষের উপযোগি করা হচ্ছে

কিন্তু সত্তর উর্ধ্ব বয়সী নারী এবং পুরুষ, শুরু থেকেই প্রত্যাখ্যান করেন প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। হাসপাতাল। চিকিৎসা ব্যবস্থা খারাপ সে কারণে নয়। বরং হাসপাতাল নামক প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলে পুলিশ নামক প্রতিষ্ঠান এসে ধরে নিয়ে যাবে-এই আতঙ্কে।

হাসপাতালে কেন যান নাই, এমন প্রশ্নে আহত নারীর সঙ্গে থাকা আত্মীয় বললেন, “ যদি এক্সরে করতে যাই, তাহলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, এ জন্য এক্সরেও করতে যাই নি”।

আর আহত সাঁওতাল পুরুষ বলেন, তিনি ভালো আছেন। তার ক্ষত ভালো হয়ে যাচ্ছে। তার হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নাই।

১২ নভেম্বর সাহেবগঞ্জ ফার্মের ভেতর মাদারপুর সাঁওতাল গ্রামে গিয়ে জানতে পারি ২ জন সাঁওতাল নারী ও পুরুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে লুকিয়ে আছেন পুলিশের ভয়ে। গীর্জার সামনে জমায়েত হয়ে থাকা সাঁওতালরা ৭ দশমিক ৫ মিমি গুলি দেখান, সেটা বয়সী পুরুষ সাঁওতালের বুক থেকেই উদ্ধার করেছিল ইসাক কিস্কু। কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসার পর সেই গুলিবিদ্ধ পুরুষ সাঁওতাল কোথায় আছেন্ তারা কেউই জানে না।

পুলিশের ভয়ে চিকিৎসা না নিয়ে আড়ালে থাকা সাঁওতাল পুরুষের কথা গ্রামের বয়সীদের জিজ্ঞাসা করতে করতেই খোঁজ জানা গেল-আরো এক নারী গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা না নিয়ে আছেন। তিনিও পুলিশের ভয়ে পালিয়ে আছেন।

ইসাক কিস্কু বয়সী পুরুষের বুকের ভেতর থেকে গুলি বার করার ঘটনা বর্ননা করতে গিয়ে জানান, প্রথমে আহত ব্যক্তিকে নিয়ে ভ্যানে করে স্থানীয় বাজারে যান তিনি। কিন্তু সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে স্থানীয় ডাক্তার রাজি না হলে তারা ব্যান্ডেজ, প্রয়োজনীয় ওষুধ পত্র নিয়ে গ্রামে ফেরেন। ইসাক কিস্কু বলেন, “ তখন পরিস্থিতিই এমন ছিল যে, গ্রাম থেকে বের হওয়া একেবারেই অসম্ভব। বের হলেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। মামলা দিবে এরকম পরিস্থিতি”।

 

কিন্তু গুলি বের করার ঘটনার বর্ননা শুনা গেলেও আহত সাঁওতালদের ঠিকানা পাওয়া খুবই কঠিন। কারণ, কাউকেই বিশ্বাস করতে না পারার সময় এখন তাদের।

১৯৬২ সালে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের কাছে জমি উন্নয়নের জন্য চলে গেলে, সাহেবগঞ্জ এলাকার ভেতরের সাঁওতাল বাসিন্দারা এখান থেকে সরে গিয়ে আশে পাশেই বসতি করেন। বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে, যাতে জমি চোখে চোখে রাখা যায়। ২০১২ সালের দিকে বর্তমান সাপমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাকিল আলম বুলবুলের উদ্যোগে “ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটি” গঠন করা হয়। তিনি সংগঠিত করতে শুরু করেন সাঁওতালদের-সরকারি কাগজপত্রে জমির মালিকানা বুঝে পাবার আশ্বাস দিয়ে এবং টাকা নিয়ে। সাঁওতালরা আশপাশ এলাকা থেকে ফার্ম এলাকায় এসে বসত গাড়ে চলতি বছরের জুলাই মাসে। গুচ্ছ গ্রামের মতো ঘর বানিয়ে থাকা শুরু করেন এখানে।

মাদারপুর গ্রাম থেকে বেরিয়ে নানা প্রশ্নের জবাব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের না-হ্যা’র দোলাচল টপকে প্রথমে পৌঁছানো সম্ভব হয় ছররা গুলিতে আহত নারীর ঘরে। অন্য জেলায়। এটা তার অস্থায়ী আবাসন, এ সময়ের জন্য। তার বাম পায়ের হাঁটু থেকে উপরের অংশে এতগুলো ছররা গুলির ক্ষত যে শরীরের ওই জায়গাটা শক্ত হয়ে আছে। হাঁটতে পারেন না।

সাহেবগঞ্জ ফার্ম এলাকায় এই নারীর দাদার ৮০ বিঘা জমি আছে, যেটার কাগজপত্রও তার কাছে আছে, সে কারণেই তিনি সাড়ে ৪ মাস আগে ওখানে গিয়ে ঘর তুলে থাকা শুরু করেছিলেন। ৬ নভেম্বর আগুন আর গোলাগুলির সময় তিনি বাইরে থেকে ঘরের ভেতর কাপড় ঢুকানোর সময় গুলিবিদ্ধ হন।

 

কিন্তু পুরুষ সাঁওতালের বুকে যে গুলি লেগেছিল, সেটি মৃত্যু নিশ্চিতকারী গুলিই। দিপল সরেন আবারও বর্ননা করেন এই গুলিবিদ্ধ সাঁওতালের কথা। তিনি জানান, মঙ্গল মার্ডি, গুলিতে মরে যাওয়া সাঁওতাল; তার সাথেই ছিলেন এই বয়স্কও। দুইজনই একসাথে ঘরে যান জমির কাগজ আর টাকা উদ্ধার করে নিয়ে আসতে। এবং ঘটনা শেষে গুলিতে একজন নিহত এবং একজন আহত হন।

অন্য আরেক জেলার আরেক উপজেলায়, রাতের বেলায় অন্ধকার গ্রামের রাস্তায় এই মুখ, ওই মুখ করে, নানা প্রশ্নের জবাব দেয়ার পর, যখন গুলির ক্ষত, ব্যান্ডেজসহ  আহতের সঙ্গে দেখা পাওয়ার অনুমতি মিলল, তিনি একলাই উঠানে এসে বসলেন। দেখালেন বুকের বাম দিকের ক্ষত, হাতের ব্যান্ডেজ। বললেন,

“যখন গুলি করবার ধরলো তো, ও দিক থেইকা, উত্তরের দিক থেকে। তাহলে আমি ঘরে ঢুকে  ট্রাঙ্ক নিয়ে পালাবার ধরছি। যখনই ঘর থেকে বার হবো, হবার সাথে সাথে লাগে গ্যালো। এ বুক থেকে বারায়া গেল, সাইড থেকে আর কি।”

20161114_182852
পুরুষ সাঁওতালের বাম হাতের বাহু দিয়ে ঢুকে বুকের যেখানটায় এসে আটকে গেঁথে যায় গুলি। রাইফেলের গুলি।