fbpx

৬ নভেম্বর: সাঁওতাল হত‍্যা দিবস/ আন্দোলন, বিভাজন এবং যাপন: ফিলিমন বাস্কের সাথে আড্ডা

ফিলিমন বাস্কে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটিতে যুক্ত আছেন ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ প্রশাসন, সুগার মিল কর্তৃপক্ষ সব লেয়ারের ক্ষমতাধরদের প্রযোজনায় সংঘটিত হামলার আগে থেকেই, ২০১৩ সাল থেকে। তিনিই মূলত: সংগঠনটির প্রধান উদ‍্যোক্তা। তবে আমি তাকে চিনি ওই হামলার ঘটনার পর ওইখানে রিপোর্ট করতে যাওয়ার পর। তিন দফায় দুই দিন, দুই সপ্তাহ এবং এক সপ্তাহ সাঁওতাল গ্রাম মাদারপুরে থাকা এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে ঢাকায় মামলার হাজিরা দিতে আসায় আলাপ এবং আলাপ চালু থাকার ফ্লো তৈরি হয় ফিলিমন বাস্কের সাথে। দেশের বাইরে চলে আসার পর তার সাথে কয়েক মাস পর পরই টেলিফোনিক আড্ডা হয়, একজন ফ্রিল‍্যান্স সাংবাদিক এবং একজন স্থানীয় আদিবাসি নেতার সাথে চেনাচেনি, জানাজানির ধাপ পার হয়ে, আস্থা-অনাস্থার দোলাচল স্থির হলে পরে যেভাবে, স্বাভাবিক সম্পর্কে স্বাভাবিক কতাবার্তা হয়, সেরকম কথাবর্তা। উনার অনুমতি নিয়েই প্রতিবারের কথাবার্তা আমি রেকর্ড করে রাখি, যেরকম মাদারপুর গ্রামের অন‍্য সাঁওতালদের সাথেও হয়। এখানে তার সাথে কথাবার্তার তিন সময়ের, মানে ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর, ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল এবং ২১ অক্টোবরের অংশ।

তিন সময়ে আড্ডার এই আলাপচারিতায় ২০১৬ থেকে ২০২২ — এই ছয় বছরের পরিবর্তিত চিত্র দেখা যায় ফিলিমন বাস্কের বর্ণনায়, প্রশ্নে, অনুধাবনে। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সাঁওতাল-বাঙ্গালিদের যেই আদিভূমি, প্রায় সাড়ে আঠার শ একরের  সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম এলাকা নামে পরিচিত ভূমি থেকে গুলি, আগুন, লুটপাটে তিন সাঁওতাল খুন এবং বহু সাঁওতাল-বাঙ্গালির আহত হওয়ার মাধ‍্যমে উচ্ছেদ হতে হয়, সেই জায়গা এখন আর রংপুর সুগার মিলসের অধীন ইক্ষু বা আখের বাণিজ‍্যিক চাষাবাদের ফার্ম এলাকা হিসাবে সক্রিয় না। কারণ সুগার মিলসটাই বন্ধ হয়ে গেছে ২০২০ সালে। সেখানে কাঁটা তারের বেড়া নাই, ওয়াচ ম‍্যান নাই, ফার্মের ক্ষমতা প্রদর্শনকারিরাও নাই। তাহলে কী চলছে এইখানে?

ফিলিমন বাস্কের আলাপে ২০২২ সালের ৬ এপ্রিলে কথাবার্তার সময় বেপজা বা বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটির সেখানে এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন বা ইপিজেড করার চেষ্টা, উদ‍্যোগে তাদের সাংগঠনিক প্রতিক্রিয়া, যেইটা একই বছরের ২১ অক্টোবর দেখা যায় একই উদ্বেগের আলাদা লেয়ার। ২০২১ সালে কথার মূল আলাপে সংগঠন ভেঙ্গে পরিচিত, ঘনিষ্ঠদেরই আলাদা সংগঠন করার হতচকিত বাস্তবতা এসেছে। আবার আদিবাসি বাঙ্গালিদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার হামলায় যুক্ত থাকা তখনকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম‍্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল গত বছরের নির্বাচনে জিতে আসেন শাকিল আলম বুলবুল হিসাবে, একজন জনপ্রতিনিধি কীভাবে এরকম নাম পাল্টায়া আবার নির্বাচনে জিতে আসেন, ফিলিমন বাস্কে সেই রহস‍্যের কিনারা খুঁজে পান না। নানাবিধ উদ্বেগ-অনিশ্চয়তা, ভাঙ্গনের মধ‍্যেও তারা কৌশল ব‍্যবহার করছেন, জেমস স্কটের ফরমস অব রেজিস্টেন্সের মতো, কাগজে কলমে জমিটা তাদের না হলেও সেখানে সমবায় পদ্ধতিতে কৃষি এবং মৎস চাষ করে তারা উৎরানোর চেষ্টা করছেন খাদ‍্য সংস্থানের চ‍্যালেঞ্জ। ফিলিমন বাস্কের সাথে আড্ডা শামীমা বিনতে রহমানের। 

২১ অক্টোবর, ২০২২

শা.বি.র.: দাদা, এই ৬ নভেম্বর, গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল হত‍্যা দিবসে আপনাদের কি প্রোগ্রাম ঠিক করছেন?

ফি.বা.: ৬ তারিখের প্রোগ্রাম নিয়ে তো ফেইসবুকে দিয়েছি। কাটামোড়, যেখানে আমাদের এলাকায় ঢোকার প্রবেশ দ্বার, এখন তো ওইখানে অনেক দোকান-পাট হয়ে গেছে, হোটেল হয়েছে, বাস ট্রাক, দুরপাল্লার গাড়িগুলো দাঁড়ায়, খাওয়া দাওয়া করে, ২৪ ঘন্টা লোকজন থাকে ওই মোড়টায়। যেখানে ৬ নভেম্বর ঘটনা ঘটেছিল, এর পাশেই একটা মাঠ ফাঁকা আছে, খেলাধুলা হয় ওইখানে। ওইখানেই সমাবেশ হবে। তারপর ওই জয়পুর পাড়ায়, ওই যে পুকুর পাড়টা দেখছিলেন না, ওইখানে মাঠ আছে, সারা বছর ফুটবল খেলে ছেলেপেলেরা। ওইখানে আমরা মিটিং করি, আলোচনা সভাও করি। 

চলতি বছর মে মাসে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম এলাকায় ইপিজেড স্থাপনের সরকারি উদ‍্যোগের বিরুদ্ধে স্থানীয় সমাবেশে বক্তৃতা করছেন ফিলিমন বাস্কে। ছবি: ফিলিমন বাস্কের ফেইসবুক প্রোফাইল

শা.বি.র: ওইখানেই? ওই জয়পুর পাড়ার ওই পুকুরের ওইখানটায়? 

ফি.বা.: পুকুর আর গ্রামের মাঝখানটার ফাঁকা জায়গায়

শা.বি.র: হ‍্যা, আমি গেসিলাম তো ওইখানটায়। দাদা, জয়পুর পাড়া গ্রামের লোকজন ক‍্যামন আছে? বিমল কিস্কুর কী অবস্থা?

ফি.বা.: হ‍্যা, বিমল কিস্কু আগের চাইতে ভালো আছে। হাঁটাহাঁটি করে, লাঠি বেশি দরকার হয় না। এ আর কি।

শা.বি.র: চরণ সরেন? উনি ক‍্যামন আছেন?

ফি.বা.: চরণ সরেনও ভালো আছে। কিন্তু ওই যে মাঝি হেমব্রম আছে না, ও তো মারা গেছে। উনার কথা মনে আছে আপনার? ওই যে ৬ নভেম্বর ঘটনার পর উনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে আপনি এবং কয়েকজন লোকাল সাংবাদিকের মাধ‍্যমে জানা গিয়েছিল যে উনি জেলখানায় আছেন।

শা.বি.র: ওহ! মাঝি হেমব্রম মারা গেছেন?

ফি.বা.: হ‍্যা কয়েক মাস আগে। ওর লিভার সিরোসিস ছিল, সেটা থেকেই মারা গেছে। তার স্ত্রী আর এক ছেলে আছে এখন ওইখানে, গ্রামে।

শা.বি.র: আহ!

ফি.বা.: ধান লাগানো হয়েছে, বুঝছেন? ধান যেটুকু লাগানো হয়েছে, সেটুকু ভালো। তবে অনাবৃষ্টি এ বছর, খুবই অনাবৃষ্টির কারণে এ বছর অনেক জমিতে ধান লাগানো সম্ভব হয় নি। অন‍্যান‍্য ফসল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের ডিমান্ড প্রশাসনের কাছে আমরা আবেদন করেছি, কিছুটা রেসপন্স পাচ্ছি, কিন্তু সেটা এখনো স্থাপন করা হয় নি। 

শা.বি.র: কী রকম? কী আবেদন করেছেন?

ফি.বা.: সেচের পানির জন‍্য। অনাবৃষ্টির কারণে সেচ সুবিধার অভাবে আমরা পুরোপুরি সব জমিতে ধান লাগাতে পারি নাই। 

শা.বি.র: আচ্ছা

ফি.বা.: যার জন‍্য আবেদন করেছি, জেলা প্রশাসক নির্দেশও দিয়েছে, ইউএনও এবং বিএডিসি প্রধান সেটা প্রাথমিক তদন্ত করে সেচের জন‍্য ৪টা মোটর পাম্প দিতে সুপারিশ করেছে। কিন্তু এর মধ‍্যে হয়তো দেখেছেন নিউজে যে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া, উনি মারা যাওয়াতে গাইবান্ধার ফুলছড়ি-সাঘাটা আসনে তো উপনির্বাচন হয়েছে, সেই উপনির্বাচন তো স্থগিত হয়েছে, আবার এরমধ‍্যে পূজাপার্বন গেল, আবার তিন/চারদিন আগে জেলা পরিষদের নির্বাচন হলো, এসব নিয়ে প্রশাসন খুবই ব‍্যস্ত আছে। যার জন‍্যে এই কাজগুলো এগুয় নি। 

শা.বি.র: আচ্ছা

ফি.বা.: আমরা চাচ্ছি, ওই যে পুকুরগুলো দেখছিলেন বাগদা ফার্মের ভেতরে, আমরা চাচ্ছি ওই পুকুরগুলোতে সমবায়ের ভিত্তিতে মাছ চাষ করতে। পুকুরের পাড়গুলোতে গাছ লাগানোর আবেদনও করেছি, যাতে জেলা প্রশাসক জনাব ফজলুর রহমান, উনি এগুলো পজেটিভলি দেখছেন মনে হচ্ছে আর কি। কথাবার্তা হয় এরকম।

গত বছর তারা বলছিলেন, ১৮৪২ একর জমিতে তারা ইপিজেড করবে। সেটা থেকে এখন কিছুটা সরে আসছে। তারা এখন বলছে যে আমরা সাড়ে চারশ একর জমিতে ইপিজেড করতে চাই। . . . আমরা বলেছি আগে জমিগুলো আমাদের বুঝিয়ে দিতে হবে কাগজে কলমে। সেইটা লিগ‍্যালাইজ করে দিতে হবে। তাহলে আমরা সাড়ে চার শ একর জমি ছাড়তে পারি কিছু শর্ত সাপেক্ষে, বুঝছেন, এই হলো কথা।

শা.বি.র: আচ্ছা, তো ওইখানে যে সমবায়ের ভিত্তিতে মাছ চাষ করা হবে এবং যে ফসল উৎপাদন হচ্ছে এবং হবে,  এইগুলা কি জয়পুর পড়া এবং মাদারপুর পাড়ার সাঁওতাল বাঙ্গালিরাই করবে, নাকি এলাকার অন‍্যরাও আছে এরমধ‍্যে সমবায় কৃষিতে?

ফি.বা.: হ‍্যা, ইনারাই। জয়পুর মাদারপুর সহ আরো যারা আদিবাসি বাঙ্গালিরা আছে এখানে তারাই করছে। এখন তো আগের চেহারায় নাই আর। এখন আসলে পরে দেখবেন, যে বাড়িঘরগুলো করা হয়েছে সেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, শুধু এক জায়গা দু জায়গা না, পুরা এরিয়াতেই, জায়গায়-জায়গায় ঘর তুলছে এবং সেখানেই বসবাস করে আমাদের সদস‍্যরা। সেখানে তারা সবজি চাষ করে, আবার সাধ‍্যমত গাছ লাগিয়েছে কেউ কেউ। আগে থেকে পরিবেশটা এখন একটু অন‍্যরকম হয়েছে।

শা.বি.র: হ‍্যা, অনেক কিছু আসলে চেইঞ্জ হয়ে গেছে এরমধ‍্যে । তাহলে তো আমার মনে হয় এই যে নিজেরাই ফসল উৎপাদন করতেসেন, মনে হয় তো মোটামুটি সবাই ভালো আছে, না কি?

ফি.বা.: শুধুমাত্র আমরা যদি সেচ সুবিধাটা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে পরে শতভাগ আমরা জমিতে চাষাবাদ করতে পারবো ১২টা মাস। বিভিন্ন ধরণের ফসলাদি উৎপাদন করে মোটামুটি খেয়ে পরে কষ্টে-পর্বে থাকতে পারতাম আর কি। এইটা আমাদের প্রত‍্যাশা। এর মধ‍্যে বিভাগীয় কমিশনারের সাথে দু দফা দেখা করেছি আমি, আলোচনা সভা করেছি। এবারে তো দেখছেন পত্রিকাগুলোতে, হয়তো খাদ‍্য সংকট হতে পারে। বিশ্বে, বাংলাদেশেও। তাই প্রশাসন থেকে বলেছে কোন জমি পতিত রাখা যাবে না। সেচের সুবিধা দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীও খাদ‍্য সমস‍্যা থেকে উত্তরণের জন‍্য এরকম কথা বলছেন আপনি হয়তো খেয়াল করছেন। আমরা দেখা করেছি ইউএনও’র সাথে। আমাদের বলেছে যে জমি কার, কার দখলে আছে, সেইটা বড় বিষয় না। এখানে কোন জমি পতিত রাখা যাবে না, সেইটা হলো আসল কথা। যারা যেখানে আছে, সেখানের জমি চাষাবাদ করে ব‍্যবহার করতে হবে, হ‍্যা। সেইটাই প্রশাসন বলছে। আমরা এইটাকে আমাদের কৌশল হিসাবেই নিচ্ছি আর কি। 

শা.বি.র: কবে হৈসে এইধরণের কথাবার্তা?

ফি.বা.: এইটা চলতি মাসের কথাবার্তা। চলমান আছে প্রক্রিয়া। কবে মোটর পাম্প পাবো সেইটা নিশ্চিত করে আর বলা যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি আর কি। 

শা.বি.র: একটা কথা বলি, আপনার সাথে গতবার এপ্রিলে যখন কথা বলতেসিলাম, তখন আপনি বলতেসিলেন ইপিজেড নিয়ে, যে প্রশাসন থেকে লোকজন আসছিলো ফার্ম এলাকায় মাপ-জোখ করছিল। এখন কী অবস্থা ইপিজেড তৎপরতার?

ফি.বা.: এটা অপতৎপরতা বলবো না তৎপরতা বলবো জানি না, ওই যে ঈদের আগে, মানে ঈদুল ফিতরের আগে একটা আলোচনা হয়েছিল, জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে প্রশাসন, ভূমি মন্ত্রণালয়, সুগার কর্পোরেশন এবং বেপজার সাথে স্থানীয় প্রশাসন, উপজেলা লেবেলের স্থানীয় কর্মকর্তাদের। চেয়ারম‍্যান ছিলেন, এমপি ছিলেন। গত বছর তারা বলছিলেন, ১৮৪২ একর জমিতে তারা ইপিজেড করবে। সেটা থেকে এখন কিছুটা সরে আসছে। তারা এখন বলছে যে আমরা সাড়ে চারশ একর জমিতে ইপিজেড করতে চাই। 

শা.বি.র: মানে?

ফি.বা.: হ‍্যা, তারা এরকম বলছে এখন, সেখানে আমরা বলেছি আগে জমিগুলো আমাদের বুঝিয়ে দিতে হবে কাগজে কলমে। সেইটা লিগ‍্যালাইজ করে দিতে হবে। তাহলে আমরা সাড়ে চার শ একর জমি ছাড়তে পারি কিছু শর্ত সাপেক্ষে, বুঝছেন, এই হলো কথা।

বুলবুল তো এখন শাকিল আকন্দ বুলবুল নয়, এখন শাকিল আলম বুলবুল। এবারের ইলেকশনে, গত বছরের ডিসেম্বরের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ও নাম চেইঞ্জ করে ফেলেছে। তাহলে বুঝেন, কত রূপী মানুষ থাকতে পারে। তার চেহারা এখনো উন্মোচন হয় নি। সাঁওতালদের ওপর হামলার ভিডিও ফুটেজে তাকে পরিস্কার দেখা গেল,  ছবিতে পরিস্কার দেখা যায় সে মারতিছে সাঁওতাল সদস‍্যক, অথচ এখন তার নাম পাল্টে গেল।  কোনদিনও কোন প্রশাসন তাকে ডাকবেও না, সরাবেও না, তলবও করবে না। এই দেশে আমাদের জনপ্রতিনিধি বলেন, আর যারা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়, তাদের অবস্থা হলো এই। কোথায় আস্থা মানুষের? সাধারণ মানুষ কোথায় আস্থা রাখবে?

৬ এপ্রিল, ২০২২

শা.বি.র: দাদা, ফেইসবুকে রংপুর ইপিজেড নামে একটা গ্রুপ দেখলাম, ওরা বলছে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম এলাকায় রংপুর ইপিজেড নামকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আবার বেপজার একটা ইউটিউব ভিডিও দেখলাম, যেখানে বেপজা’র নির্বাহী চেয়ারম‍্যান মেজর জেনারেল নজরুল ইসলাম একটা মিটিংয়ে বলেছেন যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সহ দুই লাখ লোকের কর্ম সংস্থান হবে। এটা ২৬ অগাস্ট, ২০২১, মানে গত বছরের আপলোড করা ভিডিও। তো ওই মিটিংয়ে কি আপনি ছিলেন?

ফি.বা.: না, মিটিং ২৪ তারিখের। না না আমাদের ডাকে নাই তো। আদিবাসী কেউ ছিল না। আমরা এ পর্যন্ত যেটুকু বুঝতে পারছি, এটা স্থানীয় প্রভাবে করছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা কিছু লোকের ইন্টারেস্টটা বেশি লক্ষ‍্য করা যাচ্ছে। ওখানে যখন মিটিং হয়, সেখানে ইউএনও, ওসিসহ প্রশাসনের লোকজন ছিল, আবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসাবে বুলবুলও ছিল, আমাদের সাপমারা ইউনিয়নের চেয়ারম‍্যান। বুলবুল তো এখন শাকিল আকন্দ বুলবুল নয়, এখন শাকিল আলম বুলবুল। এবারের ইলেকশনে, গত বছরের ডিসেম্বরের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ও নাম চেইঞ্জ করে ফেলেছে। তাহলে বুঝেন, কত রূপী মানুষ থাকতে পারে। তার চেহারা এখনো উন্মোচন হয় নি। সাঁওতালদের ওপর হামলার ভিডিও ফুটেজে তাকে পরিস্কার দেখা গেল,  ছবিতে পরিস্কার দেখা যায় সে মারতিছে সাঁওতাল সদস‍্যক, অথচ এখন তার নাম পাল্টে গেল।  কোনদিনও কোন প্রশাসন তাকে ডাকবেও না, সরাবেও না, তলবও করবে না। এই দেশে আমাদের জনপ্রতিনিধি বলেন, আর যারা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়, তাদের অবস্থা হলো এই। কোথায় আস্থা মানুষের? সাধারণ মানুষ কোথায় আস্থা রাখবে?

শা.বি.র: ভালো বলছেন। শাকিল আকন্দ বুলবুল এখন শাকিল আলম বুলবুল। হ‍্যা, সব ভিডিওতে তো স্পষ্ট তাকে দেখা গেছে সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিতে, বাগদাফার্মের ভেতর। কিন্তু এই শাকিল তো আপনাদের এই সংগঠনে ছিল একটা সময় . . .

ফি.বা.: হ‍্যা, ছিলো তো। সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি আমরা শুরু করি ২০১৩ সালে। আমি শাজাহান প্রধান এবং আরেকজন সাঁওতাল ছিল চরণ টুডু, আমরা শুরু করি। আমি আহবায়ক ছিলাম আর একটা এডহক কমিটি করি আমরা সেইটাতে শাজাহান প্রধান ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। আমরা কমিটি করার পর শাকিল আকন্দ বুলবুল সে আমাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে, সে তো তখন অনেক প্রভাবশালী নেতা, ছাত্রলীগের উপজেলা কমিটির সভাপতি ছিল, এমপি আবুল কালাম আজাদের ঘনিষ্ঠ লোক। সে আমাদের জমি ফেরত আনার দাবি আন্দোলনকে সমর্থন করে বল্লো তাকে সভাপতি বানালে সে আমাদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যেতে পারবো। আমরা তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। আমি সহসভাপতির দায়িত্ব নেই। ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সে আমাদের সংগঠনে সভাপতি ছিল।

শা.বি.র.: ৬ নভেম্বের হামলার সময়ও কি সে সভাপতি ছিল?

ফি.বা.: না, সে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত ছিল, তারপর সে ছেড়ে দেয়। আমরা ওই বছরের ১ জুলাই, যেদিন ঢাকায় ওই যে হোলি আর্টিজেন হামলা হলো, সেই দিন আমরা কাটামোড়ে একটা সমাবেশ করি, পঙ্কজ ভট্টাচার্য সহ আরো কয়েকজন ঢাকা থেকে এসে আমাদের সমাবেশে যোগ দেন। আমরা সমাবেশ থেকে আমাদের দাবি করা জমি সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মে প্রবেশ করি। এরপর ৭ জুলাই পুলিশ এবং সুগার মিলের লোকজনরা আমাদের ওপর প্রথম হামলা চালায়। এরপর ১০ জুলাই আমরা একটা প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকি ওই জায়গায়, আমাদের কাউন্টার করে শাকিল, তখন সে ইউপি চেয়ারম‍্যান এবং এমপি আবুল কালাম আজাদ একই জায়গায় সমাবেশ ডাকে। দুইটা সমাবেশ একই জায়গায় একই সময়ে ডাকায় ওইখানে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। এরপর ৭ অগাস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসি দিবস পালন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম যখন, তখন আবার হামলা করা হয়। তখনও এমপি এবং শাকিলের প্রত‍্যক্ষ ভূমিকা ছিল। আমাদের ওপর হামলা করে আমাদের বিরুদ্ধেই মামলা দেয়। ৫টা মামলা। তারপর তো ৬ নভেম্বরের হামলা আপনারা সবাই দেখেছেন শাকিল আকন্দকে ভিডিও তে কী করেছে সে সেসময়। এখন সে নাম পাল্টে শাকিল আলম বুলবুল। তো আর কী বলবো আপনাকে! সে কীভাবে এই নাম পাল্টে ফেল্লো, এই রহস‍্যের কোন কিনারা করতে পারছি না আমরা।

গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম এলাকায় সাঁওতালদের উচ্ছেদের পর পুলিশি পাহারা
বাপদাদার জমি বলে দাবি করা সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম এলাকা থেকে সাঁওতাল-বাঙ্গালিদের উচ্ছেদের পর পুলিশি পাহারা। ছবি: হার্দিক মমি, ২০১৬

শা.বি.র.: দাদা, এখন আমাকে একটা কথা বলেন তো, একবার আপনি বলতেসিলেন যে, যখন নীলফামারীতে উত্তরা ইপিজেড হয়, তখন কর্ম সংস্থান হয় মাত্র ১ জনের . . .    

ফি.বা.: তার আগে শুনেন, সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম করার সময় ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই যে মেমোরেন্ডাম হয়, তার আগে ৫৫/৫৬ সালে এই যে রিক‍্যুইজেশন করে আমাদের জমি নিয়ে নেয়, তখন যে শর্ত ছিল, সেটা ছিল এখানকার ৭০ ভাগ মানুষকে কাজে নেবে, সে জায়গায় মাত্র নিয়েছিল ২ জনকে। একজন ট্রাক্টর ড্রাইভার আর আরেকজন গরু মোষের কেয়ারটেকার। এটাই বাস্তব। সেইদিন ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল নজরুল বলেছিলেন যে নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে ৩২ হাজার লোক কাজ করতিছে। ১৯৭৫-৭৬ সালে আমি ক্লাস ফাইভ/ সিক্সের ছাত্র। ওই সময় থেকে ওই এলাকায় যাতায়াত করি। স্বাধীনতার পরে তারা ওই ইপিজেড তৈরি করেছে। উনি বল্লেন ৩২ হাজার লোকের কর্ম সংস্থান হয়েছে। বাস্তবে ওইখানে ১২ থেকে ১৪ হাজার লোক কাজ করছে। আমার আত্মীয় স্বজনও আছে সেইখানে। আমি তো যাতায়াত করছি ৭৬ সাল থেকে। তাহলে এতো বছর, ৫০ বছরে, উনার কথামতোই যদি ওইখানে ৩২ হাজার লোক বর্তমানে কাজ করতিছে, উনি কীভাবে বলতিছেন এই খানে লক্ষ লক্ষ লোকের কর্ম সংস্থান হবে? যেখানে ৫০ বছরে ৩২ হাজার, সেখানে একবারেই দুই লাখ লোকে কাজ পাবে? কীভাবে কাজ পাবে? এটা কী আলাদীনের চেরাগ যে ঘষবে আর আদিবাসিরা কাজ পেয়ে যাবে পটাপট, নাকি ডিজিটালের বরাতে? এইগুলো কোটেশন আকারে দেন, অসুবিধা নাই আমার।

শা.বি.র.: না, অসুবিধা হবে ক‍্যানো, তাইতো।

ফি.বা.: আমরা বলতেছি, আজকেও সমাবেশ থেকে বলেছি, প্রথমে এই জমি যেহেতু আমাদের বাপ দাদার, শর্তানুসারে আমাদের ফেরত দেয়ার কথা। আগে জমি ফেরত দেয়া হোক। তারপর সরকারি এজেন্সি বা সরকারের সাথে বসে ঠিক করা যাবে পরবর্তী কার্যক্রম। আমরা তখন চিন্তা ভাবনা করে, আমরা অবশ‍্যই একমত হতে পারি। প্রথমে জমি ফেরত দেয়া হোক, তারপরে কথা বলবো আমরা।

আমরা তো ২০১৯ সাল থেকে অদ‍্যাবধি ধান সবজি চাষ করছি। আমাদের লাউ কুমড়া ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি। ফলনও মোটামুটি ভালো। চাষ করে আমরা স্বাচ্ছন্দ‍্য বোধ করছি। ফার্মের যে অফিসটায় গেছেন আপনি, ওইখানে যে তিনটা পুকুর এবং অফিস কম্পাউন্ড ছাড়া, আর যে জাঁকজমক দেখেছেন আগে — ওয়াচম‍্যান, পাহারাদার এসব ছিল না? — এখন নেই। ২০২০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর ৬ টা সুগার মিল বন্ধ হয়ে যায়, তার মধ‍্যে রংপুর সুগার মিলও একটা। এটা তো বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও তারা কীভাবে বলে যে আমরা আছি, ঠিক না? একবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের দেনা পাওনা তো বুঝায় দিছে। 

শা.বি.র.: এখন ওই জমির কী অবস্থা? খবরে দেখলাম ওই জমিতে ইপিজেডের লোকজনেরা মাপ-জোখ করতে আসছিল, আপনাদের পার্মিশন নিছিল জমিতে ঢুকার আগে? 

ফি.বা.: প্রশাসন সব সময়ই বলে আসছে যে এই জমিতে তাদের কেউ কোন কিছু করার জন‍্য আসলে আমাদের সাথে আগে আলাপ করবে, কিন্তু করে নি তো। পার্মিশন নেয়া তো দূরের কথা। এই গত রবিবারেই তো হলো ঘটনাটা, ৩ তারিখে। আজকে তো ৬ তারিখ। মাঝে দুই দিন গেল। তখন প্রায় ১১টা বাজছিল। ওদের কাজ কারবার দেখে জমিতে আমাদের লোকজনেরা আমাকে ফোন করেছিল। আমি তখন চার্চে ছিলাম, একটু দেরি হয়ে যায় বের হতে। আমি এসে দেখি আমাদের লোকজনেরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতিছে। তারা না-স্বীকার করে যাচ্ছিল। তারা বলছে, না, আমরা এম্নি এলাকায় আসছি, একটু দেখতে আসছি, এটা কিছু না। পরে যখন আরো লোকজন জড়ো হয়েছে, তখন তারা বলছে, হ‍্যা ,আমরা ইপিজেডের পক্ষে আছি, সুগার মিলের পক্ষে আছি।

শা.বি.র.: ওরা কারা? 

ফি.বা.: এই যে সার্ভেয়ার। জমি সার্ভেয়ার। ওরা স্কেল নিয়ে আসছে। আমি ওসিকে ফোন দিলাম পরে ওসি বলছে, আমি জানি। এদের ছেড়ে দেন। তো ছেড়ে দেয়া হলো।

শা.বি.র.: আচ্ছা, তাইলে এখন ওই জমি, পুরা ১৮৪২ একর জমিতেই আপনারাই, মানে সাঁওতাল-বাঙ্গালিরাই চাষবাস করতেছেন, করোনার সময় তো পুরা দেশে যখন অভাবে না খাওয়া, মরে যাওয়া অবস্থা, তখন তো আপনারা এই জমিতে ফসল ফলায়া ভালোই ছিলেন, তাইনা?

ফি.বা.: আমরা তো ২০১৯ সাল থেকে অদ‍্যাবধি ধান সবজি চাষ করছি। আমাদের লাউ কুমড়া ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি। ফলনও মোটামুটি ভালো। চাষ করে আমরা স্বাচ্ছন্দ‍্য বোধ করছি। ফার্মের যে অফিসটায় গেছেন আপনি, ওইখানে যে তিনটা পুকুর এবং অফিস কম্পাউন্ড ছাড়া, আর যে জাঁকজমক দেখেছেন আগে — ওয়াচম‍্যান, পাহারাদার এসব ছিল না? — এখন নেই। ২০২০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর ৬ টা সুগার মিল বন্ধ হয়ে যায়, তার মধ‍্যে রংপুর সুগার মিলও একটা। এটা তো বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও তারা কীভাবে বলে যে আমরা আছি, ঠিক না? একবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের দেনা পাওনা তো বুঝায় দিছে। 

শা.বি.র.: আচ্ছা

ফি.বা.: এই যে এই এক/দেড়মাসের মধ‍্যে সব ধান পাকবে, কাটা হবে। বরো, ইরি, বিরি ২৮, ৩২, ২৯ আছে। এই যে চিকন চাল, সুগন্ধী চাল, কাটারীভোগ আছে। আর সবজি হচ্ছে, লাউ কুমড়া, বিভিন্ন ধরনের শাক চাষাবাদ হচ্ছে। তবে ১০০ ভাগ পাই নি। কারণটা হলো যে সেচের ব‍্যবস্থা যথেষ্ঠ না থাকা। সেচ নিয়ে তালহানা হয়েছে। সেচের কারণে রাস্তা অবরোধ করেছিলাম গত বছর, দুই দুই বার। এই যে সেচের পানি না পাওয়ায় রাজশাহীতে দুইজন সাঁওতাল কৃষক আত্মহত‍্যা করেছে।

শা.বি.র.: হ‍্যা, খবরে দেখসিলাম তো। এই যে আপনারা নানা ফসল এবং শস‍্য উৎপাদন করে যাচ্ছেন, এই উৎপাদন সাঁওতালরা ব‍্যক্তিগতভাবে করছেন না কি দলগতভাবে? মানে উৎপাদনের প্রক্রিয়াটা কি আবার সেইসব বন্টন হৈতেসে কীভাবে?

ফি.বা.: এইটা ওই যে বিভিন্ন এলাকায়, বিভিন্নভাবে জমি চাষ করার সামর্থ‍্য অনুযায়ী কিছুটা বন্টন করা হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকেই।

শা.বি.র.: না, আমি বুঝতে পারি নাই। মানে যেমন ধরেন রাফায়েল যে জমিটা চাষ করতেসে, সেই জমিটা কীভাবে সে পাইলো? কে জমি বন্টন করছে?

ফি.বা.: এই যে ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি জমি বন্টন করেছে।

শা.বি.র.: আপনারা কীসের ভিত্তিতে জমি বন্টন করছেন?

ফি.বা.: আমরা যেটা করেছি, যারা সদস‍্য তাদের নামে এই জমি বন্টন করা হয়েছে। মিনিমাম ৩ বিঘা।

শা.বি.র.: সদস‍্য কত জন?

ফি.বা.: এইখানে প্রায় দু হাজার সদস‍্য এখন।

শা.বি.র.: মিনিমাম ৩ বিঘা, ম‍্যাক্সিমাম কয় বিঘা?

ফি.বা.: আলোচনা স্বাপেক্ষে ৫ বিঘা। কিছু ব‍্যতিক্রম আছে।

শা.বি.র.: এটা কিসের ভিত্তিতে ৩ বিঘা বা ৫ বিঘা পাচ্ছে?

ফি.বা.: এটা বল্লাম না। এটা চাষের সামর্থ‍্য অনুযায়ী।

শা.বি.র.: ওইখানে আপনার জমি কতটুকু?

ফি.বা.: আমাকেও ৩ বিঘা দেয়া হয়েছে।

শা.বি.র.: আর বাঙ্গালিরা?

ফি.বা.: কেউ কেউ বেশিও নিয়েছে, ৩ বিঘার বেশি। তাদের সামর্থ‍্য অনুযায়ি। তাদের তো সামর্থ‍্য আছে, প্রভাবও আছে, কারো কারো বেশ টাকাও আছে। সাঁওতালদের তুলনায় ওদের জমির উৎপাদন খরচ চালানোর সামর্থ‍্য বেশি।

এটা তো এখন পরিস্কার হচ্ছে যে ডাক্তার জাফরুল্লাহ, হাসনাত কাইয়ুম, জ‍্যোতির্ময় বড়ুয়া ইনারা কোন না কোনভাবে তো এই নতুন গ্রুপ বা ভাঙ্গনকে সমর্থন করেছেন,  কারণ আমাদের লোকজনেরা যারা ঢাকায় গেছে, তারা তো তাদের সাথেই দেখা করেছে, অন‍্যদের সাথে তেমন দেখা করে নি। এএলআরডি, আইন সালিস কেন্দ্র, নিজেরা করি, ব্রতী, মানে যারা আন্দোলনের শুরু থেকে ছিল, তাদের কারো সাথে দেখা না করে এরা উনাদের সাথেই দেখা করেছিলেন। এখন তো পরিস্কার হচ্ছে ঘটনাটা। বার্নাবাসরা ঢাকা থেকে ফিরে এসে বলে, ডাক্তার জাফরুল্লাহ সাহেব আমাদের জন‍্য সব করছেন, আর কেউ করে নি। তারপর বল্লো, ব‍্যারিস্টার বড়ুয়া নাকি সব করায়ছেন। হাইকোর্টের জামিন করায়ছেন, উনি মামলা পরিচালনা করেছেন, উনিই সব করেছেন, এরকম আর কি। এখানে আসলে অনেকে অনেক কিছুই করেছেন ২০১৬’র ঘটনার পর। শুধু কাউকে কাউকে বড় করে বাকীদের অবদান মুছে দিলে তো বিভাজন হবেই। 

৭ নভেম্বর, ২০২১

ফি.বা.: এই এখন শুনতে পাচ্ছি। তখন চেম্বারে ছিলাম, অনেক মানুষ আসতেছিল তো, এইজন‍্যই বাসায় এসে আপনাকে জানালাম।

শা.বি.র.: ওহ! তাইলে বাসায় আসছেন? দাদা, গাইবান্ধায়, গোবিন্দগঞ্জে এখন শীত ক‍্যামন পড়তেসে?

ফি.বা.: হ‍্যা, শীত তো পড়ছে চার/পাঁচদিন থেকে। আজকে একটু কম।

শা.বি.র.: আ-আচ্ছা। আচ্ছা দাদা, একটা কথা বলি, আমি আসলে পরিস্কার না, এই জন‍্য। কালকে তো নিউজ পড়লাম, তো, উম-ম, দেখলাম যে হাসনাত কাইয়ুম ভাই, জ‍্যোতির্ময় বড়ুয়া উনারা ঢাকায় যে প্রোগ্রামটা করলেন, সেটাতে ছিলেন বার্নাবাস দা, মানে বার্নাবাস টুডু সভাপতি হিসাবে, আপনাদের কি ইনভাইট করে নাই? আপনাদের দেখা যায় নাই কেন শহীদ মিনারের প্রোগ্রামে? আপনাদের সাথে কি উনাদের সমস‍্যা?

ফি.বা.: সমস‍্যা, হুম, সমস‍্যা চলছে, চলছে। জাফরুল, মানে জাফরুল ইসলাম প্রধান যিনি এখন খন্ডিত অংশের সাধারণ সম্পাদক, শাজাহান ভাইয়ের ছেলে, ও তো সমস‍্যা। আগস্ট মাসে, আগে থেকই হয়তো সমস‍্যা ছিল, কিন্তু আগস্ট মাসের দুই তারিখে ওরা আলাদা হয়ে ভাগ হয়ে গেছে।

শা.বি.র.: কী ঘটনার কারণে আদালা হওয়া হৈল? এবং আপনার সাথে কি জ‍্যোতির্ময় বড়ুয়া উনাদের যোগাযোগ নাই? বা উনারা যোগাযোগ করেন না?

ফি.বা.: আছে। কিন্তু গতকাল উনারা যা করলেন, সেটা তো বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করলেন। এই যে আমাদের লোকগুনাকে ডেকে, যাতায়াত ভাড়া, বকশিশ দিয়ে ঢাকায় নিয়ে সমাবেশ করলো। এটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে এখানে।

২০১৬ সালে হামলার শিকার হওয়ার পর সাঁওতাল-বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসন অনেকগুলো মামলা দেয়, সেই সব মামলার একটাতে হাজিরা দিতে এসে গোবিন্দগঞ্জে ফেরত যাওয়ার আগে বাসে উঠার আগের মুহূর্ত। ফিলিমন বাস্কের বাম পাশে মাঝি হেমব্রম, কয়েক মাস আগে যিনি মারা গেছেন। ছবি: শামীমা বিনতে রহমান, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

শা.বি.র.: এটা কেন করলেন উনারা? আপনার কি ধারণা?

ফি.বা.: এসব তো আর একদিনে হয় নি, এক দিনে আসে নি। এটা তো এখন পরিস্কার হচ্ছে যে ডাক্তার জাফরুল্লাহ, হাসনাত কাইয়ুম, জ‍্যোতির্ময় বড়ুয়া ইনারা কোন না কোনভাবে তো এই নতুন গ্রুপ বা ভাঙ্গনকে সমর্থন করেছেন,  কারণ আমাদের লোকজনেরা যারা ঢাকায় গেছে, তারা তো তাদের সাথেই দেখা করেছে, অন‍্যদের সাথে তেমন দেখা করে নি। এএলআরডি, আইন সালিস কেন্দ্র, নিজেরা করি, ব্রতী, মানে যারা আন্দোলনের শুরু থেকে ছিল, তাদের কারো সাথে দেখা না করে এরা উনাদের সাথেই দেখা করেছিলেন। এখন তো পরিস্কার হচ্ছে ঘটনাটা। বার্নাবাসরা ঢাকা থেকে ফিরে এসে বলে, ডাক্তার জাফরুল্লাহ সাহেব আমাদের জন‍্য সব করছেন, আর কেউ করে নি। তারপর বল্লো, ব‍্যারিস্টার বড়ুয়া নাকি সব করায়ছেন। হাইকোর্টের জামিন করায়ছেন, উনি মামলা পরিচালনা করেছেন, উনিই সব করেছেন, এরকম আর কি। এখানে আসলে অনেকে অনেক কিছুই করেছেন ২০১৬’র ঘটনার পর। শুধু কাউকে কাউকে বড় করে বাকীদের অবদান মুছে দিলে তো বিভাজন হবেই। 

শা.বি.র.: এরকম একটা আন্দোলন আপনারা ২০১৬ থেকে করতেসেন এক সাথে, আবার এরমধ‍্যে দুইভাগ হয়ে গেলো . . .

ফি.বা.: এইটা মোটেও ভালো না, ভালো নয়। এটা কখনো প্রত‍্যাশা করি নি, আমি যখন আন্দোলন শুরু করছিলাম, কোন দিনও এটা এক্সপেক্ট করি নি। কোন দিনই নয়। কোন দিনও এটা আশা করি নি। কিন্তু এইটা যে একটা গভীর ষড়যন্ত্র, আরো আগে থেকে দানা বাঁধছিল, বুঝতে পারি নি, কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম আইডেন্টিফাই করতে পারি নি, কার দ্বারা এটা হচ্ছে। সেইটা বুঝা একটু কঠিন ছিল। 

আমাদের বাপ-দাদার জমি আমাদের হাতে ফেরত না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবো, চালাতে তো হবেই। এই জমিতো এখন আর সুগার মিলের না, সুগার মিল তো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন রিক‍্যুইজিশন অব প্রপার্টি অ‍্যাক্ট ১৯৪৮ অনুযায়ি আমাদের কাছে আমাদের বাপ-দাদার জমি ফেরত দিয়ে দেয়ার ব‍্যবস্থা করলেই হয়। দেখা যাক। এখন তো জটিলতা আগের তুলনায় কম জমি ফেরত দেয়ার। ওই জমিতেই আমরা এখন চাষবাস করছি, কেউ কিছু বলছে না, কিন্তু কাগজ-পত্র না হলে তো এই চাষবাসের ওপরেই আবার হামলা হবে, বুঝলেন না?

শা.বি.র.: উমম-মম। দাদা, আপনাকে একটা লেখা পাঠাইছিলাম, অনুবাদ লেখা, ক‍্যানাডার একটা আদিবাসি সংগঠনের নিজেদের জমি ফেরত আনার আন্দোলন নিয়ে, সেইখানে ওরা “ল‍্যান্ড ব‍্যাক” শব্দটা ব‍্যবহার করছে। তো ওখানে যে আন্দোলনটা হচ্ছে সেইটা হৈল আদিবাসিদের জমির উপর দিয়ে সরকার যে পাইপলাইন বসাবে তেল পরিবহনের জন‍্য, সেটা ঠেকায়া দেয়া, ওখানকার যে আদিবাসি উনাদের নাম সেকয়‍্যেপম‍্যাক . . .

ফি.বা.: কি নাম বল্লেন?

শা.বি.র.: সেকয়‍্যেপম‍্যাক, একটু খটর মটর নাম। আপনি লেখাটা পড়লেই পাবেন ওইখানে। তো উনারা করছেন কী, যেই রাস্তা দিয়ে সরকার পাইপ লাইন বসানোর প্ল‍্যান করছে, ওইটার উপরই ছোট ছোট বাড়ি করছেন, চাক্কাঅলা বাড়ি যাতে করে সরকার ঝামেলা করলে চাক্কাঅলা বাড়ি দ্রুত সরানো যায়। কিন্তু ওই ছোট ছোট ঘর-বাড়িগুলা করার কারণে অ‍্যামেরিকান যে কোম্পানি তেলের পাইপ বসানোর কাজ পাইছে, ওরা আর কাজ আগাইতে পারতেসে না। ২০১৭ সাল থেকে ওই আদিবাসিরা এইরকম অ‍্যাক্টিভিটিজ করে পাইপ বসানোর কাজ আটকায়া রাখছে আর কি। তো এই আন্দোলনে যিনি মেইন সংগঠক, উনার নাম হচ্ছে ক‍্যানাহুস ম‍্যানুয়েল, উনি এবং আরেকজন লেখক আছেন, উনি খুবই পরিচিত দুনিয়া জুড়ে, উনার নাম হচ্ছে আপনার নাওমি ক্লেইন, তো উনাদের দুইজনে মিলে লিখা লেখাটার  মূল বক্তব‍্য হচ্ছে, আদিবাসি সংগঠন যখন পুরানো হয়ে যায়, তখন ওরা অনেক আপোষকামি হয়ে যায়, তখন ওদের মধ‍্যে অনেক বিভক্তি হয়, ওরা মূল দাবি থেকে সরে আসে। কোন কোন গ্রুপ আবার সরকারের সাথে আপোষে যায়। সেই জন‍্য, যত যাই কিছুই ঘটুক, আদিবাসিদের জমি ফেরত চাওয়ার আন্দোলন কখনোই ছাড়া যাবে না। কারণ হিসাবে তারা যুক্তি দেন যে, আদিবাসিদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যে নলেজ আছে, সেই নলেজ দিয়ে তারা যেভাবে জমির ব‍্যবস্থাপনা করতে পারে, জমি উৎপাদনশীল রাখতে পারে, শস‍্য সংরক্ষণ এবং ব‍্যবস্থাপনা করতে পারে, সেইটা ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড নলেজ দিয়ে সম্ভব না।

ফি.বা.: আমিও আসলে একই কথা বলছি, একই রকমই আমার ভাবনা। ওই যে কথা বল্লেন না, আদিবাসিরা দূর্বল হয়ে যায়, আদিবাসিরা আপোষ করে, . . . ওই জাফরুল ছেলেটা না, ও এতো ডাহা মিথ‍্যা কথা বলে যে আমাদের লোকজনেরা সবাই বিশ্বাস করে আর কি, মিথ‍্যা কথা এত সুন্দর করে গুছায়া বলে, কথায় কথায় বলে আমি দাড়ি রাখছি, আমি নামাজ পড়ি পাঁচ ওয়াক্ত, আমাকে বিশ্বাস করো না? কী বলবো বলেন! আমাদের বাপ-দাদার জমি আমাদের হাতে ফেরত না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবো, চালাতে তো হবেই। এই জমিতো এখন আর সুগার মিলের না, সুগার মিল তো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন রিক‍্যুইজিশন অব প্রপার্টি অ‍্যাক্ট ১৯৪৮ অনুযায়ি আমাদের কাছে আমাদের বাপ-দাদার জমি ফেরত দিয়ে দেয়ার ব‍্যবস্থা করলেই হয়। দেখা যাক। এখন তো জটিলতা আগের তুলনায় কম জমি ফেরত দেয়ার। ওই জমিতেই আমরা এখন চাষবাস করছি, কেউ কিছু বলছে না, কিন্তু কাগজ-পত্র না হলে তো এই চাষবাসের ওপরেই আবার হামলা হবে, বুঝলেন না?

এই বছরের সাঁওতাল হত‍্যা দিবসের পোস্টার। ফিলিমন বাস্কের ফেইসবুক প্রোফাইল থেকে নেয়া।

গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল-বাঙ্গালিদের ওপর ৬ নভেম্বরের হামলা নিয়ে আরো:

সাঁওতাল হামলা ও উচ্ছেদ: মাছ, বিদ্যুৎ, ইকোপার্ক, ফাইভস্টার হোটেলের মেগা প্রকল্প গোবিন্দগঞ্জে/ নভেম্বর১৮, ২০১৬

পুলিশের ভয়: পালিয়ে থাকা গুলিবিদ্ধ ২ সাঁওতাল নারী-পুরুষের গল্প/ নভেম্বর ১৯, ২০১৬

“Jomi Hobe”!? : A glimpse of everyday life of the displaced Santal/ ডিসেম্বর ২৪, ২০১৬

চরণ সরেন: ‘ আর আমার ডাইন পাশে তীর খাওয়া পুলিশ আছিল ৩ জন. . . হা হা হা . . .’/ ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৭