fbpx

একটা সঘন দুপুর দিনে

শামীমা বিনতে রহমান

দুপুর ১টায় বাসা থেকে বের হয়ে গলির মাথায় আয়াস সাধ্যের মধ্যে একটা সিএনজি অটোরিকশা পেয়ে গেল মৃ। মোহাম্মদপুরে যাবে, মোহাম্মদপুর সোসাইটিতে। ওইখানে কমলকুমার মজুমদারের ‘প্রেম’ গল্পের মতো ‘ভাঙ্গা টবের নয়নতারা ফুল’ অপেক্ষায় নাই, তবে মোহাম্মপুর সোসাইটির ২ নম্বর রোডে একজন আন্ডারগ্রাউন্ড মেথসেবি অপেক্ষায় আছে। মানে শহরে ক্রিস্টাল সাদা ফুল ফোটে।

ডাইনিং টেবিলের এক পাশে একজন বয়সী নারী খালি গায়ে চশমা পরে বসে আছেন। মৃ তাকে নম্রভাবে সালাম দিলো,মেথসেবী বল্লো,“ উনি চোখে দ্যাখতে পান না।”

অনেকদিন পরে তাহাদের দেখা যাবে একসাথে। এরমধ্যে মৃর প্রেম হৈসে,মেথসেবীর প্রেম বদলাইসে, ঢাকার বাতাসও পাল্টাই্সে। ২ নম্বর রোডের গলির মাথায় মেথসেবীকে দেখেই অটো ছেড়ে দিলো মৃ কিন্তু টাকা ভাংতি ছিল না। ওরা ভাংতির উদ্দেশ্যে একটা কোকাকোলার তরল পানীয় বোতল কিনলো। গলির ভিতর একটু হেঁটে একটা বহুতল বাড়ির চতুর্থ তলায় উঠে সরাসরি একটা ফ্ল্যাটে ঢুকে গেল।

ডাইনিং টেবিলের এক পাশে একজন বয়সী নারী খালি গায়ে চশমা পরে বসে আছেন। মৃ তাকে নম্রভাবে সালাম দিলো,মেথসেবী বল্লো,“ উনি চোখে দ্যাখতে পান না।” আরেকটা বয়স্ক কিশোর এসে হড়বড় করে কি যেন বল্লো,বোঝা গেল না, কিন্তু সম্ভাষনের মতো। মেথসেবী বল্লো, “ও আমার ছোট ভাই, কিন্তু কথা বলতে পারে না ঠিকঠাক। চলেন আমার ঘরে গিয়া বসি।”

ঘরের মধ্যে একটা ব্যাচেলর গন্ধ,গার্লফ্রেণ্ড আসে খুব একটা, সেরকম স্মেল নাই।একটা ময়লা রঙ্গিন রঙ ঘোরাঘুরি করছে বিছানায়, ফ্লোরে, বুকশেল্ফে। এতক্ষণ পর প্রথমবারের মতো পূর্ন চোখে চাহনি বিনিময় হলো তাহাদের। তাদের।

. . .কনা ক্যামন তরল হয়ে গলতে থাকে, যেন একটা ঝিরি বয়ে যাচ্ছে ব্রোঞ্জের টিলা বেয়ে। জানালার ওপাশে একটা খরখরে দুপুর সিনা টান টান করে টহল দিচ্ছে।

আপনার কি মনে আছে, আপনি আমার ২ হাজার টাকা নিয়া যে আর ফেরত দ্যান নাই।

মেথসেবী তার অসম্ভব সুন্দর হাসি দিয়া তাকায়া থাকলো। যেন এসব মনে রাখার কী আছে!

ওরা লাইটারের সিরিঞ্জ আলোয় মিহি মিহি সাদা কনা গলাতে থাকলো। কনা ক্যামন তরল হয়ে গলতে থাকে, যেন একটা ঝিরি বয়ে যাচ্ছে ব্রোঞ্জের টিলা বেয়ে। জানালার ওপাশে একটা খরখরে দুপুর সিনা টান টান করে টহল দিচ্ছে। গ্যারেজ বা অন্য কোথাও, গলিতে মেইবি, মোবাইল ফোনে হাসপাতাল বিষয়ক কথাবার্তা হচ্ছে।

মেথসেবীরও মোবাইল ফোনে কল বেজে উঠল। সে ঠাণ্ডা, উত্তেজনাহীন আঙ্গুলে স্ক্রীন স্পর্শ করে হ্যালো বলে মৃর দিকে থাকা মুখটা ডান দিকে ষাট ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরায়া কথা বলতে থাকলো।

ফোন রাখার পর মৃ জিজ্ঞেস করলো, আপনার ডেইলি কত ক্লায়েন্ট?

জিনিসটা এক্সপেনসিভ। লোকালি প্রোডিউসড হয় বলে লাভ বেশি। মালয়েশিয়ায় ১ গ্রাম মেথের প্রাইস কতো জানেন? ৫২ ডলার। ফাকিং এক্সপেনসিভ। ওর চাইতে অনেক কম দামে বেচি। একটা স্মিত হাসি মেথসেবীর চোখে।

তাইলেতো অনেক টাকা হৈসে লাস্ট ওয়ান ইয়ারে। আপনার সাথে আমার প্রায় দুই বছর পর দেখা না? এর মধ্যে আপনি ডিলার। মেথ ডিলার! ওয়াও, লাইফ ইজ বিউটিফুললি ফ্র্যাজেইল! আচ্ছা এত টাকা দিয়া করেন কি?  আপনার বাসায় তো একটা এসিও নাই। গরমে মইরা যাই। হি হি হি।

শুনেন, আপনি লেফটিস্ট হন বা আনু মুহাম্মদ হন বা শেখ হাসিনা হন,মানে আপনে যেই লাইনেরই হন, আপনার কর্পোরেট নেক্সাস নাই তো আরবান ক্রাউডে জিরো।

মেথসেবী হো হো করে হেসে উঠলো। তার শরীর দুলে উঠলো, তারপর থুতনিটা একটু নীচে নামায়ে চোখটা উপরে তুলে বল্লন, আরবান ক্রাউডে নাম করতে হৈলে সোজা রাস্তা মিডিয়া করা। ধরেন মিডিয়া করলে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান আসবে, মিডিয়া পার্টনার করার জন্য। একটা নেকসাস তৈরি হবে। কর্পোরেট-এনজিও-মিডিয়া. . . শুনেন, আপনি লেফটিস্ট হন বা আনু মুহাম্মদ হন বা শেখ হাসিনা হন, মানে আপনে যেই লাইনেরই হন, আপনার কর্পোরেট নেক্সাস নাই তো আরবান ক্রাউডে জিরো।

ওকেই। সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং।

অনলাইন মিডিয়া করা তো বেশি এক্সপেনসিভ না। ওইটাই এখন টার্গেট। আমার প্ল্যান বলে, ১ কোটি টাকা ইজ ফাইন ফর স্টার্ট আপ। আমার টার্গেট একবছর। আর সায়াদাবাদী পীরের এক ফলোয়ার, সিরিয়াস ফলোয়ার, উনিও একটা টিভি মিডিয়ায় আছেন, উনি বলসেন, শুরু করার পর উনি ইনভেস্ট করবেন। আমার বিজনেস আইডিয়ায় উনি মুগ্ধ।

প্লিজ দ্যাখেন,আপনি এথিকসের নামে মিডিয়ায় কি হাইড করতেসেন? রিয়্যালিটি। ইজন্ট ইট? আপনি গালের মধ্যে কোপানো,চোখের ভিত্রের গুলি লাগা ফেইস,এইসব রিয়্যাল ইমেজ বাদ দিতেসেন এথিকসের দোহাই দিয়া। কিন্তু দ্যাখেন,এইসব ছবি তো আপনি আটকায়া রাখতে পারতেসেন না . . .।

মৃ বিস্ময় নিয়া শুনতে থাকলো। মিডিয়া ব্যবসা? ইউফোরিয়ার ব্যবসা থেকে মিডিয়া ব্যবসা! মৃ বলতে থাকলো, উম। আচ্ছা। কিরকম আপনার আইডিয়াটা ?

প্লিজ দ্যাখেন,আপনি এথিকসের নামে মিডিয়ায় কি হাইড করতেসেন? রিয়্যালিটি। ইজন্ট ইট? আপনি গালের মধ্যে কোপানো, চোখের ভিত্রের গুলি লাগা ফেইস, এইসব রিয়্যাল ইমেজ বাদ দিতেসেন এথিকসের দোহাই দিয়া। কিন্তু দ্যাখেন, এইসব ছবি তো আপনি আটকায়া রাখতে পারতেসেন না এই স্যোশাল মিডিয়ার যুগে। আবার রেইপের ছবি বা ভিডিও-ও না। সবই দেখা যায় ফেইসবুকে, ইয়্যুটিউবে। হা হা হা. . . হিয়ার ইজ দ্য বিজনেস। হরর ইজ প্লেজার। ইটস নট ফিল লাইক প্লেজার, ডাইরেক্ট প্লেজার। ভয়ের মধ্যে আনন্দ। আর সেটাতেই হিট হবে বেশি। মিডিয়া বিজনেস।

মৃ মেথসেবীর দিকে তাকায়া তাকায়া ভাবতে থাকলো, টেলিভিশনের টক শোতে ওকে ক্যামন লাগবে। ও কি এইরকম টি শার্ট, থ্রি কোয়ার্টার পইরা যাইতে পারবে? ও আসলে কি চায়? ওর মিডিয়া ব্যবসার লক্ষ্য কি? সুশীল হওয়া? এলিট হওয়া? আহ!

মৃ ভাবতে থাকলো, আমারো এলিট হৈতে ইচ্ছা করে। এলিটের চামড়ায় কোন রিঙ্ক্যাল নাই। মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্তরা কীরকম মুগ্ধতা নিয়া কথা শুনে এলিটের, যত্ন করতে মন বাড়ায়ে দেয়।

মেথসেবী লাইটার, কয়েন এসব গুছাতে গুছাতে বল্লো,একটা পার্টি আছে ধানমণ্ডি ৩ নম্বরে, চলেন যাই। আমার রেগুলার ক্লায়েন্টরা আসবে অনেকেই। তারপর হঠাৎ দুই ভ্রুর মধ্যে একটা ঢেউ এনে মৃর চোখের ভিত্রে তাকায়া বল্লো, “নাকি এইসব নিষিদ্ধ, আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেটের ডিলে যাইতে দ্বিধা লাগতেসে? হা হা হা . . .।”

একটা বিড়াল রুমের এক কোনায় লেজ গুটায়া বসে ছিল। মেথসেবীর প্রিয় বিড়াল। এখন ম্যাঁও ম্যাঁও করে হাঁটাহাঁটি শুরু করলো, মেথসেবীর কাছে এসে লেজ উঁচু করে আল্লাদ চাইতে থাকলো।

আসলেই কিন্তু একটা দ্বিধা ঘুরতেসে মৃর মাথার এইপাশ-ওইপাশ। দ্বিধার গ্রস্থতায় একটা আনন্দ হচ্ছে, একটা উত্তেজনা হচ্ছে। এম্নিতেই আড়াই বছর পর অ্যামেরিকা থেকে ফেরত আসার পর শহরটা কেমন য্যান দূরে সরে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল মৃর।

গিজগিজে রিকশা সব শিয়া মসজিদ মোড়গামী টেম্পু আর সিএনজি-অটোর সাথে ঘষাঘষি করতে করতে একটা খোলা স্যুয়ারেজ ড্রেনের মতো আগাতে থাকলো।

অবশ্য মৃকে হাসপাতালে যাইতে হবে। একজন সাবেক জাঁদরেল আইনজীবী, মানে তার বড় জ্যাঠা শুয়ে আছেন হাসপাতালের বেডে। তার সাথে দেখা করার কথা আজকেই। কিন্তু মৃ তাকে বল্লো,“ফ্যানটাসটিক আইডিয়া।”

বাইরের বাতাসে তখন বিকাল শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তখনো সন্ধ্যা নামে নাই শহরে। গিজগিজে রিকশা সব শিয়া মসজিদ মোড়গামী টেম্পু আর সিএনজি-অটোর সাথে ঘষাঘষি করতে করতে একটা খোলা স্যুয়ারেজ ড্রেনের মতো আগাতে থাকলো।

এই মৃর সাথে এই মেথসেবীর পরিচয় শহরের উষ্ণতম মাসে। পুরান ঢাকায় নর্থব্রুক হল মিলনায়তনে একটা আর্ট এন্টারপ্রেন্যুয়রর্স প্রদর্শনীতে। তখন তার একটা কুকুর ছিল। সে একটা ক্যামেরা আর একটা কুকুর নিয়া আসছিল। আর  মৃ, ও গেসিলো আর্টিস্ট হিসাবে। মৃর তখনো বেশি ভাল্লাগে নাই মেথসেবীরে। কারণ, তখনো মেথসেবী মনে করতো, আর্ট বেচে আর্টিস্ট হতে গেলে এলিট ক্লায়েন্টকেই টার্গেটগ্রুপ ভাবতে হবে।

ঠিক সেটাও না। মেথসেবী হচ্ছে এইরকম আর কি, স্কুল-কলেজ-ইয়্যুনিভার্সিটি শেষ করার পর নানা খোপ-খোপ বাসিন্দাদের সাথে , মানে ফটোগ্রাফার-গ্রাফিতি আর্টিস্ট-পেইন্টার-ব্লগার-অ্যাক্টিভিস্ট-রাইটার-সিনেমাকর, মানে আড্ডায় যাদের পাওয়া যায় বেশি, এইরকম খোপ-খোপ অলাদের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার মতোই মেথসেবীর সাথে বন্ধুত্ব মৃর। প্রায় ৫/৭ বছরের সম্পর্ক। প্রথম দিকে বেশ ঘন ঘন আঠার মতো আড্ডা চলতো শাহবাগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার নানান টেম্পোরারির অটোনোমাস জোনে,এরপর সেটার বদল ঘটে, বেশিরভাগ ফেইসবুক আর কমভাগ মোবাইল ফোনা-ফুনিতে। ওইসব আড্ডায় প্রতিভা আর প্রফেশনাল আইডেন্টিটির টনটনে প্রকাশে এসব বন্ধুত্বে আপনেঅলাই বেশি। মেথসেবী এরকম এক আপনি, যে তার ২ বছরের বাচ্চাসহ বউয়ের প্রস্থানের পর একবছর আটকায়া গেসিল। চাকরি-বাকরি ছেড়ে, সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরা ঘরে বসে ছিল।

সেই সময়টায় মৃর সাথে মেথসেবীর মাঝে মাঝে কথা হোত স্কাইপে। মৃ তখন পড়াশুনা করতো ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটিতে। ওকলাহোমার নরম্যান শহরে মে মাসের টর্নেডোর মত মেথসেবী হঠাৎ-তীব্রতায় স্কাইপ কল করতো আর কান্নাকাটি করতো। তারপর অনেকদিন কথা নাই, কারণ তখন মৃ তার প্রেমের চুড়ান্ত সেনসেশনে। ও মেথসেবীর হৃদয় ভাঙ্গনের গল্প ভুলে গেল। শেষ তথ্য ছিল এইটুকুই: বউ-মেয়ে চলে যাবার পর ও মা আর ছোট ভাইর সাথে থাকে মোহাম্মদপুরে।

এরপর দেশে ফেরত আসার পর ফেইসবুক চ্যাটিংয়ে মেথসেবী জানালো শহরের গোপন গেরিলা ব্যবসার কথা। মেথশিল্পের ব্যাবসা। মৃর তখন মনে হলো, ওর এই পুরানা বন্ধুর মতো অবন্ধুর সাথেই দেখা করতে হবে প্রথমে। জীবন মানেই উন্মোচন। শহরের এই নতুন গেরিলা গলির উন্মোচন না হলে তো হবে না। ধীরে বহে না মেঘনা।

মৃ ঢাকায় ফেরত আসার পর সবার আগে তাই মেথশিল্পের গল্প খুঁড়তে বের হলো। মেথসেবী তাকে বল্লো, কীভাবে তার বন্ধুরা একটা ল্যাবরেটরী বানায়ে ৯০ দিন একটানা শ্রম দিয়ে বের করে নিয়ে আসে মেথেম্ফাটামিন। উত্তেজনাকর নির্ঘুম রাত, নানা রাসায়নিক যোগ-বিয়োগ, টাইম সেট-রিসেট এবং অত:পর বিশ শতকের শুরুর দিককার জাপানীদের আবিস্কার ঘাসফুলের মতো ফুটে উঠলো একুশ শতকের এই শহরে। তবে ফুলের পাপড়ি থেকে মেঘ-মেঘ উড়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানী যুদ্ধ বিমান পাইলটদের সাদা-কনায় ডুব দিয়ে সুইসাইডাল মিশনে ভেসে যাওয়ার গল্প, পাপড়ির প্রান্তে সূর্যের আলোয় চিকচিক করে জমে থাকে এক স্বল্পস্থায়ি সার্বভৌমত্বের ইশারা।

এরপর ওদের নেটওয়ার্ক তৈরি শুরু ডার্ক ওয়েবে। উৎপাদক গ্রুপ ভাগ হয়ে আলাদা আলাদা ডিলার হয়ে উঠলো।

রিক্সা এসে থামলো ধানমন্ডির পেটের ভিত্রে, একটা শাদা ৩ তলা বাড়ির সামনে। মেথসেবী বলে উঠলো, “এইখানে, এই পার্টিতে রিকসা দিয়া কেউ আসে? হা হা হা । এরপর আমরা গাড়ি দিয়া আসুম।”

ভেতরটার আমেজ আসলে একটা হোম পার্টির। ৩০/৩৫ জনের মতো গেস্ট। একজন সাবেক সরকারি আমলার বাড়ি, কিন্তু উনার ছেলে নাকি উনি, কে যে হোস্ট কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। মেথসেবী দুইজনের সাথেই পরিচয় করায়ে দিলো মৃকে। এইখানে ওর পরিচয় অ্যামেরিকা থেকে পড়ে ফেরত আসছে।

মৃ হঠাৎ খেয়াল করলো,আরে! তার পরিচিত লোকজনও দেখা যাচ্ছে। রাফিনকে দেখা যাচ্ছে। রাফিন ড্রামার। এত্ত দারুণ বাজায় ও, কিন্তু নির্দিষ্ট কোন ব্যান্ডে বাজানো শুরু করে নাই এখনো। মৃর মুখ ঝলমল করে উঠলো রাফিনকে দেখেই। দোস্ত তুই একটা চান্দের আলো।

মৃইইই-ই-ই-ই! তুই! ও মাই দোস্ত! হোয়েন ডিড য়্যু গেটব্যাক হোম?

ইটস বিন টু মান্থস. . .। আবার একটা হাসি এবং খলবল আওয়াজে কেউ কেউ ঘাড় ঘুরায়ে দেখতে থাকলো তাদের।

এই পার্টিতে ব্যাবসায়ী, আমলা, সিঙ্গার, গিটারিস্ট, লিরিসিস্ট, সাংবাদিক অনেককেই দেখা যাচ্ছে। কারো কারো সাথে বিদেশী বন্ধু আছে। কেউ একা একা আসছে, কেউ দুইজন, গ্রুপেও আসছে, বেশিরভাগই বেশিরভাগের পরিচিত। কেউ কেউ ফেইসবুকে বন্ধু ,এখানে মুখোমুখি সাক্ষাৎ। কিন্তু মেথসেবী মৃকে কোন ধারনাই দেয় নাই, এদের মধ্যে কারা তার ক্লায়ান্ট। বরং মেথসেবী হারায়া গেল যেন কোথায়।

. . . আরে সেভেন্টি ফাইভের আগেই তো বঙ্গবন্ধু কিলড। হোয়াট ডিড হিজ ব্যুরোক্রাটস ডু ইন দৌজ ডেইজ? মোস্ট অফ দ্যাম ডিডন্ট ডু অ্যানিথিং। মি. কেবিনেট সেক্রেটারি,হি অনলি নিয়্যু বাটারিং অ্যন্ড মেইড বঙ্গবন্ধু আ্যাজ হযরত। হযরত শেখ মুজিবর রহমান। হা হা হা. . .।

একটা ফ্লোয়িং-গোয়িং, ঢেউয়ের মতো আড্ডা চলতেসে ছোট ছোট গ্রুপে। গ্রুপ এক্সচেইঞ্জ করে অনেকই এইগ্রুপ ওইগ্রুপে বসছেন। এরমধ্যে টুপাক, বিয়ন্সে, বি মোর চিল, রেডিওহেড, পিংক ফ্লয়েড সব মিক্সড গান চলছে, লাউড। ল্যাপটপ থেকে বাজানো হচ্ছে গান। রাফিনও আরেকজনের কাছ থেকে গিটার নিয়ে গান শুরু করে দিল বব ডিলানের “স্যারা”। মৃ এই গ্রুপটার ভিত্রেই। হঠাৎ একটা উঁচু গলা রুমের ভিতর।

. . . আরে সেভেন্টি ফাইভের আগেই তো বঙ্গবন্ধু কিলড। হোয়াট ডিড হিজ ব্যুরোক্রাটস ডু ইন দৌজ ডেইজ? মোস্ট অফ দ্যাম ডিডন্ট ডু অ্যানিথিং। মি. কেবিনেট সেক্রেটারি,হি অনলি নিয়্যু বাটারিং অ্যন্ড মেইড বঙ্গবন্ধু আ্যাজ হযরত। হযরত শেখ মুজিবর রহমান। হা হা হা. . .।

আরেক পাশ থেকে আরেকটা উঁচু গলা বলতে থাকলো, জোরে জোরে, অ্যানাউন্সমেন্টের মতো: নো পলিটিক্যাল টক, প্লিজ। ইটস ওনলি ফান টাইম।

একটা হা হা হা-হো হো হো হাসি হল রুমের এ মাথা ওই মাথা গড়াগড়ি করতে করতে সাবেক আমলার মুখে গিয়ে মিলায়ে গেল। মৃর সমস্ত মনোযোগ হোয়াটসঅ্যাপের চ্যাটিংয়ে। এত দ্রুত টাইপ করছে সে আর তার মুখে এমন এক ছায়া, বাসের ভীড়ের মতো ঘন আর উদ্বেগময়।

মেথসেবী ফেরত আসলো অনেকক্ষণ পর। মৃ টাইপিং থেকে চোখ তুলেই দেখে একটা ৫ ফুট ৫ থেকে ৭ ইঞ্চির শরীর  ফ্লোরে বসার ভঙ্গীতে বাঁকা হচ্ছে। “কই হারায়া গ্যালেন! কাকে কাকে য্যান দেখলাম আপনাকে খোঁজ করতেসে”।

সারিয়া কল করসিল। ও আসলে হঠাৎ করে কল করলো এমন না। আমরা গত ছয় মাস ধরেই ট্রাই করতেসিলাম আবার এক সাথে থাকা যায় কি-না।

চোখের নীচে মুখের চামড়া কাঁপতেসে। সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর সম্পর্কের দরজায় গিয়েও আর দাঁড়ানো যাবে না কোনমতেই, এইরকম মানবিক তালা যখন লেগে যায়, মেথসেবীকে সেরকম দেখাচ্ছে।

মেথসেবীর চোখ নখের দিকে অথবা ফ্লোরের দিকে, মৃর মুখের দিকে না। সে এবার ডানদিকের সোফায় বসা বয়স্কদের আড্ডার খোপ থেকে চোখ ঘুরায়া নামাতে নামাতে চোখের কোনায় পানি ঠেলে উঠলো। টলমল। নাকটার আগা লাল। ওর গলার স্বরে জমানো কান্নার হেঁচকি। মেথসেবী বলতে থাকলো, “কিন্তু ও আমাকে শর্ত দিল পরিষ্কার। ও আবার ফেরত আসবে,যদি ওর এখনকার বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারে একই বাসায়, আমাদের সাথে। এটা কি হয় বলেন?”

মেথসেবী নাক মুছলো। ওর কপালের চামড়ায় কনা কনা ট্রান্সপারেন্ট ঘাম। চোখের নীচে মুখের চামড়া কাঁপতেসে। সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর সম্পর্কের দরজায় গিয়েও আর দাঁড়ানো যাবে না কোনমতেই, এইরকম মানবিক তালা যখন লেগে যায়, মেথসেবীকে সেরকম দেখাচ্ছে।

ও কীভাবে শর্ত দিসে জানেন? আমাদের মেয়েটা নাকি ওর বয়ফ্রেন্ডকে ছাড়া থাকতে পারবে না। মেয়ে আমার। আমার মেয়ে। আমার মেয়ে নাকি ওর বয়ফ্রেন্ড ছাড়া থাকতে পারবে না!

মেথসেবী এইবার কাঁদতে থাকলো দুমড়ানো-মুচড়ানো কারের মতো, সেলুনের কাঁচির মতো, পাশের ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসা বিলাপের মতো।

মৃর মনে হলো, এই যে শহরটা চেনা যাচ্ছে এখন। এই শহরে অনেক রকমের ধোঁয়া। ধোঁয়ার পার্টনারশীপ: ব্যক্তিগত গাড়ির ধোঁয়ার সাথে অব্যক্তিগত বাসের ধোঁয়া, তাহাদের সাথে কিচেনে খাবার রান্নার ধোঁয়া আর তারপর ইহাদের সাথে দেয়ালের ভেতর দরজা বন্ধ ঘরে সিনথটিক ধোঁয়া যেমন গায়ের ওপর ল্যাপ্টালেপ্টি করে, সেইরকম করে মেথসেবী কাঁনতেসে।

বাইরে বৃষ্টি। বৃষ্টি নেমেছে।