fbpx

অল ঘোড়া কন্ট্রোল/ তানভীর চৌধুরী

অধ্যায় ১

‘সাঁই সাঁই, ঘোড়া সাঁই
ঘণ্টার খবর সেকেন্ডে পাই’

১.

দেবপাহাড়ের রাস্তা ধরে উপরে উঠছি, যেখানে রাস্তা শেষ সেখানে একটা বৌদ্ধ মন্দির, মন্দিরের পাশে লিলি খালার বাড়ি। লিলি খালা আমার আপন খালা না—ডাকা খালা। লিলি খালা দুবাইতে বসে হুন্ডি ব্যবসা করে। আমি দেশে তার ব্যবসা দেখাশোনা করি। কিন্তু তিন বছর ধরে আমার চাকরি নাই। আমার কোম্পানি লিলি খালা তিন বছর ধরে জেলে। আজ সকাল নয়টায় আদালতে নিয়ে আসা হয়েছিল লিলি খালাকে। উকিল আমাদের এইবারও আশা দিয়েছিল জামিন হবে। কিন্তু লিলি খালার জামিন হয় নাই।

আদালত থেকে লিলি খালাকে আবার জেলে নিয়ে যাওয়া হয় প্রিজন ভ্যানে করে। প্রিজন ভ্যানে ওঠার আগে লিলি খালা আমাকে বলে, “রিয়াজুদ্দিন বাজারে নূর আলমের দোকান থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলে একটু আমার ছেলেরে দিয়ে আসবে?”

আমি বলি, “ইয়েস, বস।”

প্রিজন ভ্যান চলে যায় পাথরঘাটার দিকে, চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল জেলে। আমি একটা রিকশা নিয়ে চলে আসি রেয়াজুদ্দিন বাজার। রেয়াজুদ্দিন বাজার থেকে টাকা নিয়ে বাসে উঠে চলে এসেছি দেবপাহাড়ে। আমি দেবপাহাড়ে এসেছি লিলি খালার ছেলে বাবলুকে টাকা দিতে।

বাবলুকে কিন্তু বাবলু ডাকা যায় না। সে নিজের নাম রেখেছে জন। জনের টাকা দরকার হয় কেন? লিলি খালা কখনো ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে না যে কেন তার ছেলের টাকার দরকার হয়। খালুতো কবরে — তারে জিজ্ঞাসা করার কোনো সুযোগ নাই। আমি তার দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই ও বয়সে দুই/তিন মাসের বড় হলেও বন্ধুর মতো। তবু তাকে ডিরেক্ট জিজ্ঞাসা করি না কিছু। আগে ভাব বুঝি। জন কি বুঝতে পারে তার আম্মু মানে লিলি খালার মানে তার নিজের উপরও কী গজব বয়ে চলেছে?

জনের এইসব নিয়ে কোনো বিকার দেখা যায় না। মা জেলে, মায়ের ব্যবসা বন্ধ। কিন্তু জনের ফুটানি সীমা ছাড়িয়ে যায়। লিলি খালার বাসার কলিং বেল চাপি। অনেকক্ষণ পর দরজা খুলে দেয় জন।

জন পাঁচ লাখ টাকা প্রায় পাঁচ বার গুণে দেখে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, “খালারে দেখতে যাবা না, জন?”

জন বলে, “নট জন, নট জন, ব্রো, আমার নাম স্যামুয়েল। একদমই টাইম নাই আমার। খুব্বি বিজি স্ক্যাজুয়্যাল, ব্রো।”

তার মানে জন এখনো বুঝতে পারছে না তার জীবনের উপর দিয়ে কী আজাব বয়ে যাচ্ছে। তার মা জেলখানায় ক্ষয় হয়, কিন্তু স্যামুয়েল আছে অন্য ওয়েদারে, যেখানকার আবহাওয়া তার নাম বদলে দেয় যখন তখন। প্রতি বার নাম বদলে বলে—”এটা ফিক্সড। আর কোনো নাম নিব না, আস্রাফ আস্রাফ নাম চেইন্জ।”

আমিও আছি অন্য ওয়েদারে, আমি এই নভেল লিখতে চেষ্টা করছি। আমি স্যামুয়েলকেকে বলি, “জন, ও স্যরি, স্যামুয়েল, আমার ফার্স্ট নভেলে আমি তোমারে নায়ক হিসাব কাস্ট করছি।”

স্যামুয়েল আমাকে বলে, “তুমি আমাকে কীভাবে কাস্ট করবা? আমিই তোমারে আমার নভেলে রাইটার হিসাবে কাস্ট করলাম। লিখতে থাকো, ব্রো।” স্যামুয়েলের এই রগট্যারা বিহেভ আমি ভালোবাসি। এই ভালোবাসা আমাকে আমার চাকরি হারিয়ে ফেলার বেদনা থেকে বের করে নভেলের দিকে নিয়ে আসে। আমি হিরোকে জিজ্ঞাসা করি, “পাঁচ লাখ টাকা দিয়া কী করবা, খালাতো ভাই?”

খালাতো ভাই আমাকে উত্তর দেয়, “ঘোড়া কিনবো ব্রো, ঘোড়া।”

ঘোড়া তো সারে জাহান ঘোড়া, দুনিয়ার সব ইন্জিনে ইন্জিনে ঘোড়া, আমি, তুমি, সে, চাঁদ, পাখি, খুন, থিওরি, বিপ্লব সবই তো ঘোড়া। বাবলুর মেটাফোর থেকে আমি কোনো উত্তর বের করে আনতে পারি না। বাবলু উত্তর দিবে না।

২.

মাহতাবউদ্দিন বাবলু ওরফে স্যামুয়েল প্রেস্টন তার সাতাশ বছর বয়সী জীবনে ইসলামি বিপ্লব, মিউজিক, ঝুট কাপড়ের ব্যবসা, রেস্টুরেন্ট, গণযুদ্ধ, বিজনেস, মডেলিং, অ্যানার্কি সহ আটাশ পদের ঘটনা ঘটানোর ঘোষণা দিয়ে একটাও ঘটায় নাই। গিটার কিনেছে—শিখে নাই, ব্যবসায়ীদের সাথে ঘুরাফিরা করেছে—ব্যবসা করে নাই, মাওয়িস্ট অ্যানার্কিস্ট-টাওয়িস্ট সবার সাথে মিশেছে, তাদের কোনো কামে আকামে অংশ নেয় নাই, ড্রাগ অ্যাডিক্টের সাথে মিশেছে—ড্রাগস নেয় নাই। ইভেন সিগারেটও খায় না সে। যার সাথে মিশে সে মজা পেয়েছে খালি তার স্ক্রিপ্ট ফলো করে পারফর্ম করে গেছে। এক বছর পর পর তার নাম, লাইফ স্টাইল, কথা, দর্শন বদলায়। এক বছর পর পর তার গান শোনার রুচিও বদলায়। এখন সে শুনছে ‘অর্ডিনারি বয়েজ’ এর গান। তাই এখন তার নাম স্যামুয়েল প্রিস্টন।

আমি জিজ্ঞাসা করি, “সেক্স পিস্তল শোনো না  আর, খালাতো ভাই?”

স্যামুয়েল জবাব দেয়, “সেক্স পিস্তল ক্ষ্যাত, বোগাস, স্ট্যান্ডবাজ, ফেইক।”

কিছু দিন পর সে ‘অর্ডিনারি বয়েজ’কে বলবে ক্ষ্যাত, বোগাস, ফেইক। এক সময় সেক্স পিস্তল শোনা স্যামুয়েল প্রিস্টন পছন্দ করতো আসিফ আকবরের ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’।

বাবলুর রুচি কেন বদলায়?

বাবলুর মা লিলি খালা হুন্ডি লাইনে ঢুকেছে খুব বেশি দিন না। লিলি খালা এই লাইনেই আসতোই না যদি না তার টেক্সি ড্রাইভার জামাই দুবাইতে রোড অ্যক্সিডেন্টে মারা না যেত। জামাই মারা যাবার পর হাউসওয়াইফ লিলি খালা চাকরির সন্ধানে দুবাই চলে যান। দুবাই গিয়ে তিনি হয়ে যান নাইটক্লাবের ড্যান্সার। নাইটক্লাবে তার সাথে পরিচয় হয় তার গ্রাম মানে ফটিকছড়ির এক হুন্ডিঅলার সাথে। হুন্ডিঅলা খালাকে ড্যান্সিং এর চেয়েও অনেক বেশি লাভজনক রাস্তা দেখায়। রাস্তাটা হালকা রিস্কি। খালা ওই হুন্ডিঅলার গোল্ড বিস্কুট বহন করা শুরু করেন। এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে লিলি খালা এই দেশে নিয়ে আসতেন গোল্ড বিস্কুটের চালান।

একদিন গোল্ড বহন করা বন্ধ করে দিয়ে নিজেই ব্যবসা করা শুরু করেন লিলি খালা। আস্তে আস্তে দুবাই বেইজড একটা হুন্ডি সিন্ডিকেট কন্ট্রোল করতে শুরু করেন তিনি। দুই বছরের মধ্যে দেবপাহাড়ে একটা জমি কিনে তাতে এক তলা একটা ঘর করে ফেলেন। ছেলে বাবলুকে ফটিকছড়ির গ্রাম থেকে এনে ভর্তি করিয়ে দেন চট্টগ্রাম শহরের বড়লোকের ছেলেমেয়েরা পড়ে এমন স্কুল মাস্টার মাইন্ডে।

গ্রামের বাবলু শহরের স্কুলে এসে প্রথমে সে তার নাম নিয়ে ক্রাইসিসে পড়ে যায়। সে তার মায়ের সাথে ঝগড়া করে তার নাম এত ক্ষ্যাত রাখা হলো কেন। একদিন সে তার নাম বদলে রাখে বাবেল। কিন্তু তাকে বাবেল ডাকতে কেউ রাজি হয় না। শহরের বন্ধুদের সাথে তার কালচারাল গ্যাপ আরো বাড়ে। গ্যাপ কমাতে সে নতুন চাল খেলে। এক দিন বন্ধুদের দেখাদেখি শোনে মেটালিকা, শুনতে খুব বিরক্ত লাগে, তবু সে ধৈর্‍্য ধরে শোনে। এক দিন সে দেখে টারান্টিনো’র  ‘কিল বিল’। দেখতে খুব বিরক্ত লাগে তার, তবু সে দেখে। শুনতে শুনতে সে শুনে ফেলে মেটালিকা, লিনকিন পার্কদের বাপের গান, দেখতে দেখতে সে দেখে ফেলে টারান্টিনোর বাপের সিনেমা।

এখন তার বন্ধুরাই তাকে জিজ্ঞাসা করে—কী গান শোনা যায়, কী সিনেমা দেখা যায়? আর স্যামুয়েল তার বন্ধুদের বলে, “কী ক্ষ্যাত, বোগাস গান শুনস, ব্রো।”

বন্ধুরা নিজেদের ক্ষ্যাতামি ঢাকতে চায়। তাই স্যামুয়েল যা শোনে, পুরা ফ্রেন্ড সার্কেল সেই গান শোনে। স্যামুয়েল যে গানকে ক্ষ্যাত বলে বন্ধুরাও সবাই একযোগে সেই গানকে ক্ষ্যাত বলে। আর বাবলু বাবেল নামও পাল্টায় ও ব্র্যাড পিটের মহিমা প্রচার করে। একদিন ‘পিট’ নামও পাল্টে দেয়, নাম রাখে ‘সিড’ ও সিড ব্যারেটের মহিমা প্রচার করে। তিন/চার মাস পর পর সে নিজের নাম পাল্টায়। সে নাম পাল্টানো ব্যাপারটাকে এত হালকা, এত তুচ্ছ করে ফেলে যে তার বন্ধুরা বাধ্য হয় ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি ডিল করতে।

৩.

বাবলু হিট খেয়ে যায় সারে চট্টগ্রামের বিভিন্ন নেটওয়ার্কে। বাবলুর নাম শুনে তারা তাদের রুচি টিউন করে। তারা বাবলুকে দেখে ঠিক করে নেয় কোন ওয়েদার বয়, কোন প্লেইসে কোন রুচি শো করতে হয়।

কালচারাল গ্যাপ দূর হয়। কালচারাল ভঙ্গি দিয়ে সে ইকোনোমিক্যাল গ্যাপও আড়াল করে রাখতে পারে। কিন্তু একদিন বাবলু প্রেমে পড়ে যায়—ট্রু লাভ। মেয়েটা অনেক ধনীর মেয়ে এরকম না। তবু রুচি, গেটাপ, চাপাবাজি কিছু দিয়েই মেয়েটাকে পটাতে পারে না। ফলে বাবলুর টাকার দরকার হয়। বাবলু মেয়েটার বার্থডে উপলক্ষে পার্টি থ্রো করে মেয়েটাকে ইনভাইট করে, মেয়েটা পার্টিতেই আসে না। বাবলু মেয়েটাকে দেখাতে একটা গাড়ি কিনবে। ফলে তার টাকার দরকার হয়। লিলি খালার মন সায় দেয় না ছেলেকে গাড়ি কিনে দিতে, তার এত পয়সা নাই একটা গাড়ি এফোর্ড করার, তবু একমাত্র ছেলের আবদার ফেলতে পারে না বলে কিনে দেয়।

গাড়ি নিয়ে সে মারজিয়ার সামনে পিছনে ঘোরে তবু মেয়েটা পাত্তা দেয় না। বাবলুর রূহ থেকে শান্তি উঠে যায়, একদিন সে রোড অ্যাক্সিডেন্টে একটা লোককে মেরে ফেলে। ফলে বাবলুর টাকার দরকার হয়। আমাকে দেবপাহাড় এসে বাবলুকে টাকা দিয়ে যেতে হয়। অনেক টাকা দিয়ে এই কেইস থেকে সে নাজাত পায়।

বাবলু অ্যাক্সিডেন্ট করার পর সেই তেমন বড়লোক-না মেয়েটা বাবলুকে জানায় যে এখন থেকে মেয়েটার রূহের কন্ট্রোল বাবলুর। ফলে বাবলুর আবার টাকার দরকার হয়। যে বাবলু জীবনে বন্ধুদের এক পয়সা খাওয়ায় নাই সে মেয়েটার পিছনে লাখ লাখ টাকা উড়াতে থাকে।

আমি আবার বাবলুকে জিজ্ঞাসা করি, “খালাতো ভাই, বুঝলাম, ঘোড়া কিনবা। তো এই ঘোড়া কোন ঘোড়া? মহিন বাবুর ঘোড়া না আরবের ঘোড়া, নাকি পিস্তলের ঘোড়া?”

বাবলু বলে, “এইসব ভাবের ঘোড়ার পিছে স্যামুয়েল ছুটে না, ব্রো। ঘোড়া একটাই—চাকরি।”

“চিটাগঙের ছেলেরা চাকরি করে, খালাতো ভাই? তুমি তো স্ক্রিপ্টের বাইরে চলে যাচ্ছো। খবরদার, স্ক্রিপ্টের বাইরে যাবা না, স্ক্রিপ্টের বাইরে গেলে কাস্টিং বাতিল।”

বাবলু বলে, “ব্রো, আমি তো কারো স্ক্রিপ্ট ফলোই করতে পারবো না জীবনে। আমার স্ক্রিপ্ট আমার ফিঁয়াসে লিখে ফেলছে।”

চার বছর হয়ে গেল মারজিয়ার সাথে বাবলুর প্রেম হয়েছে। চার বছর ধরেই মারজিয়া স্যামুয়েলকে বলে আসছে একটা ঠিকঠাক চাকরি জোগাড় করতে। চাকরি জোগাড় করে স্যামুয়েল যেন মারজিয়ার বাপের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়।

যতবার মারজিয়া চাকরি করার কথা বলতো ততবার সে উত্তর দিত—”বাবুটা, জাস্ট একটা মাস টাইম দাও, নেক্সট মান্থেই চাকরিতে ঢুকে যাবো।” কিন্তু চার বছর চলে যায়, বাবলু কোথাও চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করে নাই। এদিকে মারজিয়ার অনার্স কমপ্লিট হয়ে যায়। অনার্স কমপ্লিট হবার আগে থেকেই মারজিয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতো। কিন্তু মারজিয়ার ফ্যামিলির সিদ্ধান্ত ছিল অনার্স শেষ হবার পরেই মারজিয়ার বিয়ের কথা ভাবা হবে। অনার্স শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং এখন মারজিয়ার পরিবার মারজিয়ার বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করেছে। মারজিয়াকে বিয়ে করার জন্য লাইন ধরেছে টাকা পয়সা খানদান কালচার সব দিক দিয়ে হাই প্রোফাইল ফ্যামিলির সব হাই প্রোফাইল নওজোয়ান। একের পর এক পাত্র আসছে—পাত্র পছন্দ হচ্ছে না বলে বিয়ে ঠেকিয়ে রাখছে মারজিয়া।

স্যামুয়েলের হুঁশ হয় যে অনেক লেইট করে ফেলেছে সে। আরো আগে চাকরি জোগাড় করে ফেলা দরকার ছিল। যা হয় নাই তা নিয়ে ভেবে লাভ নাই। যা করার এখন করতে হবে। অবশেষে জীবনে প্রথমবার স্যামুয়েল দৌড় শুরু করেছে। জীবনে অনেক কিছু করবে করবে বলেছে সে, কিচ্ছু করে নাই। এই প্রথম স্যামুয়েল কিছু করার চেষ্টা করে। স্যামুয়েল চাকরির জন্য দৌড়ায়। আসলে সে চাকরির জন্যও দৌড়ায় না। সে দৌড়ায় মারজিয়ার জন্য। সে একটার পর একটা সরকারি চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করে, ইন্টারভিউ দিয়ে যায়, কিন্তু চাকরি হয় না।

এইভাবে ব্যর্থ হতে হতে হঠাৎ একদিন দিব্যজ্ঞান হয় স্যামুয়েলের। সরকারি চাকরি লিংক ছাড়া হয় না। সে লিংক খুঁজে বের করে ফেলে। লিংক খুঁজে পেলেও হচ্ছে না, চাকরি পেতে দরকার টাকা। পাঁচ লাখ টাকা সে এক লোককে দিবে যে স্যামুয়েলকে সরকারি আমলার চাকরিতে ঢুকিয়ে দিবে। স্যামুয়েলের মা জেলে বসেই ছেলেকে টাকা ম্যানেজ করে দেন।

আমি হিরোকে কনফিউজড করার জন্য বলি, “কখন চাকরি ধরবা? কখন টাকা জমাবা? আর কখন বিয়া করবা? অন্য রাস্তা দেখো। এই রাস্তায় গেলে তুমি তো ঘোড়ারে বাঁধতে পারবা না। তখন সব ঘোড়াই তো হাত থেকে ছুইটা যাবে, খালাতো ভাই।”

স্যামুয়েল প্রশ্ন করে, “কোন রাস্তা?”

কোন রাস্তা? আমিও জানি না। টাকা নেয়ার সাথে সাথে স্যামুয়েল বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আমিও তার পিছে পিছে নামতে থাকি দেবপাহাড়ের রাস্তা ধরে। আমি ফলো করি স্যামুয়েলকে। কিন্তু স্যামুয়েল এত জোরে হাঁটে যে দৃষ্টিসীমা থেকে তাকে আমি হারিয়ে ফেলি। ফলে আমার গল্পের, আমার ঘোড়ার লাগাম আমার হাত থেকে ছুটে যায়। আমি ঘোড়ার পিছে পিছে দৌড়াই। পারি না ধরতে আর। এক সময় দৌড়ানো বন্ধ করে দিই। যদি ঘোড়া ধরা পড়ার কথা থাকে তাহলে আপনা-আপনিই ধরা পড়বে।

এই কিসসা সাচ্চা বল এই কিসসা মিছা বল
আলী কালী র‍্যাঁবো দালি অল ঘোড়া কন্ট্রোল!

অধ্যায় ২

১.

আমাকে ফেলে স্যামুয়েল একটা রিকশা নিয়ে চলে যায় আসকার দীঘির পাড়ে। সেইখানে দৌলত সাহেবের বাসা। দৌলত সাহেবের ড্রইংরুমের সোফায় বসে স্যামুয়েল মনে মনে ভাবে এই দৌলত মালটাকে কীভাবে ডিল করা যায়। মালটা ছোটখাটো হলেও লাইন-ঘাট খুব ভালো। সরকারি চাকরির পরীক্ষায় যারা চান্স পায় না তাদের মধ্যে যাদের একটু টাকা পয়সা আছে তারা দৌলত সাহেবের কাছে আসে। পরীক্ষায় চান্স না পেলেও ইভেন পরীক্ষা না দিলেও দৌলত সাহেব চাকরি দিতে পারে।

এক এক চাকরির জন্য এক রেইট। অফিসারের চাকরির রেইট পাঁচ লাখ টাকা। দৌলত সাহেব ড্রয়িং রুমে ঢোকে। স্যামুয়েল বলে, “ব্রো, কেমন আছেন?”

দৌলত সাহেব উত্তর দেয় না, বলে, “টাকা আনছো?”

দৌলত মালটা ছ্যাঁচড়ার ছ্যাঁচড়া। টাকা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। স্যামুয়েল ব্যাগ থেকে টাকা বের করে টেবিলের উপর রাখে। দৌলত গুণে গুণে টাকা নেয়। পাঁচ লাখ টাকা। দৌলত বলে, “আসেক, তাহলে, আজকে আসেক।”

স্যামুয়েল জিজ্ঞাসা করে, “চাকরি কত দিনের মধ্য হবে?”

দৌলত বলে, “জানায়েক, পরে জানায়েক, এখন আসেক। আমি বিজি।”

বাবলুর ইচ্ছা করে দৌলতের নুনুতে ইলেকট্রিক শক দিতে। বাবলু মনে মনে বলে, “খানকির পোলা, টাকা দিতেছি। চাকরি না পাইলে তোরে পাইছি।” মুখে বলে, “ব্রো, আমার একটু আর্জেন্সি আছে তো, তাই, একটু কাইন্ডলি বলবেন কত দিনের মধ্যে চাকরি হবে?”

দৌলত সাহেব বলে, “এই দশ দিন, এগারো দিন।”

বাবলু বলে, “ওকে, ব্রো।” বলে সে বের হয়ে যায়।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে মারজিয়াকে কল করে বলে, “আমাল বাবুটা কী কলে?”

মারজিয়া বলে, “কিছু কলে না, আমার টাট্টুঘোড়াটা কী কলে?”

বাবলু বলে, “আমি তো এক সপ্তাহের মধ্যে জয়েন করতেছি সোনালী ব্যাংকে। এক সপ্তাহ পরেই আমি তোমার আব্বুর সাথে দেখা করতেছি। ঠিক আছে, বাবু?”

মারজিয়া খুব খুশি হয়, তার এই গাধাটা শেষ পর্যন্ত একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলো। সে যে খুশি হয়েছে এটা সে কোনো ভাবেই বাবলুকে বুঝতে দিবে না। বয়ফ্রেন্ডকে সব সময় বুঝিয়ে দিতে হবে যে সে যত বড় চাকরি পাক, দুনিয়া উল্টায় ফেলাক, তবু সে কিছুই না। গার্লফ্রেন্ডের প্রধান কাজ বয়ফ্রেন্ডকে হিউমিলেট করা। এই দিব্যজ্ঞান মারজিয়ার আছে। মারজিয়া তাই বাবলুকে বলে, “আমাল ঘোড়াটা কি সোনালী ব্যাংকের দালোয়ান হবে?”

বাবলুও জানে গার্লফ্রেন্ড তাকে একটু ছোট করবে। করুক। বাবলু কেয়ার করে না, “অফিসার হবে, অফিসার।”

অফিসার মানে? মারজিয়া বোঝে বাবলুরে ছোট করার কিছু নাই, সে এমনিতেই ছোট হয়ে আছে। এই গাধাটা শেষ পর্যন্ত যে চাকরি জোগাড় করেছে সেইটা সোনালি ব্যাংকের সামান্য অফিসারের চাকরি। মারজিয়া বলে, “কুত্তার বাচ্চা, অফিসারের চাকরি নিয়ে তুই আমার বাপের কাছে আমারে বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আসলে আমিই তোর কইলজা খায়া ফেলবো।”

বাবলু বলে, “মানে? সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার হইতে হবে! ডিরেক্ট ম্যানেজারও তো হওয়া যায় না!”

মারজিয়া বলে, “আমি তো ম্যানেজার হতে বলতেছি না। সিনিয়র অফিসারের পোস্ট যে দিন ম্যানেজ করতে পারবা সে দিন তুমি আমাকে কল দিবা। ঠিকাছে?” মারজিয়া ফোন রেখে দেয়। অফিসার ও সিনিয়র অফিসারের এই দুই পোস্টের দূরত্বে পাক খায় বাবলুর জীবন।

বাবলু আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে। দৌলত সাহেবের ড্রইং রুম। দৌলত সাহেব দরজা খুলে বাবলুকে দেখে একটু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “আবার কী?”

দরজায় দাঁড়িয়ে বাবলু দৌলত সাহেবকে জানায় তার দরকার সিনিয়র অফিসারের পোস্ট।

দৌলত সাহেব জানায়, “ওকে, কোনো ব্যাপার না, বড় পোস্ট, রেইট বেশি, পনেরো লাখ টাকা লাগবে, তোমার পাঁচ লাখ জমা থাকলো, বাকি দশ লাখ দিয়া যাও, আজ কাল পরশু।”

বাবলুর মাথা খারাপ হয়ে যায়, সে মনে মনে দৌলতকে বলে, “খানকির পোলা, আগে কস নাই ক্যান বিশ লাখ টাকা লাগবো?” মুখে বলে, “ব্রো, আমি এখন কই পাবো এত টাকা?”

চাকুরিদাতা চাঁটগাইয়া টোনে বলে, “মিয়া এত কিপটামি করতেছো! তোমরা তো রয়েল ফ্যামিলির পোলা।”

এই ছ্যাঁচড়াও মনে করে বাবলু লাট সাবের পোলা! পাঁচ টাকার মালিক হয়ে পাঁচশো টাকার ফুটানি দেখাইলে তো এ রকমই হয়! নিজের উপর রাগ হয় তার। তার মায়ের উপরও তার রাগ হয়। তার মা যদি জেলে না থাকতো তাইলে বাকি পনেরো লাখ টাকা ম্যানেজ করতে পনেরো সেকেন্ডও লাগতো না। কিন্তু তার মা জেলে, তার মায়ের নেটওয়ার্ক একদম ধসে গেছে।

২.

বাবলু বাসায় ফেরে। দশ লাখ টাকা কই পাবে ভাবে। তার মায়ের সব ব্যাংক একাউন্ট ব্লকড করে দেয়া হয়েছে। সে ফোন করে যায় তার মামা-চাচা-খালাকে। কেউ বাবলুকে টাকা দিতে রাজি না। স্যামুয়েল ফোন করে যোগাযোগ করে তার মায়ের হুন্ডি সিন্ডিকেটের সাথে। তারা আজকাল লিলি খালাকে চিনতেই পারে না। একে একে বিট্রে করা শুরু করেছে সবাই, সব কিছু। শো অফ করে স্যামুয়েল কীভাবে মুকাবিলা করবে শয়তান খুব শয়তান এই সময়ের সাথে?

বাবলু ধিপ করে আসমান থেকে ডিরেক্ট পড়ে গেছে জমিনে। জমিনেও বাবলু দাঁড়াতে পারে না। বাবলু ওর্ফে স্যামুয়েলের পা জমিন থেকে নেমে যায় পাতালে, গভীর পাতালের দিকে। অসহায় বাবলু কল করে মারজিয়াকে। মারজিয়া ফোন অফ করে দিয়েছে। মেয়েটা কোনো দিন তারে বোঝে নাই। এমন দুঃসময়ে মেয়েটা আছে তার জেদ নিয়ে, সে বোঝে না মেয়েটার ফোন অফ থাকলে বাবলুর মাথা ব্লকড হয়ে যায়। প্রতিশোধ। বাবলুও ফোন অফ করে দেয়, ফেইসবুক ডিঅ্যাক্টিভেট করে দেয়।

৩.

আমি তখন আমার বাসায়। আমি আবার দেবপাহাড়ে এসে দেখি বাবলু বাসায় আছে। বাবলুকে জিজ্ঞাসা করি, “ফোন অফ করে রাখছো কেন খালাতো ভাই? তোমার গার্লফ্রেন্ড আমারে কল দিয়া তোমারে খুঁজতেছে।” বাবলুকে খুঁজে বের করার জন্য আমাকে কল দেয়। আমাকে আসতে হয় দেবপাহাড়ে বাবলুর কাছে। আমি বাবলুকে বলি, “খালাতো ভাই, তোমার ঘোড়া তো তোমাকে খুঁজতেছে।”

বাবলু আমাকে বলে, “আমার গার্লফ্রেন্ডরে ঘোড়া-টোড়া ডাকা যাবে না, ব্রো। লিমিট ক্রস কইরো না।”

আমি তাকে বলি, “আমি খারাপ অর্থে বলি নাই তো।”

বাবলু বলে, “এক্সপ্লেইন কইরো না, ব্রো। বলবা না বলছি, বলবা না। ওকে?”

আমি বলি, “ঠিকাছে।”

বাবলু ফোন অন করে। মারজিয়া কল করে, “ঐ লুজারের বাচ্চা, ফোন অফ করে রাখছস ক্যান? চাকরি জুটাইতে পারছ নাই এখনো? তুই যদি তিন দিনের মধ্যে চাকরি জোগাড় কইরা আমার বাপের কাছে বিয়ার প্রস্তাব নিয়া হাজির হইতে না পারছ, তাইলে আমি তোরে জবাই করে ফেলবো।”

এই চাপ নিতে পারে না স্যামুয়েল। স্যামুয়েল মারজিয়ার অনুপস্থিতি মেনে নিতে পারবে না। না, মারজিয়াকে হারানো যাবে না। খেলা ছেড়ে দেয়া যাবে না। স্যামুয়েল মনে মনে গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারিকে স্মরণ করে—”গুরু ব্রো, এই মুসিবত থেকে আমারে তুমি বের করে নিয়া যাও, প্লিজ, ব্রো, আমি যে আর এই প্রেসার নিতে পারি না।”

তিন দিন চলে যায়।

আমি এর মধ্যে চিটাগং এর বিভিন্ন গুপ্ত, ডার্ক নেটওয়ার্কগুলার সাথে যোগাযোগ করি।

হুন্ডি লাইনের এক বন্ধু আমাকে জানায় রেয়াজুদ্দিন বাজার থেকে আঠারো লাখ টাকার একটা হুন্ডি চালান যাচ্ছে রাউজান অভিমুখে। আমি স্যামুয়েলকে বুদ্ধি দিই, চলো চালানটা মেরে দিই, খালাতো ভাই।

স্যামুয়েল আমারে বলে, জীবনে খারাপ বুদ্ধি ছাড়া একটা ভালো বুদ্ধি দিতে পারো না তুমি?

স্যামুয়েল নাও অ্যা ডেজ মাইজভাণ্ডারি। সে কোনো মতেই সো কল্ড ইলিগাল রাস্তায় যাবে না। আমার ধারণা সে অবৈধ রাস্তায় যাবে না এই জন্য না যে সে সুফিবাদের রাস্তা ধরেছে। আসলে স্যামুয়েল অবৈধ রাস্তার রিস্ক ভয় পায়।

এই কথা তাকে বলতেই সে আমাকে বলে, ‘ঐ মিয়া, আল্লার নূর আমার কইলজায় সেট হয়ে আছে। স্যামুয়েল কাউরেই ভয় পায় না।’

মারজিয়া আবার স্যামুয়েলকে বলে, “লুজারের বাচ্চা, যদি তিন দিনের মধ্যে চাকরি জোগাড় করে আমার বাপের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসে হাজির হইতে না পারছ তাইলে আমি তোরে জবাই করে ফেলবো।”

স্যামুয়েল আমাকে বলে, “ব্রো, লিগ্যাল ইলিগ্যালে কোনো ভেদ আছে?”

আমি জিজ্ঞাসা করি, “তাইলে কি আমরা হুন্ডি ডাকাতিতে যাইতেছি, খালাতো ভাই?”

স্যামুয়েল বলে, “তুমি আমারে হিরো কইরা নভেল লিখতেছো বলে কি তোমার ওয়্যে ধরে আমারে হাঁটতে হইবো, ব্রো?”

আমি কিছু কই না। আমি বুঝতে চেষ্টা করি সে কার স্ক্রিপ্ট ফলো করছে তাইলে? নিশ্চয় এই স্ক্রিপ্ট মারজিয়ার না। এই স্ক্রিপ্ট কার? স্যামুয়েল বলে, “আমরা এখন বাইর হবো, ব্রো। লেটস মুভ।”

আমরা বাসা থেকে বের হয়ে যাই।

৪.

দেবপাহাড়ের নিচে নেমে আসি। দেবপাহাড়ে ওঠার মুখে র‍্যাব লিখা একটা নীল প্রাইভেট কার থেমে আছে দেখে কলিজা নগদে আরব মরুভূমি হয়ে যায়। গাড়ির ভিতরে দেখার চেষ্টা করি—প্রাইভেট কারের মধ্যে ওয়ার্লেস মুখের সামনে নিয়ে কথা বলছে এক র‍্যাব সদস্য। আমি স্যামুয়েলকে র‍্যাবের গাড়ি দেখাই। গাড়ির কাছে গেলে আমি এক র‍্যাব সদস্যকে চিনতে পারি—নোমান। নোমানকে দেখে আমার মাথার মধ্যে সব ক্লিয়ার হয়ে যায়। এখন তাহলে নোমানের স্ক্রিপ্টে আমাদের অ্যাক্টিং করে যেতে হবে!

নোমান খুলশির ঝাউতলার পোলা। স্যামুয়েল আমাকে সাইড করে তাহলে ছাদে গিয়ে নোমানকে কল করেছে? কেন? আমার রাস্তায় সে চলবে না বলে? অথচ স্যামুয়েলকে নোমানের সাথে আমিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। মেজাজ হালকা বিলা হয়ে যায় আমার। মেজাজ খারাপ করা চলবে না। মেজাজ কন্ট্রোল করে আমি নীল রঙের প্রাইভেট কারের সামনে উঠে যাই। কিন্তু স্যামুয়েল আমাকে বলে সেই সামনে বসবে। ফলে আমি বের হয়ে পিছনের সিটে যাই। স্যামুয়েল টুটুলের পাশে বসে। টুটুল গাড়ি টান দেয়। গাড়ি দেবপাহাড় থেকে চলে যায় গোলপাহাড় মোড়।

গোলপাহাড়ের এক বাসার নিচে এসে গাড়ি থামে। আমরা পাঁচজন বাসায় উঠি। বাসায় ঢুকে আমাকে ও স্যামুয়েলকে দেয়া হয় র‍্যাব লিখা দুইটা জ্যাকেট। আমি আমার সিভিল ড্রেসের উপর পরে ফেলি র‍্যাব লিখা জ্যাকেট। স্যামুয়েল এই জ্যাকেট গায়ে দিবে না। কেন? “ক্ষ্যাত জ্যাকেট একটা। র‍্যাব লিখে রাখছে! সি আই এ বা এফ বি আই লিখা কোন জ্যাকেট থাকলে দাও নোমান ব্রো। র‍্যাব লিখা কোনো জ্যাকেট স্যামুয়েল পরবে না।”— বলে স্যামুয়েল। নোমান আমার দিকে তাকায়, বলে—”বদ্দা, এই ফুলা তোমার হালাতো ভাই না হইলে এক লাথি দিয়ে দইজ্জাতে ফালাই দিতাম।”

কাজ হয়। স্যামুয়েল জ্যাকেট পরে নেয়। জ্যাকেট পরার পর একটা বৈঠক বসে।

প্ল্যান। চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট রোডের সি ইউ এফ এল ঘাটের ফেরি পার হয়ে আসা ট্রাকগুলা নিয়ে আসে সিমেন্ট, সার, লোহা, তেল। অবশ্য মাঝে মাঝে এই সবের সাথে আসে ইয়াবা। র‍্যাবের স্পেশাল উইং পরিচয় দিয়ে আমরা ট্রাক থামাবো ইয়াবার সন্ধানে। ট্রাক থামলে অফিসার সেজে থাকা নোমান বলবে: আমাদের কাছে ইনফর্মেশন আছে, এই ট্রাকে করে এক লাখ পিস ইয়াবা যাচ্ছে। ইয়াবা চেক করতে করতে আমরা ড্রাইভার ও হেল্পারকে বেঁধে ফেলে দিবো রাস্তায়। তারপর মালপত্র সহ ট্রাক নিয়ে চলে আসবো আমরা। একটা ট্রাক সিস্টেম করতে পারলেই হবে।

ঝাউতলার ক্রেইজিয়েস্ট পোলা নোমান, বক্কর ও টুটুল এই অপারেশন চালাচ্ছে জাস্ট ইমোশনাল কারণে। তাদের সবার হাতে ছুরি দিয়ে খোদাই করে লেখা—’নিগার’। নিগার তাদেরকে ভালোবাসে নাই কোনো দিন। নিগার ছাড়া আর কাউকে তারা ভালোবাসতে পারে নাই, কোনো দিন পারবেও না। এই অনন্য প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখতে কি ভুলে থাকতে তারা দুনিয়ার সব প্রেমিকের বিপদে আপদে গিয়ে দাঁড়ায়। এই শহরের যত পোলাপান মেয়ে নিয়ে গেঞ্জামে পড়ে তারা নোমানদের কাছে যায়। পরের প্রেম বাঁচাতে খুন করতেও দ্বিধা করে না এই তিন ব্যর্থ প্রেমিক। অন্য প্রেমিকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের প্রেমিকাদের পাইয়ে দিয়ে তারা হয়তো নিগারকে একটু একটু পায়। মিটিং এর পরে খাবার পালা। আমরা লান্চ করে নিই। লান্চ শেষে বক্কর ও টুটুল এক সাথে ইয়াবা টানে। নোমান ড্রাগস নেয় না। আমি ও নোমান সিগারেট খাই। স্যামুয়েল সিগারেট খায় না। সে মারজিয়াকে কল দেয়, “একটা সমবায় সমিতির সাথে যোগাযোগ করছি, জান। তারা আজকের ভিতরে পনেরো লাখ টাকা লোন দিবে।”

প্রেমিকা প্রশ্ন করে, লোন কয় কিস্তিতে কয় বছরের ভিতর পরিশোধ করতে হবে। উত্তর দিতে গিয়ে একটু থমকে যায় স্যামুয়েল। মিথ্যা কথা গুছিয়ে বলা খুব টাফ। এই টাফ কাজ সে কোনো মতেই করতে পারে না। সে উত্তর দেয় এখনো ঠিক হয় নাই এইসব।

দুপুর গড়িয়ে যায়। পৌনে পাঁচটায় আমাদের লিডার নোমান ঘোষণা দেয়—”রেডি।” বিকাল হয়। ঠিক পাঁচটায় আমরা গোলপাহাড়ের আস্তানা ত্যাগ করে চলে যাই সি ইউ এফ এল ঘাটের দিকে যেখানে হরিণের মতো চরে মালবাহী ট্রাক।

ছয়টা পনেরো। আমরা চিটাগং এয়ারপোর্ট রোডে। সন্ধ্যা নামছে। মাগরিবের আযান ভেসে আসে। সিইউএফএল ঘাটে এসে ভিড়ে একটা ফেরি। ফেরি থেকে নেমে আসে একটা ট্রাক। খালি ট্রাক। আমরা খুঁজছি মালবাহী ট্রাক। আরো একটা ফেরি আসে। কোনো ট্রাক আসে না। পরের ফেরিতে ট্রাক আসে—খালি ট্রাক। রাত বাড়ে। আজব! আমরা র‍্যাবের অ্যাক্টিং করতে করতে ক্লান্ত হই। ক্লান্তি দূর করতে দুই ড্রাগ এডিক্ট বক্কর ও টুটুল ইয়াবা টানে। রাত দশটা বেজে যায়। আমি স্যামুয়েলকে বলি, “আমার কথা তো জীবনে শোনো নাই, খালাতো ভাই। হুন্ডির অপারেশনটাতে গেলে এতক্ষণে আমরা আঠারো লাখ টাকার মালিক হয়ে যেতাম। অথেন্টিক কোনো ইনফর্মেশন ছাড়া এই রকম অপারেশনে কোনো ফায়দা নাই।

স্যামুয়েল বলে, “চলো, ব্রো, তাইলে আমরা হুন্ডির কামটাই করি।”

স্যামুয়েলকে জানাই, “খালাতো ভাই, হুন্ডি মাইরা দেয়ার টাইম আর নাই। হুন্ডির টাকা অলরেডি রাউজান পৌঁছে গেছে।“

স্যামুয়েলের ফোনে মারজিয়ার কল আসে। মারজিয়া জানতে চায়, স্যামুয়েল টাকা হাতে পেয়েছে কিনা। স্যামুয়েল প্রতি বার উত্তর দেয়—”এক ঘণ্টার মধ্যে পেয়ে যাবো, জান।” আর আমি মনে মনে ভাবি মালবাহী ট্রাক যেহেতু পাচ্ছি না সো খালি ট্রাক লুট করে পিস পিস করে বেচে দিবো নাকি? কিন্তু খালি ট্রাক পিস পিস করে বেচলে পনেরো লাখ টাকা পাওয়া যাবে না। পাওয়া গেলেও লাভ নাই—এখন খালি ট্রাকও দেখা যাচ্ছে না। আরো এক ঘণ্টা পাস হয়ে যায়। এগারোটা বাজে। স্যামুয়েল আমাকে বলে, “ওকে এই অপারেশন প্যাক আপ।”

স্যামুয়েল নোমানকে বলে, “ব্রো, অনেক কষ্ট করছো আমার জন্য। তোমারে এবং তোমাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নাই। এখন চলো অপারেশন প্যাক আপ করে ফিরে যাই।” নোমান বলে, “ফিরা যাবা? এই তোমাদের যুগের ফ্রেম? খুব অল্পতেই সব ফেয়ে যেতে চাও!” আমি নোমানকে বলি, “বদ্দা, কালকে আর একটা অপারেশন করবো আমরা একদম অথেন্টিক ইনফর্মেশন নিয়া। ওইটাতেও আপনেরে লাগবে। আজকে বাদ দেন।”

নোমান হাল ছেড়ে দিতে রাজি না। সে বলে, “বদ্দা, যদি থাকে নসিবে, পাছার তলা দি আসিবে।”

এমন সময় একটা মালবাহী ট্রাক ফেরি থেকে নেমে এয়ারপোর্ট রোডে উঠে। বক্কর ও টুটুল থামানোর সিগন্যাল দেয়। কিন্তু ট্রাক থামে না। আমরা নগদে গাড়িতে উঠে ট্রাকটির পিছে পিছে ধাওয়া করি। টুটুল ও বক্করের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই ট্রাকে নিশ্চিত ইয়াবার চালান আছে। সিমেন্ট, লোহার চালান থাকলে তো ট্রাক থামার কথা। যেহেতু ট্রাক থামে নাই এটাতে নিশ্চয় ইয়াবা আছে। এই গাড়িতে কত পিস ইয়াবা থাকতে পারে এই হিসাব কষে দুই ড্রাগ এডিক্ট ও তাদের হিসাব মিলে। নোমান কোমর থেকে রিভলবার বের করে আমাদের গাড়ির সামনে ধাবমান ট্রাকের চাকা লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। লক্ষ্য ভেদ হয়, ঝাউবনের নিস্তব্ধতা ভেঙে ট্রাকের চাকা ফাটে। ট্রাক থেমে যায়। ট্রাক থামার সাথে সাথে ট্রাক থেকে নেমে দৌড় দেয় এক হেল্পার। আমরা নগদে গাড়ি থেকে নামি, দৌড়ে ধরে ফেলি ট্রাকের ড্রাইভারকে। আমরা ট্রাক তল্লাশি করি কী মাল আছে দেখার জন্য। বক্কর ও টুটুল ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে, “বাবা কই?”

ড্রাইভার জানায় যে কোনো ইয়াবা নাই। কী আছে তাহলে? আমরা ট্রাক ঢেকে রাখা ত্রিপল খুলে ফেলি। ত্রিপল খুলে আমরা একদম টাসকি খেয়ে যাই। এ কী?

পুরা ট্রাকভর্তি সব রাইফেল আর রাইফেল আর রাইফেল আর রাইফেল। কিছুক্ষণ বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে আমরা পরস্পরের মুখে তাকাই। বিস্ময় সামাল দিয়ে কয়েক সেকেন্ড পরে আমরা ড্রাইভারকে আমাদের প্রাইভেট কারের ভিতর তুলে ফেলি। নোমান ড্রাইভারের পেটে রিভলবার ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে, “বদ্দা, এই মাল কার?”

ড্রাইভার উত্তর দেয় না। নোমান গলার সুর ও স্বর বদলায়, “বদ্দা, এই মাল তো তোর না। আরেকজনের মালের জন্য জীবন দিয়া দিবি?”

ড্রাইভার মুখ খোলে। ড্রাইভার আস্তে আস্তে মুখ খুলতে শুরু করে। এই অস্ত্র যাচ্ছে আসামের স্বাধীনতাকামী গেরিলাদের জন্য। ড্রাইভারের ফোনে কল আসে। নোমান ড্রাইভারকে এমনভাবে কথা বলতে নির্দেশ দেয় অ্যাজ ইফ কিছুই ঘটে নাই। ড্রাইভার কথা বলে, লাউডস্পিকারে। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে একটা তথ্য ভেসে আসে।

৫.

নোমান ড্রাইভারকে বলে, “ও বদ্দা, তুই চলি যা।” এতক্ষণ সাইলেন্ট থাকা স্যামুয়েল কথা বলে ওঠে, সে ড্রাইভারকে নির্দেশ দেয় যে ফোন থেকে কল আসছে সেই নম্বরে ড্রাইভারকে আবার কল দিতে। নোমান ড্রাইভারকে স্যামুয়েলের হাতে ছেড়ে দিয়ে ট্রাকের ড্রাইভিং সিটে উঠে যায় ও স্যামুয়েলকে ডাক দেয়, “বদ্দা, ড্রাইভারকে ছাড়ি দাও। দেরি করলে মুশকিলে ফড়ি যাবো তো। চলি আসো, বদ্দা।”

স্যামুয়েল বলে, “ব্রো, জাস্ট পাঁচ মিনিট।”

ড্রাইভার ফোনে কথা বলে। স্যামুয়েল জেনে নেয় বাকি নয়টা ট্রাকের গাড়ির নম্বর। আরো নয়টা অস্ত্রবাহী ট্রাক পার হবে এই ঘাট দিয়ে। স্যামুয়েল ড্রাইভারের সেলফোন রেখে ড্রাইভারকে ছেড়ে দেয়। ড্রাইভারকে ছেড়ে সে ট্রাকের সামনে উঠে যায়। নোমান ভুলে যায় সেই তো গুলি করে ফুটা করে দিয়েছে ট্রাকের চাক্কা। খুব দ্রুত নষ্ট চাকা খুলে নতুন চাকা লাগানো হয়।

রাত পৌনে বারোটা। আমাদের প্রাইভেট কার ও ট্রাক চলে আসি খুলশির ঝাউতলা—নোমান বদ্দার ঘাঁটিতে। খুলশির পাহাড়ের ভিতর একটা দোতলা বাড়ি। আমরা বাড়িতে ঢুকে যাই। ঘটনার ঘোর এখনো কাটিয়ে উঠতে পারি নাই। এত বিস্ময়ের মধ্যেও ক্ষিধা লাগে! আমরা খেতে বসে যাই। শুধু আমাদের হিরো খায় না। তার নাকি ক্ষিধা লাগে নাই।

স্যামুয়েল মারজিয়াকে কল করে, “টাকা পেয়ে গেছি, জানটা, বাবুটা।”

খাওয়া শেষ হয়। আমি ও নোমান সিগারেট ধরাই। খাবারের পর বক্কর ও টুটুল হতাশ। তাদের হতাশার কারণ এই যে তাদের পকেটে ইয়াবা পিল আছে মাত্র তিন পিস। এই তিন পিস দিয়ে কীভাবে রাত পার করবে এইটা নিয়ে তাদের টেনশনের কোনো সীমা নাই। নোমান তাদের বলে, “যে মাল পাইছি এই মাল বেচলে যে ফয়সা ফাবা এগুলা দিয়ে তোমাদের নাতি-নাতনি ইয়াবা না কোকেন খেয়েও শেষ করতে ফারবে না।” কিন্তু ড্রাগ এডিক্টরা নাতি-নাতনি নিয়া ভাবে না—তারা ভাবে এই মূহুর্তে তারা ফিলিংসে আছে কিনা। বক্কর নোমানকে বলে, “বাট পিনিকে ঘাটতি পরা যাবে না, ওস্তাদ।”

নোমানও জানে। বক্কর ও টুটুল পিনিকে না থাকলে সুইসাইডাল হয়ে যায়, কারণ তখন তারা কোনো ভাবেই নিগারের বিরহ কন্ট্রোলে রাখতে পারে না। নোমান বদ্দা তাই তার সহযোদ্ধার জন্য সব ঠিকঠাক করে রাখে। নোমান বদ্দা জানায় বক্কর ও টুটুলের জন্য ইনাফ ইয়াবা মজুদ আছে। এখন মিটিং শুরু হবে। কিন্তু বাবেল এখনো মারজিয়ার সাথে ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। আমি বিরক্ত হয়ে ডাক দিই স্যামুয়েলকে। স্যামুয়েল ফোন রাখে।

মিটিং। নোমান বলে —”বদ্দা, আমি এক অস্ত্র ডিলারের সাথে কানেকশন করছি। আগামিকাল যোহরের আগেই আমরা মাল সেল দিতে ফারবো। একটা সফল অফারেশন করলাম। শুকরিয়া।”

নোমানের কথা শুনে বিস্মিত হয় বাবলু ওর্ফে স্যামুয়েল —”অপারেশন শেষ মানে?”

নোমান জবাব দেয় —”শেষ মানে কমফ্লিট। আমাদের মিশন কমফ্লিট।”

স্যামুয়েল শুধায়, “মানে ব্রো? বাকি নয় ট্রাক অস্ত্রের কী হবে?” নোমান বলে, “বদ্দা, তুমি আমারে বলছিলা যে তোমার ফ্রেমিকার বিয়া হয়ে যাচ্ছে। এইজন্য তোমার চাকরি দরকার, চাকরির জন্য ফনেরো লাখ টাকা দরকার। তাও শোকর নাই। আমি তোমারে কথা দিছি। আমি তোমারে সকালে টাকা ম্যানেজ করে দিবো। আমি আর কোনো অফারেশনে নাই।”

স্যামুয়েল নোমানকে বলে, “আপনে অপারেশনে নাই মানে আমিও নাই। এক ট্রাকই শোকর আলহামদুলিল্লাহ।”

স্যামুয়েলকে আমি বলি, “আরে খালাতো ভাই, আমি আছি, চলো কামটা করি। দশ অস্ত্র ট্রাক—মানে বোঝো?

স্যামুয়েল মুখের উপর আমাকে বলে, “তোমার উপর কোনো আস্থাই নাই আমার, ব্রো। নোমান বদ্দা থাকলে আমি আছি। নাইলে আমি নাই।”

স্যামুয়েলের কথা শুনে আমি একটু ইনসাল্ট ফিল করি। বাকি নয় ট্রাকের নম্বর, রুট ও কোন সময়ে যাবে ডিটেইল ইনফর্মেশন আমার কাছেই আছে। চার ঘণ্টা পর পর পার হবে বাকি নয়টা ট্রাক। প্রথম ট্রাকটা আমরা পেয়েছি রাত এগারোটায়। এখন একটা বাজে। তিনটার দিকে আরেকটা ট্রাক সি ইউ এফ এল ফেরি ঘাট পার হবে।

পেন্টিয়াম ফাইভ সব পলিটিক্যাল পার্টিগুলার সাথে লিংক রেখে হেডাম দেখায় সারা চট্টগ্রামে। এটা চট্টগ্রাম শহরের বড়লোক, উঠতি বড়লোক, হঠাৎ বড়লোকদের পোলাপানের গ্রুপ।

মঞ্জুকেই দরকার আমার। তার ফোনে কল দিতে থাকি আমি। সে বোধহয় ঘুমাচ্ছে। কল রিসিভ করে না। আমি একটা টেক্সট লিখি—”ইমার্জেন্সি।” সাথে সাথে মঞ্জু কল ব্যাক করে। জিজ্ঞাসা করে, “কী ভায়া, এত রাতে?” আমি তারে সব ভেঙে বলি। মঞ্জু আমারে বলে, “ওকে। আপনে ঝাউতলাতেই থাকেন। আমি আসতেছি।” আর বিশ মিনিটের মধ্যে ঝাউতলাতে হাজির হয়ে যায় একটা মাইক্রোবাস। মাইক্রোবাস থেকে নেমে আসে মঞ্জু। মাইক্রোবাসের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় স্যামুয়েলের, নোমানের। আমি তাদের থেকে বিদায় নিই—”তোমরা এক ট্রাক নিয়া বসে থাকো, খালাতো ভাই। বদ্দা, খালাতো ভাইরে দেখে রাইখেন।” নোমান আমারে জিজ্ঞাসে, “বদ্দা, কোথায় যাচ্ছো যে?”

আমি বলি, “বাকি নয় ট্রাক ধরতে।” আমার যাওয়া দেখে স্যামুয়েল আবার খেলায় ফিরে আসে, “ব্রো, আমারে ফেলে কই যাও তুমি?” স্যামুয়েল হঠাৎ মঞ্জুর বাহিনীর উদ্দেশ্যে হাঁক দেয়—”অল ঘোড়া কন্ট্রোল। লেটস মুভ।”

কিন্তু মঞ্জু ঠাট্টা করে বাবেলকে বলে —”বাসায় জানে?”

হিরো জিজ্ঞাসে —”কী জানে?”

মঞ্জুর বাহিনীর সবাই একসাথে হেসে সবাই একসাথে আবার হিরো স্যামুয়েলকে জিজ্ঞাসা করে—”বাসায় জানে?”

নার্ভাস হয়ে যায় হিরো। মঞ্জু স্যামুয়েলকে বলে, “শোনো। হিরো সাজতে যাবা না। যেইখানে আমি থাকি সেইখানে টম ক্রুজ থাকলেও তারে মুততে যাবার আগে আমারে জিগায়া যাইতে হবে—মুততে যাবে কিনা। ক্লিয়ার?”

ঝাউতলার ক্রেইজিয়েস্ট পোলা নোমান চুপ করে থাকতে পারে না। মঞ্জুকে দেখিয়ে মামুন আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “বদ্দা, এই মালটা কে?”

মঞ্জু বলে, “বদ্দা, আঁই মঞ্জু, অঁরে আঁরে নঁ চিননদে?”

মঞ্জুও সাইকো নোমানকে দেখি কেয়ার করে। আমি এই তথ্য আগে জানতাম না।

নোমান বলে, “মঞ্জু, তোমার বা কই?”

মঞ্জু জবাব দেয়, “ব্যাটারি গলি।”

নোমান বলে, “চাঁটগাইয়া বাসা বলে আমারে ফটাইতে ফারবে না, মঞ্জু। শোনো। যে অফারেশন আমরা করেছি ও আরো যে অফারেশন করবো সব আমরা শুধু বাবেলের জন্য করবো। আমরা সবাই বাবেলের সহযোগী। বাবেল যে মুহূর্তে বলবে খেলা শেষ, নগদে খেলা শেষ হয়ে যাবে। ক্লিয়ার, বদ্দা?”

মঞ্জু বলে, “টিক আছে তো বদ্দা, আঁই একখানা ফান গইজ্জিলামদে।”

নোমান বলে, “শুদ্ধু ভাষায় কথা বলো। চিটাইঙ্গা ভাষা কথা বলা আমি একদম পছন্দ করি না।”

নোমানের নিগারও চাঁটগাঁইয়া ভাষা একদম সহ্য করতো না। নোমানের প্রশ্রয় পেয়ে আমাদের নার্ভাস হিরো বাবলু আবার ফিরে আসে খেলায়। বাবলু আবার হাঁক দেয়—”অল ঘোড়া কন্ট্রোল। লেটস মুভ।”

এবার নোমান হেসে উঠে —”কই যাবে, বদ্দা?”

স্যামুয়েল ফাঁপড়ে পড়ে যায়? কই যাবো আমরা?

নোমান বলে, ‘আমরা তো যাবোই, কিন্তু ফরিকলফনা ছাড়া গিয়ে কিছু হবে?”

এই মূহুর্তে স্যামুয়েলের একটু ড্রামা করাই লাগবে। সে হঠাৎ নোমানকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ব্রো, তুমি আমার মায়ের পেটের ব্রো’র চেয়ে ও বেশি কিছু। প্লিজ প্লিজ ব্রো আমার মাথায় একটু হাত রাইখা দুয়া দাও।” বলে মাথা নিচু করে বাড়িয়ে দেয় নোমানের দিকে। নোমান বদ্দা বাবলুর মাথায় হাত রাখে, বলে—”বদ্দা, আমি আছি।”

অধ্যায় ৩

১.

টুটুলের মাথায় ও মনে তীব্র অ্যামফিটামিন। গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত সে খুলশি টু ফেরিঘাট, ফেরিঘাট টু খুলশি ননস্টপ ড্রাইভ করে যাচ্ছে সারা রাত না ঘুমিয়ে। কিন্তু এখন আমরা ফেরিঘাট যাচ্ছি না। আমরা যাচ্ছি কর্ণফুলি ব্রিজ। আমরা যে তিনটা ট্রাক ঘেউ করে দিয়েছি এই খবর দশ ট্রাক চালানের সাথে জড়িতদের কাছে চলে গেছে। তাই চার নম্বর ট্রাক রুট বদল করেছে।

জিইসি মোড়ে ঢোকার আগে জ্যাম। স্যামুয়েল বার বার ঘড়ি দেখে। গাড়ি থেকে নেমে দেখতে চায় কী হয়েছে। জ্যাম ছেড়ে দেয় বলে নামে না। জিইসি মোড়ের সিগন্যাল ক্রস করে বাম দিকে বাঁক নিব আবার জ্যাম। মঞ্জু ঘুমায়। নোমান বদ্দা ওয়ার্লেস হাতে হেডফোনে গান শোনে আর টুটুল নোমান বদ্দার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলে না।

স্যামুয়েল গাড়ি থেকে বের হয়। আমিও গাড়ি থেকে নামি। এক বিশাল জনস্রোত যাচ্ছে মুরাদপুরের দিকে। জনগণ ভিড়ের মধ্যে থাকা এক ফর্সা দাড়িওলা লোকের গায়ে ফুল ছিটায়, লোকটা জনস্রোতের দিকে হাত নাড়ে। স্যামুয়েলের মাথা নষ্ট হয়ে যায়।

স্যামুয়েল আমাকে বলে — ব্রো, এই ঘোড়াটারে শ্যুট করে দিব নাকি? হুদাই জ্যাম লাগায় রাখছে মাদারফা…।

স্যামুয়েল জিজ্ঞাসে — এই ঘোড়াটা কে, ব্রো?

এই হলো রসূলের আওলাদ নাদের শাহ! পাকিস্তান থেকে প্রতি বছর আসে। জিইসি থেকে লালখান বাজার ভরে গেছে রসূলের আওলাদের আশেকানদের ভিড়ে।

স্যামুয়েল জিজ্ঞাসে — পাকিস্তান থেকে এসে ঘোড়াটা কী করে?

আমি বলি — সুফিগিরি করে।

স্যামুয়েল বলে — সুফিগিরি মানে? তুমি তো সুফিদের অবমাননা করতেছো। আই লাভ সুফি, ব্রো।

আমি বলি — তুমি ভালোবাসতে থাকো, খালাতো ভাই। আমি সুফি-টুফি একদম নিতে পারি না। সুফিবাদ ইসলামের জন্য ক্ষতিকর।

স্যামুয়েল বলে — ব্রো, আমি কিন্তু তোমারে গুলি করে দিব এখন।

আমি বলি — দাও।

স্যামুয়েল একটু ভাবে। তারপর আবার বলে — না, আজ করব না।

আমি বলি — ওকে, কইর না।

স্যামুয়েল বলে — কিন্তু কছম আল্লার, একদিন গুলি করে দিব।

আমি বলি — ওকে, কইরা দিও।

স্যামুয়েলের ফোন বাজে। স্যামুয়েল কল রিসিভ করে। মারজিয়ার কল।

“আমার টাট্টু ঘোড়াটা কী কলে?”— মারজিয়ার আদুরে ডাক শুনে মন ভালো হয়ে যায় স্যামুয়েলের।

স্যামুয়েল বলে — আমি তো ঘোড়া কন্ট্রোল কলি, বাবু। বাবু কী কলে?

ঘোড়া কন্ট্রোল কথা শুনেই মেজাজ বিলা হয়ে যায় মারজিয়ার — ঘোড়া কন্ট্রোল মানে, কুত্তার বাচ্চা? তুই তোর নষ্ট কাজিনটার সাথে আছস! না? ওইটার সাথে থাকলেই তো তুই ছ্যাঁচড়া পোলাদের মতো ঘোড়া কন্ট্রোল, ঘোড়া কন্ট্রোল বলা শুরু করস। তুই আগে তোর নষ্ট কাজিনটারে দূর কর, তারপর কথা।

স্যামুয়েল স্পিকারে হাত চেপে আমাকে বলে — ব্রো, এখন যাও তো তুমি। একটু কথা বলি ঘোড়াটার সাথে।

আমি যাই না। আমি স্যামুয়েলের কানে কানে বলি — তুমি ওরে বলো যে আমি এখন নাই।

স্যামুয়েল স্পিকার থেকে হাত সরায়, মারজিয়াকে বলে — বাবুতা, ও চলে গেছে, এবার বলো।

মারজিয়ার গলায় আবার ফূর্তি ফিরে আসে — আচ্ছা, আমার টাট্টু ঘোড়া, তুমি টাকা জমা দিতে যাবা না?

স্যামুয়েল বলে — টাকা তো সকালেই দিয়ে দিসি, বাবু। পরশু জয়েনিং! সিনিয়র অফিসার পোস্ট।

মারজিয়া বলে — ‘ওহ! তাহলে তো তুমি ফ্রি। এখনি আমার বাসার নিচে চলে আসো। তোমার চাকরি হলে আমরা তো ভালো করে ঘুরতেও পারব না আর।

এই কোন ফাঁপড়! স্যামুয়েল অপারেশন শেষ হবার আগ পর্যন্ত কোথাও যাবে না। স্যামুয়েল স্পিকার হাত দিয়ে চেপে আমাকে বলে—ব্রো, ঘোড়া তো দেখা করতে চায়।

আমি স্যামুয়েলের কানে কানে বুদ্ধি দিই।

আমার কথা শুনে স্যামুয়েল স্পিকার থেকে হাত সরিয়ে মারজিয়াকে বলে—বাবু, আমাকে তো যেতে হবে বারে, লইয়ারের সাথে দেখা করতে। ওইখান থেকে যাব পাথরঘাটার দিকে, জেলে, আম্মুকে দেখতে।

এর মধ্যে জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। মুরাদুপুর, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া হয়ে আমরা পৌঁছে যাই কর্ণফুলি ব্রিজে। টুটুল গাড়ি পার্ক করে ব্রিজ থেকে একটু দূরে। গ্রীস্মকালের নয়টার সূর্যের আলো পড়ে গাড়ির কাচে, কাচ ভেদ করে পড়ে আমাদের বিনিদ্র চোখের পাপড়িতে।

স্যামুয়েলের চোখ জ্বলে। এই রুট বড় সেনসিটিভ। চারিদিকে সতর্ক পুলিশ, র‍্যাব, স্পাই, ইয়াবা ব্যবসায়ী, বার্মিজ বাদাম চোরাচালানকারি। টুটুল গাড়ি পার্ক করে এমন জায়গায় যেখানে ছায়া নাই। সূর্যের আলো ঘুমিয়ে থাকা মঞ্জুর মুখে পড়ে, মঞ্জু চোখ ঢলতে ঢলতে ঘুম থেকে ওঠে। স্যামুয়েলেরও চোখ জ্বলে।

স্যামুয়েল বলে — টুটুল ব্রো, এইখানে তো অনেক রোদ। এইখানে কেন রাখছেন? ওই যে ওইখানেতো বিল্ডিং এর ছায়া আছে। ওইখানে রাখেন।

মঞ্জু বলে — স্যামুয়েল, শুক্কুরে শুক্কুরে আষ্ট দিন হয় নাই তুমি বিছানায় মুতা বন্ধ করছো! বড়দের কাজে নাক গলাও কেন?

নোমান, টুটুল ও বক্কর প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না।

টুটুল বলে উঠে — মঞ্জু, তুমি কেন নাক গলাও আমার আর স্যামুয়েল ব্রো’র কথার মধ্যে?

টুটুল গাড়িটা গাছের ছায়ায় রাখে। শুধু স্যামুয়েল গাড়ি থেকে বের হয়। স্যামুয়েল কর্নফুলি ব্রিজের তলা দিয়ে বয়ে যাওয়া কর্নফুলি নদীতে চোখ রাখে যেখানে এসে ভিড়বে একটা ফিশিং ট্রলার। এই ট্রলার থেকে মাল নামিয়ে তোলা হবে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রাকে। নদীর পাড়ে একটার পর একটা ফিশিং ট্রলার এসে ভেড়ে, চলে যায়, সেই ফিশিং ট্রলার আসে না।  কিন্তু কিছুক্ষণ পর পর স্যামুয়েলের ফোনে মারজিয়ার কল আসে।

স্যামুয়েল মারজিয়ার সাথে স্পনটেনিয়াসলি মিথ্যা বলে যায় — হ্যাঁ, বাবু, জেলগেইটে… হ্যাঁ এখন আম্মুকে দেখতে ঢুকব।

এক সময় সেই ফিশিং ট্রলার এসে ভিড়ে কর্ণফুলির পাড়ে। মুহূর্তেই পাড়ে এসে পড়ে একটা ট্রাক। স্যামুয়েলে মোবাইলে সেইভ করে রাখা ট্রাকের প্লেইট নম্বর এই ট্রাকটার সাথে মিলিয়ে দেখে গাড়ির কাছে আসে।

স্যামুয়েল নোমানকে বলে — নোমান ব্রো, ঘোড়া তো এসে গেছে।

নোমান স্যামুয়েলকে বলে — তুমি গাড়িতে উঠে ফড়ো, বদ্দা।

স্যামুয়েল গাড়িতে উঠে পড়ে। ট্রলার থেকে মাল খালাস করে তোলা হয় ট্রাকে। ট্রাক ড্রাইভার ট্রাক ছাড়ে। ট্রাকটা উঠে পড়ে পাথরঘাটা যাবার রুটে। নোমান তার হাতে থাকা ওয়ার্লেস মঞ্জুকে দিয়ে বলে—তোমার পোলাপানরে বলো তাদের মাইক্রোবাস যেন তাড়াতাড়ি অলংকার মোড় দাঁড়ায়।

টুটুল গাড়ি স্টার্ট দেয়। মঞ্জু ওয়ার্লেসে বলে — ফোয়া ছা, তোরা আস্তে আস্তে অলংকার মোড় চলি আয়।

নোমান মঞ্জুর দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আমাকে বলে—হইলাম তাড়াতাড়ি, হইয়্যেদে—আস্তে আস্তে! বদ্দা, ফোয়াবে অনের মানুষ ন অইলি ইতেরে এহন আঁই ব্রাশফায়ার গরি দিতাম।

স্যামুয়েল বলে — বদ্দা, মঞ্জু ব্রো’র কমনসেন্স কম হলেও ছেলে ভালো। ব্রো-রে মাফ কইরা দেন।

বলে স্যামুয়েল মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। টুটুল গাড়ি তুলে দেয় পাথরঘাটা রুটে। আমরা চার নম্বর ট্রাকের পিছে পিছে যেতে থাকি। ট্রাক পাথরঘাটা পার হয়। ট্রাকের একটু পিছে আছে আমাদের গাড়ি। আমরা টাইগারপাস থেকে লালখান বাজার যাবার ব্রিজের উপর, আর লালখান বাজারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ট্রাক।

নোমান মঞ্জুকে বলে — তোমার ফোলাফান দাঁড়াইছে অলংকার মোড়ে?

মঞ্জু বলে — আরো এক ঘণ্টা আগে থেকে ওরা অলংকার মোড়ে দাঁড়ায় আছে, বদ্দা।

হঠাৎ ট্রাক ব্রেক ফেইল করে ঢুকে পড়ে লালখান বাজারের আমিন সেন্টারে। আমিন সেন্টারের দেয়ালে লেগে উল্টায় পড়ে ট্রাক। আর ট্রাক থেকে বের হয় গ্রেনেড আর রকেট লাঞ্চার। ট্রাক ঘিরে নগদে ভিড় জমে ওঠে। টুটুল গাড়ি এক দিকে দাঁড় করায়। আমরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি।

ভিড় ঠেলে এক চুলে জটা পড়া পাগল বের হয়ে চিৎকার করে বলে—এই অস্ত্র আমাদের, এই অস্ত্র জনগণের। এই অস্ত্র আজ আমাদের হাতে রাষ্ট্র পালটায় দিবার দায়িত্ব তুলে দিয়েছে।

তার কথা শুনে লোকজন হাসে। একটু পর পাগলের পাশে এসে দাঁড়ায় ভারি চশমা ভারি গলার পরা এক লোক।

ভারি চশমা ও ভারি গলা বলে — প্রিয় বন্ধুগণ এই লোক কিন্তু পাগল না। কমরেড ফজলে রাব্বি। আমার নাম বলরাম কর্মকার। বন্ধুগণ, আমি কমরেড ফজলে রাব্বির নামে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ডাক দিচ্ছি।

নোমান বলে — বদ্দা, পরিস্থিতি ভালো না। এখনই পুলিশ সাংবাদিক সব চলে আসবে এইখানে। চলো, চলে যাই।

স্যামুয়েল বলে — দেখি না ব্রো কী হয়।

মঞ্জু বলে — নোমান বদ্দা, বাকি ছয় ট্রাকের আশা ছেড়ে আমাদের হাতে যা মাল আছে তাই আগে বিক্রি করে দিই। চলেন, বদ্দা, ঝাউতলায় চলেন।

দূরে পুলিশের গাড়ির সাইরেন বাজে।

নোমান স্যামুয়েলকে বলে — বদ্দা, গাড়তে উঠে ফড়ো। চলো চলো…।

সবাই আবার গাড়িতে উঠে বসে। স্যামুয়েলের মুখ থমথমে। গাড়ি চলতে শুরু করে খুলশির উদ্দেশে।

২.

সন্ধ্যার লালিমা মেখে খুলশির ঝাউতলায় ঢুকে পড়ে কমিউনিস্ট পার্টির পতাকার মতো লাল একটা পাজেরো। পাজেরো থেকে নেমে আসে সাদা পাঞ্জাবি পরা ফ্রেন্চকাট এক লোক। তার পিছে পিছে নামে আরো দুই লোক যাদের ভঙ্গিমা দেখে ফ্রেন্চকাটের চ্যালা চ্যালা লাগে। নোমান ফ্রেন্চকাটকে দেখে এগিয়ে গিয়ে মোলাকাত করে। ফ্রেন্চকাটকে দোতলায় নোমান বদ্দার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের পিছে পিছে আমি, স্যামুয়েল ও মঞ্জু ঢুকে পড়ি।

আমি স্যামুয়েলকে একদিকে ডেকে ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করি—মালটা কে, খালাতো ভাই?

মালটার নাম ডিস্কো শফি।

নোমান বদ্দা স্যাম্পল হিসাবে একটা রাইফেল দেখায় ডিস্কো শফিকে। মঞ্জু একটু পর এনে দেখায় একটা রকেট লান্চার, গ্রেনেড লন্চিং টিউব, মাগাজিন ও বুলেট।

নোমান বলে — ডিস্কো বদ্দা, আমাদের আছে ১০, ০০০ পিস গ্রেনেড, ১০০ পিস রকেট লান্চার, ১০০ পিস রকেট, ৬০০ পিস গ্রেনেড লন্চিং টিউব, ২, ৩৯২ পিস ম্যাগাজিন ও ১,৪০,৫২০ পিস বুলেট।’

নোমান স্যামুয়েলকে বলে — বদ্দা, এগুলা সব তোমার মাল। তুমি বলো।

স্যামুয়েল নোমানকে বলে — না, ব্রো। আমি তো অস্ত্রের হিসাব বুঝি না। আপনি বলেন।

নোমান বলে — আরে আমি তো টাকার হিসাব বুঝি না। তুমি বলো।

স্যামুয়েল সেলফোনের ক্যালুকুলেটর বের করে হিসাব করে।

স্যামুয়েল জানায় — এক হাজার কোটি টাকা।

ডিস্কো শফি বলে — এত টাকা দেয়া সম্ভব না। শুনো বদ্দা, আমি দুই কোটি টাকা দিব। দুই কোটি থেকে আমি এক পয়সাও বাড়ায় দিতে পারব না।

স্যামুয়েল বলে — এক হাজার কোটির থেকে এক পয়সা কমে আমি মাল বেচব না।

স্যামুয়েল রুম থেকে বের হয়। আমিও স্যামুয়েলের পিছে পিছে নামি। মাঠে মঞ্জুর পোলাপান অস্ত্র ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সেলফি তোলে এবং সেলফি ফেইসবুকে আপলোড করা যাচ্ছে না বলে একজন আরেকজনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে।

মঞ্জু পোলাপানকে বলে দিয়েছে অপারেশন শেষ হবার আগ পর্যন্ত কোনো ছবি আপলোড করা যাবে না।

হঠাৎ দোতলা থেকে নোমানের গলা ভেসে আসে — সুদানির পোয়া ডিস্কোরে বাঁন। ইতের বইল্লে হাডি লই ফালাইয়ুম আজিয়ে।

কাহিনি কী? শুদ্ধ ভাষার নোমান বদ্দা ক্যান চাঁটগাইয়া বলে? হুঁশ না হারালে তো নোমান বদ্দা চাঁটগাঁইয়া বলে না। নগদে আমি ও স্যামুয়েল দোতলায় উঠি। দোতলায় উঠে দেখি, ডিস্কো শুক্কুরকে তার দুই চ্যালাসহ একসাথে সোফার সাথে বেঁধে ফেলা হচ্ছে রশি দিয়ে।

স্যামুয়েল নোমানকে বলে — ব্রো, কী হয়েছে?

নোমান বলে — আঁল্লই মাম্মি ড্যাডির ডইল্লে ব্রো ব্রো নগরিস, সুদানির ফোয়া।

স্যামুয়েল নগদে ডিপ ফটিকছড়ির স্ক্রিপ্টে চলে যায়।

সে নোমানকে জড়িয়ে ধরে বলে — বদ্দারে, আঁর বদ্দারে, সোয়াবিরিন, বদ্দা সোয়াবিরিন।

কয়েক সেকেন্ডের নিরবতা বয়ে যায় খুলশির ঝাউতলার উপর দিয়ে। নোমান বদ্দার হুঁশ ফিরে আসে।

নোমান সোফায় বন্দি ডিস্কো শফিকে বলে — বদ্দা, আফনি আমারে থ্রেট দিছেন?

স্যামুয়েল নোমানকে জিজ্ঞাসা করে — বদ্দা, কী হয়েছে।

নোমান বলে — ডিস্কো আমারে থ্রেট দিছে দুই কোটি টাকা দিয়ে মাল না ছাড়লে সে ফ্রশাসনরে জানায়া দিবে।

নোমানের কাছ থেকে পুরা ঘটনা শুনে স্যামুয়েল চেতে যায়। স্যামুয়েল অ্যাকশনে যায়। সে উঠে ডিস্কো শফির মুখে জোরে একটা চড় মারে।

মঞ্জুর হাতে ধরা ওয়ার্লেস শব্দ করে। মঞ্জুর পোলাপানদের একটা দল মাইক্রোবাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জিইসি-তে।

ওয়ার্লেসে থেকে ভেসে আসে — মঞ্জু বদ্দা, চারটা র‍্যাবের ট্যাংক যাইতেছে।

নোমান মঞ্জুকে বলে — তোমার পোলাপানরে বলো মাল ট্রাকে তুলতে। শহরে মাল রাখা যাবে না।

মঞ্জু বলে — কই যাব এখন বদ্দা?

নোমান বলে — হাটহাজারির পাহাড়ে। ওইখানে আমার লাইন ঘাট আছে। চিন্তা নাই।

মঞ্জু রুম থেকে বের হয়ে মাঠে আগ্নেয়াস্ত্র ঘিরে থাকা পোলাপানরে বলে—ফোয়া চা, মাল সামানা ট্রাকত তুলি দে। আঁরা আটাজারি যাইয়্যুম।

নগদে সব অস্ত্রপাতি ট্রাকে তুলে ফেলা হয়। স্যামুয়েল, নোমান, মঞ্জু, বক্কর, টুটুল ও আমি নীল গাড়িতে উঠে পড়ি। গাড়ি চলতে শুরু করে।

৩.

সকালবেলার ঝিরি ঝিরি বাতাস বয়ে যায় টিলার ঢালুতে বিছিয়ে রাখা তিনশ একুশ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের ওপর। একে একে সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়ে। খালি স্যামুয়েলকে দেখি না। হালকা টেনশান হয়। কই গেল স্যামুয়েল? ফ্রেশ হয়ে আমি বের হই। বের হয়ে দেখি টিলার উপরে বসে আছে স্যামুয়েল। আমিও টিলাতে উঠি। স্যামুয়েলের পাশে বসি। স্যামুয়েলের চোখ রক্তলাল। আর মুখ বিষণ্ন।

স্যামুয়েলকে বলি — কী, ঘুমাও নাই, খালাতো ভাই?

স্যামুয়েল চুপ।

নোমান টিলার নিচ থেকে আমাদের চিৎকার করে ডাকে — বদ্দা, নিচে চলি আসো। খেয়ে নিই।

আমরা নামি। মাটিতে নানরুটি ও ভাজি দেয়া প্লেইট বিছানো পাটির উপর সবাই বসে। স্যামুয়েলের এক পাশে নোমান বদ্দা অন্য পাশে মঞ্জু। টুটুল আর বক্কর পিছনে বসে আছে। আমি তাদের মুখামুখি। মঞ্জুর ১২৩ জন ছেলে খেতে বসেছে। সবাই একসাথে খায়। স্যামুয়েল চুপচাপ খায়।

স্যামুয়েল বলে — ব্রো, আমরা অস্ত্রগুলা ফ্রশাসনের হাতে তুইলা দিই?

নোমান বলে — কী বলো বদ্দা!

নোমান বদ্দা বেকুব হয়ে আছে শুনে।

নোমান বলে — বদ্দা, তোমার কী হয়েছে বলো তো।

স্যামুয়েল বলে — মারজিয়া আমারে ম্যাসেজ পাঠাইছে ভোরে। গত বিকালে মারজিয়ার বিয়া হয়ে গেছে।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি — এই ম্যাসেজ পাঠাইছে? দেখি?

স্যামুয়েল আমাকে তার ফোনে আসা মারজিয়ার ম্যাসেজ দেখায়।

আমি স্যামুয়েলকে বলি — বিয়া হইছে তো লিখে নাই। লিখছে তো এনগেইজমেন্ট হয়ে গেছে।

স্যামুয়েল আমাকে জিজ্ঞাসা করে — এনগেইজমেন্ট মানে বিয়ে না?

আমি কনফিউজড হয়ে যাই।

আমি নোমানকে জিজ্ঞাসি — বদ্দা, এনগেইজমেন্ট মানে বিয়ে না?

নোমান বদ্দাও কনফিউজড।

নোমান বদ্দা মঞ্জুকে জিজ্ঞাসে।

মঞ্জু তার পোলাপানরে জিজ্ঞাসে — এনগেইজমেন্ট মানে বিয়ে না?

সাথে সাথে মঞ্জুর ১২৩ জন পোলাপান এনগেইজমেন্ট ও বিয়ে নিয়ে গবেষণা শুরু করে। গুগলে সার্চ দেয়। পাহাড়ের ঢালুতে  শোরগোল ওঠে।

নোমানের ফোন বাজে। নোমান সবাইকে চুপ করতে বলে কল রিসিভ করে। ডিস্কো শফির কল।

নোমান স্যামুয়েলকে জিজ্ঞাসা করে—সমস্যা নাই, বদ্দা। তুমি যা বলবা আমরা তাই করব। তুমি বলো এখন কি অস্ত্র ফ্রশাসনের হাতে তুলে দিবা না অস্ত্র সেল করবা?

স্যামুয়েল বলে — সেল, বদ্দা, সেল।

খাবার শেষ হয়। স্যামুয়েল ও আমি উঠে যাই টিলার উপরে। স্যামুয়েল মারজিয়ার বন্ধ ফোনে অবিরাম কল দিয়ে যায়। এক পর্যায়ে স্যামুয়েল তার ফোন অফ করে দেয়।

স্যামুয়েল আমাকে বলে — আমার এই সব ইলিগাল কাব্জাব আর ভাল লাগতেছে না, ব্রো। মালগুলা বেইচা ভুইলা যাব জীবনে এইরকম একটা ঘটনা ঘটছিল! মারজিয়ারে বিয়া করব, চাকরি করব, বাবা/মা হব, সিম্পল স্ট্রেইট লাইফ, সুফি লাইফ।

আমি জিজ্ঞাসি — তুমি না একবার কইছিলা, মারজিয়া বাচ্চা টাচ্চা নিবে না।

স্যামুয়েল বলে — আরে অনেক ঘোড়া এইসব নখরা দেখায়! যে যেটা করবে না বলে নখরামি দেখায় সে সেটাই করে।

স্যামুয়েল আমাকে জিজ্ঞাসে — ডিস্কো শফি কখন আসবে? জানো কিছু?

আমি জানি না।

স্যামুয়েল দূরে দাঁড়ানো মঞ্জুকে জিজ্ঞাসে—ডিস্কো শফি আসবে কখন, ব্রো?

মঞ্জু জবাব দেয় — নোমান বদ্দা সব জানে। আর তুমি আমাকে কোনো প্রশ্ন করবা না। তুমি ছোটভাই, ছোটভাইয়ের মত থাকো।

স্যামুয়েল — ব্রো, আপনের মাল কি মাথায় উঠে থাকে সব সময়? সব সময় মাথা হট কেন!

মঞ্জু হঠাৎ চিল্লায় ওঠে — ঐ মাম্মি ড্যাডির ফোয়া, চুদুরবুদুর গরদ্দে না!

বলে মঞ্জু টিলার উপরে উঠতে থাকে। মঞ্জুর পিছে পিছে উঠে আসে তার পোলাপান।

মঞ্জু এসে স্যামুয়েলকে কলার ধরে শূন্যে তোলে।

মঞ্জু বলে — আজিয়ে তোরে ফাই, মনা।

আমি মঞ্জুকে আটকাই। মঞ্জুর পোলাপান আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।

আমি নোমানকে খুঁজতে টিলা থেকে ঢালুতে নামি। ঢালুতে নেমে দেখি মাটির ঘরে ঘুমায় নোমান, বক্কর ও টুটুল।

টিলার উপরে মঞ্জু ও তার পোলাপান একসাথে স্যামুয়েলকে পিটায়। স্যমুয়েল ‘মাগির ফোয়া, হানকির ফোয়া’ বলে চিল্লায়। এই টিলাতে স্যামুয়েলের চিল্লানি ছাপিয়ে যায় একটা একটা গর্গর গর্গর আওয়াজ। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না আওয়াজটা কীসের।

আওয়াজের উৎস বের করার আগেই দেখি রক্তাক্ত স্যমুয়েল টিলা থেকে নেমে আসে দৌড়ে। স্যামুয়েলের পিছে মঞ্জুরা আছে। স্যামুয়েলের পকেট থেকে চাবি পড়ে যায়। একটু থেমে চাবি কুড়িয়ে আবার দৌড়ায়। স্যামুয়েলের পিছে পিছে দৌড়ায় মঞ্জুরা। স্যামুয়েল দৌড়ে নীল গাড়িতে উঠে পড়ে। আমিও গাড়িতে উঠে পড়ি। সামুয়েল গাড়ি স্টার্ট দেয়। টিলা থেকে বের হয়ে আসার সময় দেখি সাতটা র‍্যাবের গাড়ি যাচ্ছে টিলার দিকে।

অধ্যায় ৪

১.

স্যামুয়েল পুরা রকেটের মতো ড্রাইভ করছে।

আমি স্যামুয়েলকে বলি, ডিস্কো শফির সাথে খারাপ ব্যাবহার করা উচিত হয় নাই। ডিস্কো শফি প্রশাসনকে জানিয়ে দিয়েছে।

স্যামুয়েল বলে, ডিস্কো শফি না। বেঈমানি করছে মঞ্জু।

আমি জিজ্ঞাসি, শিউর?

স্যামুয়েল একটু ভেবে বলে, অবশ্য ডিস্কো শফিও খবর দিতে পারে। শিউর না।

আমি বলি, খালাতো ভাই, ঘোড়া ডিঙায়া খাস খাওয়া ঠিক না।

স্যামুয়েল বলে, কী ঘাস-টাস ব্রো! আমি তো ঘোড়াই জবাই কইরা খায়া ফেলি।

আমি জিজ্ঞাসি, এখন কী করবা? টাকা কেমনে ম্যানেজ করবা? চাকরি কেমনে ম্যানেজ করবা? মারজিয়ারে কেমনে বিয়া করবা?

স্যামুয়েল বলে, সব অটো হয়ে যাবে। অল ঘোড়া কন্ট্রোল।

স্যামুয়েল হুদাই ফাঁকাফাঁকি করে। জীবনে বড় হবার এত বড় সুযোগ সে দুই দিন না যেতেই হারিয়ে ফেলেছে ছয় সাত মিনিট আগে। আমি এই নভেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব হতাশ।

নভেল চালিয়ে নিতে আমি স্যামুয়েলকে জিজ্ঞাসি—অল ঘোড়া কন্ট্রোল এই কথাটা তুমি কার কাছ থেকে শুনছ?

পাঁচ ছয় বছর আগে স্যামুয়েল ঘুরতে গিয়েছিল ঢাকায়। পড়াশোনার উদ্দেশ্যে ধানমণ্ডি সাতাশে অবস্থানরত এক চিটাগোনিয়ান বন্ধুর বাসায় ছিল দুই দিন। এক সকালে স্যামুয়েল একা একা হাঁটতে গিয়েছিল ধানমণ্ডি লেকে।

কোত্থেকে ছবি আঁকার তুলি ও ছবি হাতে এক মোবাইল চিত্রকলা এসে স্যামুয়েলকে জিজ্ঞাসে, ছবি কিনবেন?

স্যামুয়েল এমনিতেই চিত্রকলাদের দুই চক্ষে দেখতে পারি না। স্যামুয়েল ছবিগুলা উল্টায় পাল্টায়। সব দিক দিয়ে খুব বাজে ছবি। স্যামুয়েল জিজ্ঞাসে, কত দাম?

চিত্রকলা — তিন হাজার টাকা।

স্যামুয়েল — এত কম দাম?

চিত্রকলা বলে, তিন হাজার টাকা দিয়ে নেন, পাঁচ বছর পরেই এই ছবির দাম হবে পাঁচ কোটি টাকা।

স্যামুয়েল পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ বের করছে। আর্টিস্ট চকচকে চোখে স্যামুয়েলের দিকে। মানিব্যাগ আবার পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে স্যামুয়েল। চিত্রকলার কপালে ভাঁজ পড়ে।

স্যামুয়েল—তিন হাজার টাকা দিব। আপনি ঠিকঠাকভাবে কালার করে নিয়া আসেন, দ্যান টাকা।

চিত্রকলা বসে বসে ছবির কালার ঠিক করে। এই ফাঁকে স্যামুয়েল আস্তে আস্তে পার্ক থেকে বের হয়ে যায়। একটা রিকশা নিয়ে চলে যায় সোজা বাসার নিচে। স্যামুয়েল রিকশা থেকে নেমে দেখে তার বাসার গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রকলা। স্যামুয়েল চিত্রকলাকে দেখেও না দেখার ভান করে গেইটে ঢুকে পড়ে। চিত্রকলা আটকায়, হাতের ছবিটা দেয়। বলে, টাকা দেন।

স্যামুয়েল হালকা গিলটি ফিল করে। এই অভাবী চিত্রকলারে র‍্যাগ দেয়া ঠিক হয় নাই। স্যামুয়েল বলে, স্যরি, ভাই। আসলে আমার কাছে এত টাকা নাই।

চিত্রকলা জিজ্ঞাসে, কত টাকা আছে?

স্যামুয়েল মিথ্যা বলে, পঞ্চাশ টাকা।

চিত্রকলা বলে, ওইটাই দেন।

একশ টাকা নিয়ে আর্টিস্ট ছবিটা স্যামুয়েলের হাতে দিয়ে বলে, আমার নাম স্মরণে রাখবেন। আমি সোহেল। অল ঘোড়া কন্ট্রোল।

স্যামুয়েল জিজ্ঞাসে, মানে?

চিত্রকলা উত্তর না দিয়ে হাঁটা দেয়। সুযোগ পাওয়া মাত্র আঁতলামি করে ফেলল চিত্রকলা। চিত্রকলা না খালি সব মিডিয়ামের শিল্পীদের ফাতরামির কোন সীমা পরিসীমা নাই। স্যামুয়েল আর্টিস্টদের মনে প্রাণে হেইট করে। কিন্তু এই শ্লোগান তার মাথার ভিতর থেকে আর বের হয় নাই।

স্যামুয়েলের কথা থামে। আমরা অক্সিজেনে জ্যামে। দশ মিনিট চলে যায়। জ্যাম ছাড়ে না। আমি ও স্যামুয়েল গাড়ি থেকে নামি। গাড়ি থেকে সামনে গিয়ে দেখি পুলিশ রাস্তা ব্লকড করে দিয়েছে। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে পুলিশের গাড়ি। লোকজন বলাবলি করে, চিটাগং ক্যান্টনমেন্টে হামলা হয়েছে।

স্যামুয়েল এক লোককে জিজ্ঞাসা করে, কারা হামলা করেছে?

লোকটা বলে, জাইনা কী করবেন?

স্যামুয়েল বিরক্ত হয়। একটু পর একদল আর্মিকে প্রাণপণে দৌড়ে আসতে দেখা যায় অক্সিজেনের দিকে।

আর্মি এসে পুলিশকে বলে, আপনারাও পালান।

সাথে সাথে গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ পালাতে শুরু করে। পুলিশের দেখাদেখি মানুষও দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করে। আমি ও স্যামুয়েল একটু পিছিয়ে আমাদের গাড়িটার কাছে যাই। একটু পর কয়েকটা আর্মি ট্যাংক এসে পড়ে। ট্যাংক থেকে নেমে আসে এক খাটো টাক মাথার লোক। তার পিছে পিছে নেমে আসে কয়েকটা নওজোয়ান। আমি ভাল করে তাকিয়ে নওজোয়ানদের চিনতে পারি। এরা মঞ্জুর পেন্টিয়াভ ফাইভের পোলাপান।

স্যামুয়েল বলে, ব্রো, চলো পালাই।

আমরা গাড়িতে উঠে পড়ি। খাটো টাকমাথা দিগবিদিক ছুটতে থাকা জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়া শুরু করে হ্যান্ডমাইক দিয়ে। “প্রিয় দেশবাসী। আপনাদের বিপ্লবী অভিনন্দন। নাফ নদী থেকে ফেনি নদী পর্যন্ত এলাকায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি… ।”

স্যামুয়েলকে বলি, নিউ বিপ্লবী সার্কাস পার্টি।

স্যামুয়েল আমাকে বলে, আস্তে, ব্রো। শুনলে গুলি কইরা দিবে।

বক্তৃতা চলে, এই বিপ্লবে শামিল হতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কমরেড ফজলে রাব্বি।

স্যামুয়েল আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ব্রো, ফজলে রাব্বি সেই ঘোড়াটা না?

হ্যাঁ। এই সেই ঘোড়া। পাঁচ নম্বর ট্রাক ব্রেক ফেইল করে বহদ্দারহাট বাজারে ঢুকে পড়ার পর ওইখানে যে পাগল জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিল সেই ঘোড়াটাই কমরেড ফজলে রাব্বি।

আমি বলি, খালাতো ভাই, শহরে ঢুকা সেইফ হবে না। চলো হাটহাজারির দিকে চলে যাই।

স্যামুয়েল বলে, হাটহাজারিও সেইফ না। আরো ডিপে চলে যেতে হবে। চলো ফটিকছড়ি চলো।

২.

রাতে ফটিকছড়ির কাঞ্চনপুরের এক গভীর গ্রামে এসেছি একটু আগে। এই বাড়ির নাম মিঞা সওদাগরের বাড়ি। স্যামুয়েলের দাদা মিঞা সওদাগর। এইখানে স্যামুয়েলের নিঃসন্তান চাচা-চাচি থাকে।

ভাত খেয়ে আমরা টিভি দেখি। টিভি খবরে দেখায় নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলারা চিটাগং ডিভিশনের সব জেলার সব শহরের ক্যান্টনমেন্ট ও থানা দখল করে ফেলেছে। কমরেড ফজলে রাব্বির চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল, চূড়ান্ত বিকেন্দ্রিক, চূড়ান্ত বেপরোয়া সেনাবাহিনীর ভয়ে আর্মি, পুলিশ সব ব্যারাক ছেড়ে পালিয়ে গেছে। হালকা একটু রক্ত অবশ্য ঝরেছে। এক গেরিলা বন্দুক ঘাড় থেকে নামাতে গিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে নিজের মাথা। শহীদ সেই গেরিলার স্মৃতিতে শোকবার্তা পড়ে কমরেড ফজলে রাব্বি।

স্যামুয়েল বলে, দশ ট্রাক অস্ত্র এই পাগলটার কন্ট্রোলে কীভাবে গেল? বুঝলাম না আমি।

আমি বলি, খালাতো ভাই। কেমনে কী বুঝতে যায়ো না। বাদ দাও। চলো ঘুমাই পড়ি।

সূর্যের আলো ফোটে। ঘুম থেকে উঠে দেখি স্যামুয়েলের চাচি আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে পাঁচ-ছয় পদের পিঠা, দুধ, চা।

চাচা স্যামুয়েলকে জিজ্ঞাসা করে, ভাইপো, চিটাগং নাকি আর বাংলাদেশ নাই? চিটাগং নাকি আলাদা রাষ্ট্র!

স্যামুয়েল বলে, এগুলা যে কী হইতেছে আমি বুঝতেছি না চাচা।

সিটিভি মানে চিটাগং টেলিভিশন থেকে লাইভ দেখানো হয় জনগণতান্ত্রিক চট্টগ্রাম সরকারের রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রেস কনফারেন্স। জনগণতান্ত্রিক চট্টগ্রাম সরকারের এক প্রতিনিধি ঘোষণা করে—আগামি সাত ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল, রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীসভা শপথগ্রহণ করবে। সন্ধ্যা সাতটায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবে সিটিভি।

না। আর টিভি দেখা যাবে না। স্যামুয়েলের বাড়ি থেকে বের হয়ে নদীর ধারে যাই। নদীর উপরে ঝুলন্ত সেতু পার হয়ে চলে যাই আরো পশ্চিমে। যত পশ্চিমে যাই, মানুষের চিহ্ন দেখা যায় না।

গভীর বন। পাশ দিয়ে দুই একজন কাঠুরে চলে যায় বাঁশ নিয়ে। একটা ছোট টিলার উপরে উঠে বসি আমি ও স্যামুয়েল। টিলার ঢালুতে একটা ঝিল, তাতে ওযু করছে চেক লুঙ্গি, ফুলহাতা চেকশার্ট পরা চুলে দাড়িতে জট ধরে যাওয়া একজন। পাশেই দুই তিনটা তাঁবু টাঙ্গানো। পড়ে আছে দুই তিনটা পেপসির প্লাস্টিক বোতল। দুইজন রান্না করে, একজন চেক লুঙ্গির মাথায় ছাতা ধরে আছে, একজন চেক লুঙ্গি থেকে মুখ লুকিয়ে সিগারেট খায়। যে সিগারেট খাচ্ছিল সে আমাদের কাছে এসে সালাম দিয়ে পরিচয় ও উদ্দেশ্য জিজ্ঞাসা করে।

স্যামুয়েল তাদের পরিচয়, উদ্দেশ্য জিজ্ঞাসে। লোকটা দূরে অযুরত চেক লুঙ্গিকে দেখিয়ে বলে, ওই যে দেখছেন উনি সাধারণ লোক না…। কথা থামে না।

স্যামুয়েল কথাগুলা শোনার জরুরত ফিল করে না বলে কান অফ করে দিয়ে পাহাড়ের গায়ে পড়া রৌদ্রের চলাচল দেখে।

লোকটার কথা শেষ হলে স্যামুয়েল জিজ্ঞাসা করে, ঘোড়াটার নাম কী?

লোকটা বিরক্ত হয়ে বলে, ঘোড়া মানে?

স্যামুয়েল বলে, আমি খারাপ অর্থে ঘোড়া বলি নাই।

লোকটা কনভিন্সড হয়ে বলে হুজুরের নাম বলে, উনি হলেন মজজুবে ছালেক ফানা ফিল্লা বর্তমান জমানার জিন্দা ওলি ফরিদ শাহ বি এ অনার্স এম এ…। কথা থামে না।

স্যামুয়েল আবার কান অফ করে দেয়।

কথা থামলে আমি লোকটাকে বলি — এই জীবন নিয়ে বড় মুসিবতে আছি। তিন বছর ধরে আমার কোনো চাকরি নাই, একটা ব্যবসা হবে হবে করছিল, হয় নাই। ক্রিয়েটিভ কাজ যেমন ধরেন নভেল, লেখা শুরু করসিলাম, তাও শেষ হয় নাই। আমি ভাই নাই হয়া আছি। একটু ফরিদ শাহের কাছে আমার নামে আর্জি পেশ করেন।

লোকটা টিলা থেকে ঢালুতে নামে। ফরিদ শাহের কাছে যায়। একটু পর লোকটা আবার আমাদের কাছে এসে জানায়—বাবা, এখন দুনিয়াবি হালতে নাই।

আমরাও ঢালুতে নামি। ফরিদ শাহ একটু দূরে অযু শেষ করে দুনিয়া থেকে আলগা হয়ে বসে আছেন। ফরিদ শাহ আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আকাশে শরতের নীল সাদা সাদা করে দেয় মেঘ ও বক। আমিও আকাশের দিকে তাকাই। আকাশ থেকে দৃষ্টি নামালে দেখি ফকির এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

চোখে চোখ পড়লে জিজ্ঞাসি — দুনিয়ার কী হাল?

ইষৎ বিলা খেয়ে ফকির মুখ ফিরিয়ে আবার আকাশ দেখে। আমি ও আকাশের দিকে তাকাই। আকাশে শরতের নীলকে আরেকটু সাদা করে ও নির্জনতা চোচির করে ছোটে হেলিকপ্টার।

মুখ নামিয়ে দেখি ফরিদ শাহ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

ফরিদ শাহ বলে, আমি রেডিও না যে তোর কাছে দুনিয়ার খবর দিব?

আমি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি — ও আপনি রেডিও না, তাইলে আপনি কি টিভি?

ফরিদ শাহ খুব বিরক্ত হয়ে আবার আকাশের দিকে মুখ ফেরায়। আকাশের হেলিকপ্টারের শব্দ আর একটু তীব্র হয়। আমি ফরিদ শাহ’র আশেকানদের একজনকে খোঁজি — সিগারেট দরকার। স্যামুয়েল ফরিদ শাহের দিকে তাকিয়ে আছে। প্লেইনের শব্দ একটু তীব্র হয়।

ফরিদ শাহ আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে বলে—আমি রেডিও না, আমি টিভি না, আমি ইন্টারনেট না, আমি জাস্ট একটা অ্যান্টেনা। সো কোনো কথা হবে না।

ফরিদ শাহকে আরেকটু চেতিয়ে দিলে আনন্দ হয়, তাই আবার জিজ্ঞাসা করি—চাইনিজ অ্যান্টেনা না জাপানিজ অ্যান্টেনা নাকি হোমমেইড অ্যান্টেনা?

ফকির উত্তর না দিয়ে আবার আকাশের দিকে মুখ ফেরায়। আর মুখ নামায় না। বিমানের শব্দ তীব্রতর হয়। সবাই আকাশের দিকে তাকায়। সাথে সাথে চিল্লাচিল্লি শুরু হয়ে যায়, আতঙ্ক টুকরা টুকরা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।

সবাই দৌড়াতে শুরু করে। দিকবিদিক। আমিও। শুধু ফরিদ শাহ তার জায়গায় স্থির। আল্লার ইশকে ফানা হওয়া ফরিদ শাহ হেলিকপ্টারটা দেখে। হেলিকপ্টার কন্ট্রোল হারিয়ে ধেয়ে আসছে এই দিকে। সাত সাত আট সেকেন্ডের মধ্যে বিমানটা ক্র্যাশড হয় সামনের টিলায়। ফরিদ শাহ ছাড়া আমরা সামনের টিলার দিকে যাই।

আমরা দৌড়ে হেলিকপ্টারের কাছে যাই। হেলিকপ্টারের দরজা খুলে হেলিকপ্টারের ভিতরে থাকা দুই জনকে বের করা হয়। একজন অলরেডি মরে গেছে। আরেকজন অজ্ঞান। ফরিদ শাহের আশেকানরা লোকটার সেবা-শুশ্রুষা করে। হেলিকপ্টার থেকে ছিটকে বের হয়ে পড়া একটা ভারি বাক্স পড়ে আছে। আশেকানরা বাক্সটা ফরিদ শাহের জিম্মায় রেখে আসে।

একটু পর বেঁচে থাকা কপ্টার আরোহীর জ্ঞান ফিরে আসে।

কপ্টার আরোহি বলে, আমি কমরেড জুবায়ের জুয়েল। আমি গণপ্রজাতন্ত্রী চট্টগ্রাম সরকারের একজন এজেন্ট। কয়টা বাজে?

এখন বারোটা।

জুবায়ের বলে, প্রিয় জনগণ, আপনারা আমাকে সাহায্য করুন। এই প্লেইনে আপানারা কি বড় কোনো বাক্স পেয়েছেন?

এক আশেকান জবাব দেয়, বাক্সটা বাবার হেফাজতে।

জুবায়ের বলে, এই বাক্সে একটা মেশিন আছে। মেশিনটা খুব জরুরি।

স্যামুয়েল জিজ্ঞাসে, জরুরি কেন?

জুবায়ের বলে, গণপ্রজাতন্ত্রী চট্টগ্রাম সরকারের প্রেসিডেন্টের মাথা ক্র্যাশ করেছে!

স্যামুয়েল, ক্র্যাশ মানে কী? ওই কমরেড ফজলে রাব্বি আগাগোড়াই একটা পাগল।

জুবায়ের বলে, প্রেসিডেন্টের নামে কোনো অশোভন কথা বলা হলে পার্টি ব্যবস্থা নিবে।

স্যামুয়েল একটা ঘুষি মারে জুবায়েরের মুখে। জুবায়ের আবার অজ্ঞান হয়ে যায়।

ফরিদ শাহ তার আশেককে বলে, কেরোসিন নিয়া আসো।

সাথে সাথে কেরোসিন নিয়ে আসা হয়।

ফরিদ শাহ বলে, গাছ নিয়ে আসো। আর এইখানে একটা বড় সাইজের আগুনের গোল্লার জন্ম দাও।

তার আশেকানরা গাছ কেটে নিয়ে এসে এক জায়গায় জড়ো করে। গাছে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়।

আবার জুবায়েরের জ্ঞান ফিরে আসে। ফরিদ শাহ আগুনের গোল্লার মধ্যে দেয়ার জন্য মেশিনটাকে হাতে নেয়। জুবায়ের এই সিন দেখে টাসকি খায়।

জুবায়ের পিস্তল বের করে ফরিদ শাহের দিকে ধরে, ঘোড়া টাইনা দিব কিন্তু।

ফরিদ শাহ ভয় পায় না।

ফরিদ শাহ জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে বলে, টান দাও মিয়া। এইটা পুড়বে। কোনো ফজলে রাব্বি বা চারু মজুমদার বা কমিউনিস্ট কোনো বাতিল ফেরকার ঠাঁই চট্টগ্রামের জমিনে হবে না।

জুবায়ের পিস্তল হাতে টক টক করে কাঁপে। কাঁপতে কাঁপতে আবার জ্ঞান হারায় জুবায়ের।

স্যামুয়েল ফরিদ শাহকে বলে, এই মেশিনটা নষ্ট করে লাভ কী? বরং জুবায়েরকে এইখানে বাইন্ধা আমরা মেশিনটা নিয়ে শহরে চলে যাই। এই মেশিনটার উসিলায় আমরা রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢুকে যেতে পারব! কী বলেন ব্রো?

ফরিদ শাহ বলে, ব্রো আবার কী? বাবা বল।

স্যামুয়েল বলে — বাবা।

ফরিদ শাহ স্যামুয়েলকে বলে, তোর মাথায় আল্লা যে বুদ্ধি দিছেন শুকরিয়া। তোর নাম আমি আমার আশেকানের লিস্টে তুইলা নিলাম।

স্যামুয়েল বলে, বাবা, আমি আশেকান না। আমি আপনের এজেন্ট হতে চাই।

ফরিদ শাহ বলে, আগে ছোট থেকে শুরু কর। এই যে দেখছস এরা আমার ওল্ড, ভেরি ওল্ড ফ্যান। এইখানেই এজেন্ট হতে চায় তিনজন। তাদের বাদ দিয়ে তোরে কেমনে বানাই? আশেকান দিয়া শুরু কর প্রেসিডেন্ট হয়া বের হবি।

স্যামুয়েল আমারে কানে কানে বলে — আমিও আজ থেকে মারফতিদের বিরুদ্ধে। মারফতিরা সব মুশরিকের বংশধর।

টিলার বৃক্ষরাজির দিকে তাকিয়ে স্যামুয়েল আমার কানে কানে বলে — ব্রো, ত্বরিকত, বেলায়েত, মারফত  সব পথে হায়ারার্কি আছে। শুধু শরিয়তে কোনো হায়ারার্কি নাই।

আমি বলি, এতদিনে বুঝলা, খালাতো ভাই?

স্যামুয়েল বলে, আমি ফরিদ শাহরে একদম চুদে দিবো। ওয়েইট।”

৩.

বিকাল। শহরে ঢোকার মুখে আমাদের গাড়ি আটকায় একটা চেকপোস্ট।

স্যামুয়েল চেকপোস্টে দাঁড়িয়ে থাকা গেরিলাদের জিজ্ঞাসা করে—প্রেসিডেন্ট ভবন কই?

আরো অনেক চেকপোস্ট পার হয়ে সার্সন রোডে ঢুকে পড়েছে আমাদের নীল গাড়ি।

সার্সন রোডে ট্যাংকের চলাচল। সামনে নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি’র আরেকটা চেকপোস্ট। চেকপোস্টে গাড়ি থামায়। স্যামুয়েল কথা বলে। গাড়ি ছেড়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট ভবনের গেইটেও চেকপোস্ট। স্যামুয়েল চেকপোস্টে গাড়ি থামায়। একজন গেরিলা গাড়ির কাচে এসে গাড়ির ভিতরে আমাদের দেখে।

গেরিলা স্যামুয়েলকে বলে — ঐপ! স্টার্ট বন্ধ! গাড়ি থেকে নামেন।

আমরা গাড়ি থেকে নামছি।

গেরিলা বলে — হাত উপরে তুলে নামেন।

আমি ও স্যামুয়েল দুই হাত উপরে তুলে গাড়ি থেকে বের হই। ফরিদ শাহ হাত উপরে না তুলে বের হয়। ফরিদ শাহের দেখাদেখি তার আশেকানও হাত উপরে না তুলেই বের হয়।

গাড়ি থেকে বের হয়ে ফরিদ শাহ পুরা পাটে চলে যায়। গেরিলারা তাকিয়ে আছে ফরিদ শাহের দিকে। ফরিদ শাহ তাকিয়ে আছে আসমানের দিকে। ফরিদ শাহ আসমান থেকে চোখ নামিয়ে সেনাবাহিনীর দিকে তাকিয়ে তর্জনি আকাশের দিকে তুলে আবার আসমানে তাকায় ফরিদ শাহ। এক গেরিলা ফরিদ শাহের পেটে রাইফেল দিয়ে খোঁচা দেয়। রাইফেলের খোঁচা ফরিদ শাহের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। তবে তার আশেকানের উপর প্রভাব ফেলে। আশেকান সাথে সাথে হাত উপরে তোলে। আর ফরিদ শাহ আকাশের দিকে তাকিয়েই থাকে।

স্যামুয়েল গেরিলাকে বলে — ব্রো…।

গেরিলা বলে, ‘ব্রো’ আবার কী। ‘কমরেড’ বলুন…।

স্যামুয়েল বলে — স্যরি ব্রো… কমরেড, প্রেসিডেন্টের মাথা ঠিক করতে একটা মেশিন কপ্টারে কইরা বাংলাদেশ থেকে আনার কথা ছিলো না?”

গেরিলা বলে — হ্যাঁ! হ্যাঁ! অনেকক্ষণ ধরে আমরা ওই কপ্টারের কোন সিগন্যাল পাচ্ছি না।

স্যামুয়েল বলে — সিগন্যাল কেমনে পাবেন? ওই কপ্টারটা কাঞ্চনপুরে ক্র্যাশ করেছে। আমরা মেশিনটা উদ্ধার করেছি।

গেরিলা স্যামুয়েলকে জিজ্ঞাসে — এরা ফরিদ শাহ ও তার আশেকান। আপনি কে?

স্যামুয়েল বলে—যে টিলায় বিমান বিধ্বস্ত হয় ওইখানে আমার দাদুবাড়ি। আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম।

গভীর সন্দেহ নিয়ে গেরিলাটি স্যামুয়েলের দিকে তাকায়। নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলারা মেশিনটা একটা জিপে তুলে সাইরেন বাজাতে বাজাতে টিভি স্টেশনের দিকে চলে যায় মেশিনটা নিয়ে।

প্রেসিডেন্ট এখন টিভি স্টেশনে। গেইট খুলে দেয়া হয়। একদল গেরিলা আমাদের নিয়ে যায় প্রেসিডেন্ট ভবনের ভিতরে। একটু পরে রাষ্ট্রের একজন হাই অফিশিয়াল আমাদের সাথে দেখা করতে আসবে।

৪.

আমরা একটা রুমে বসে আছি। আমাদের চা ও বেলা বিস্কুট দেয়া হয়। হাই অফিশিয়াল রূপে আমাদের সামনে হাজির হয় মঞ্জু।

মঞ্জু স্যামুয়েলকে দেখামাত্র গেরিলাদের নির্দেশ দেয় — এই চুদানির পোয়া রাষ্ট্রদ্রোহি। ইতেরে বান দে…।

অধ্যায় ৫

১.

আমরা বসে আছি গণপ্রজাতন্ত্রী চট্টগ্রাম সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ভবনের ভিজিটরস রুমে। গেরিলারা স্যামুয়েলের দিকে ছুটে আসে। এমন সময় রুমে প্রবেশ করে বলরাম কর্মকার। বলরাম কর্মকার গণপ্রজাতন্ত্রী চট্টগ্রাম সরকারের গোপন আব্বু।

বলরাম কর্মকার বলে—কমরেড, কী হচ্ছে এইখানে? আপনারা কাকে মারছেন?

মঞ্জু বলরাম কর্মকারকে বলে — এই পোলাটা দেশদ্রোহী।

বলরাম কর্মকার — কীভাবে?

মঞ্জু বলরাম কর্মকারকে সব কথা গুঁড়া গুঁড়া করে বলে।

বলরাম কর্মকার বলে — কমরেড মঞ্জু! নিজেদের মধ্যে বিরোধ ভাল না। মাও সেতুং যেখানে বলেছেন শত্রুর শত্রু আমাদের বন্ধু সেখানে আপনি বন্ধুকেও শত্রুর কাতারে ফেলে দিচ্ছো! আর আপনার পোস্টিং ফেনি ক্যান্টনমেন্ট। আপনের ইউনিটের গেরিলারা সবাই ফেনির পথে রওনা হয়ে গেছে। আপনি এইখানে কী করছেন? ফেনির দিকে চলে যান।

মঞ্জু বলে — ঠিক আছে কমরেড। আমার সাথে স্যামুয়েলকেও নিয়ে যাই। আমারে অ্যাসিস্ট করবে!

বলরাম কর্মকার — মার্ক্সিজম কী বস্তু আপনি এখনো বুঝতে পারেন নাই, মঞ্জু। এইখানে কেউ কারো সহকারি না।

মঞ্জু বলে — আপনে ডাণ্ডি পটাশ! ডাণ্ডি পটাশ থেকে আমি কিছু শিখতে চাই না।

বলরাম কর্মকার গেরিলাদের নির্দেশ দেয় — কমরেড, অশোভন আচরণের জন্য মঞ্জুকে বন্দি করা হোক।

সাথে সাথে গেরিলারা টেনে নিয়ে যায় মঞ্জুকে।

বলরাম কর্মকার বাবলুকে বলে — একজন খাঁটি বিপ্লবী নির্মোহ…

বাবলু কান অফ করে ফেলে। এইসব কথা সে জীবনে অনেক শুনেছে।

বলরাম কর্মকারের কথা থামলে ফরিদ শাহকে দেখিয়ে বাবলু বলরাম কর্মকারকে বলে — কমরেড ব্রো, উনি ফরিদ শাহ।

বলরাম খুব তাজিমের সাথে ফরিদ শাহের সাথে মোলাকাত করে। বলরাম খুব মনোযোগ দিয়ে ফরিদ শাহের দিকে তাকিয়ে ফরিদ শাহের গতিবিধি ফলো করে। বলরাম কর্মকারের হাতের সেলফোন বেজে ওঠে একটু পর পর। বলরাম কর্মকার ফোন নিয়ে উঠে চলে যায়। একটু পর আবার ফিরে আসে। বলরাম কর্মকার রুমে ঢুকে ফরিদ শাহকে মনোযোগ দিয়ে দেখে।

বলরাম কর্মকার রুমে আসলে বাবলু তার হাতের ফোন দেখিয়ে বলরাম কর্মকারকে জিজ্ঞাসে — কমরেড ব্রো, এই ফোনের চার্জার হবে?

বলরাম খুব বিরক্ত হয়। একটা রাষ্ট্র গঠন করা কি যেই সেই ব্যাপার। কতটা আবাল হলে দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিকালীন সময়ে স্যামুয়েল অসামান্য বলরাম কর্মকারের কাছে সামান্য মোবাইল ফোনের চার্জার খোঁজে। কিন্তু বলরাম স্যামুয়েলকে ঠিক অপছন্দ করতে পারে না।

বলরাম স্যামুয়েলকে রুমের এক কোনায় দেখিয়ে দেয়। স্যামুয়েল ফোনের সাথে চার্জার কানেক্ট করে মারজিয়াকে কল করে। মারজিয়ারফোন বন্ধ।

স্যামুয়েল আমাকে বলে — মারজিয়া যদি বিয়া করে ফেলে তাইলে আমি মারজিয়ার জামাইকে শুট করে দিব।

আমি বলি — কইরো, খালাতো ভাই।

স্যামুয়েল বলে — কিন্তু মারজিয়ার জামাইরে শুট করব ক্যান? তার কী দোষ? সব দোষ মারজিয়ার বাপের। আমি মারজিয়ার বাপরে শুট করে দিব।

আমি বলি — কইরো, খালাতো ভাই।

স্যামুয়েল বলে — কিন্তু মারজিয়ার বাপের কী দোষ? আমিই তো তার কাছে বিয়ার প্রপোজালই নিয়া যাই নাই। সব দোষ মারজিয়ার। আমি মারজিয়াকে শুট করে দিবো।

আমি বলি — কইরো, খালাতো ভাই।

স্যামুয়েল বলে — কিন্তু মারজিয়ার তো কোনো দোষ নাই। সে তো আমাকে অনেক টাইম দিছে। আমাকে বার বার বলেছে একটা চাকরি জোগাড় করে ফেলতে। মারজিয়ার কোনো দোষ নাই। সব দোষ আমার। আমি আমারেই শুট করে দিব। কিন্তু আমি আমারে শুট করব ক্যান? সুইসাইড করা হারাম। নো। আমি মারজিয়ার জামাইকেই শুট করে দিব।

২.

আমি কিছু বলি না। বলরাম কর্মকার রুমে আসে। তার পিছন পিছন গেরিলারা এসে একটা মনিটর সেট করে। ইন্টারনেট কানেক্ট করে। মনিটরে ভেসে ওঠে চট্টগ্রাম টেলিভিশন কেন্দ্র। কমরেড ফজলে রাব্বি শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। আমাদের উদ্ধার করা মেশিন থেকে বের হওয়া একটা কয়েকটা চিপ সেট করা হয় ফজলে রাব্বির মাথায়। ফজলে রাব্বি মাথা তোলে। তার চোখে হাল্কা চাঞ্চল্য দেখা যায়। বলরাম কর্মকার ও তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বীর গেরিলাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে ওঠে।

ফজলে রাব্বি বলে — মেইক আপ। আই উইল গিভ অ্যা স্পিচ।

সাথে সাথে মেকাপম্যান হাজির। মেকাপ শেষ হবার আগেই ফজলে রাব্বির চোখ স্থির হয়ে যায়, মাথা গড়িয়ে পড়ে নিচে। আবার মেশিন। আবার চেষ্টা। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ফজলে রাব্বি অফ।   

বলরাম কর্মকার গেরিলাদের বলে — মনিটর সরাও।

মনিটর নিয়ে চলে যায় গেরিলা। বলরাম কর্মকার পায়চারি করে ভিজিটরস রুমে। তার মোবাইল বাজে। রাত নয়টা। রাষ্ট্রপতি কোমায় চলে গেছে। প্রেসিডেন্টকে নিয়ে কী করবে বলরাম কর্মকার ভাবে। নিজেই কি নিজেরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন? বলরাম কর্মকার রুমে আসে।

সে ফরিদ শাহ কে জিজ্ঞাসে — আপনি কি প্রেসিডেন্ট হবেন?

ফরিদ শাহের ভক্তদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারা ফরিদ শাহের কেরামতি দেখে। ফরিদ শাহ নিজে থেকে একবারও বলে নাই সে আসলে এইখানে এসেছে প্রেসিডেন্ট হতে। অথচ অটোমেটিক তাকে প্রেসিডেন্ট হতে বলা হচ্ছে।

ফরিদ শাহ আকাশের দিকে তাকিয়ে গলায় বলে — আল্লাহ! আমি তো সিংহাসন চাই নাই, আমি চেয়েছি তোমার দিদার।

বলরাম কর্মকার বলে — কমরেড, আপনাকে রেডি হতে হবে।

ফরিদ শাহ বলে — আমি তো জন্ম থেকে রেডি হয়ে আছিরে, পাগলা।

বলরাম বলে — কমরেড, উইথ ডিউ রেসপেক্ট বলতে চাই — পাগলা বলা যাবে না।

ফরিদ শাহ বলে — এক নম্বর কথা হল তুমি আমারে কমরেড বলবা না। বাবা বলবা বাবা, বাবা ডাকতে যদি লজ্জা লাগে স্যার বলবা। দুই নম্বর কথা হল — তুমি ইহুদি মার্ক্সের পথে দেশকে নিয়া যেতে চাও। আমার রাষ্ট্রে কোনো মার্ক্স টার্ক্স কারো রুল চলবে না।

ফরিদ শাহ গেরিলাদের নির্দেশ দেয় — এই ইহুদির এজেন্টটাকে জেলে ভইরা দাও।

গেরিলারা বলরামের দিকে তাকায়।

বলরাম কোমর থেকে রিভলবার বের করে ফরিদ শাহকে বলে — প্রেসিডেন্ট হবেন শুনে বিচি কান্ধে উইঠা গেছে? এইসব ভুংভাং আমারে দেখায়া লাভ নাই। যদি প্রেসিডেন্ট হতে চান আমার কথামত চলবেন। আমরা মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, মাওবাদ ও চারু মজুমদারের শিক্ষার ভিত্তিতে আমাদের দেশ চট্টগ্রামকে গড়ে তুলব। আপনি প্রেসিডেন্ট হবেন নাকি হবেন না বলেন।

ফরিদ শাহ বলে — তোর প্রেসিডেন্টের কেথা ফুড়ি।

বলরাম কর্মকার — কোনো সমস্যা নাই। আপনার জন্য জেলখানার দরজা খোলা আছে।

ফরিদ শাহ বলরামকে বলে — ঠিক আছে। সব তোমার কথামত হবে। খালি আমার একটা দাবি।

বলরাম জিজ্ঞাসে — কী দাবি?

ফরিদ শাহ বলে — আমার রাষ্ট্রে যেন দুনিয়ার সব পীর-মজ্জুবদের যেন ওপেন করে দেয়া হয়।

বলরাম কর্মকার ভেবে বলে — ওকে, প্রেসিডেন্ট।

বলে বলরাম কর্মকার আর্মি কায়দায় স্যালুট দেয় ফরিদ শাহকে। সাথে সাথে বলরাম কর্মকারের গেরিলারা আর্মি কায়দায় ফ্লোর কাঁপিয়ে স্যালুট ঠুকে ফরিদ শাহকে। ফরিদ শাহও সোফা থেকে উঠে আর্মি কায়দায় স্যালুট গ্রহণ করে।  

বলরাম স্যামুয়েলকে বলে — কমরেড, আপনি প্রেসিডেন্টরে স্যালুট দেন নাই কেন? আমি তো আরো ভাবছিলাম আপনাকে আমাদের পার্টির যুব ব্রিগেডের চিফ বানাবো।

স্যামুয়েল বলে — কমরেড ব্রো, আমি তো স্যালুট দিছি।

বলরাম — কই? আমি তো দেখলাম না।

স্যামুয়েল বলে — দেখবেন কেমনে? মনে মনে দিছি আর কি।

প্রেসিডেন্ট ফরিদ শাহ বলে — আমি তোর স্যালুট পেয়েছিরে, পাগলা।

বলরাম ফরিদ শাহকে বলে — ডিয়ার প্রেসিডেন্ট, আপনাকে এক্ষুনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে হবে। টেলিভিশন সেন্টারে যেতে হবে।

বলরাম স্যামুয়েলকে বলে — আর কমরেড আপনার নাম যেন কী?

স্যামুয়েল বলে — আমি আর্তুর র‍্যাঁবো।

বলরাম বলে — আপনে খৃস্টান নাকি?

স্যামুয়েল বলে — না। না। মুসলমান।

বলরাম বলে — র‍্যাঁবো আবার কী ধরনের নাম?

স্যামুয়েল বলে — র‍্যাঁবো নকশাল মুভমেন্টের এক শহীদ নেতার নাম!

বলরাম বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসে — ও হ্যাঁ হ্যাঁ আমি কই যেন পড়েছিলাম। এই নাম কে রেখেছে?

স্যামুয়েল বলে — আমার আব্বু।

বলরাম বিস্ময় নিয়ে বলে — কী বলেন?   

স্যামুয়েল বলে — আমার বাপের হোক্সাপন্থি কোনো পার্টির সাথে কানেকশন ছিল।

স্যামুয়েলের এই স্পনটেনিয়াস চাপাবাজি তারে কই নিয়ে যাবে কে জানে?

বলরাম বলে — বাহ! হোয়াট অ্যা কো-ইনসিডেন্স। মঞ্জুর পরিবর্তে আমরা আমাদের যুব ব্রিগেডের জন্য আরো বেটার সম্ভবত সবচেয়ে বেস্ট সভাপতি পেয়ে গেছি। কমরেড আতুড় খেম্বো…।

স্যামুয়েল বলে—উইথ ডিউ রেসপেক্ট কমরেড, আতুড় মানে লুলা… আতুড় না… বলেন আর্তুর… আর খেম্বো না। র‍্যাঁ..বো…।

বলরাম বলে — কমরেড আর্তুর র‍্যাঁবো,  আপনাকে যুব ব্রিগেডের চিফ হিসাবে মনোনিত করা হল। আপনারে রাষ্ট্রের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়া হালকা ব্রিফ করছি। আপনার কাজ করতে সুবিধা হবে। বর্ডারে বর্ডারে আমাদের গেরিলারা আছে। গেরিলাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের জাতীয় বীর ফিল্ড মার্শাল কমরেড খোকা। আমাকে প্রেসিডেন্টকে নিয়ে যেতে হবে টিভি সেন্টারে। আরো দেশী বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সাথে মিটিং করতে হবে। আজ রাতে আমি আর ফিরব না। আপনি ফিল্ড মার্শাল খোকার সাথে আমার হয়ে যোগাযোগ করে আমার হয়ে নির্দেশ দিবেন। নির্দেশ একটাই—ফায়ার। ক্রিটিক্যাল কোনো ডিসিশান নিতে হলে আমাকে কল করবেন। রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর যে কোনো মানুষকে মেরে ফেলতে হবে। বুঝাইতে পেরেছি, কমরেড?

র‍্যাঁবো বলে — কমরেড ব্রো, ইয়েস। ইয়েস। আপনি কোনো টেনশানই করবেন না। প্রতিবিপ্লবীদের রক্ত দিয়ে সি-বিচ বানিয়ে চট্টগ্রামকেট্যুরিস্ট স্পট বানাবো।

বলরাম বলে — বিপ্লব কোনো সূচিকর্ম নয়, বিপ্লব কোনো ভোজসভা নয়…।

কান অফ করে রাখে স্যামুয়েল।

বলরাম কর্মকার গেরিলাদের বলে — কমরেড। উনি আর্তুর র‍্যাঁবো। আমাদের যুব ইউনিটের চিফ। আমি না আসা পর্যন্ত আপনারা ওনার অর্ডার মেনে চলবেন।

৩.

সকাল নয়টা। ব্রেকফাস্ট করেছি একটু আগে। র‍্যাঁবো বলে — ব্রো, ঘুমাইতেই পারি নাই। খালি স্বপ্ন দেখছি।

আমি জিজ্ঞাসি—কী স্বপ্ন দেখছো, খালাতো ভাই?

র‍্যাঁবো  বলে — দেখছি মারজিয়ার বিয়া হচ্ছে। কার সাথে বিয়ে হচ্ছে দেখি নাই।

রুমে আসে এক গেরিলা।

গেরিলা র‍্যাঁবোকে বলে — কমরেড, হলরুম রেডি।

র‍্যাঁবো বলে — হলরুমে কী?

গেরিলা বলে — কমরেড লিডার, আপনি হলরুমে চলুন। হলরুম হচ্ছে কন্ট্রোলরুম।

৪.

বিশাল অন্ধকার হলরুমে প্রবেশ করি। হলরুমে ষাটটা মনিটর। র‍্যাঁবোকে পথ দেখিয়ে একটা চেয়ারের কাছে নিয়ে যায় গেরিলা। র‍্যাঁবো চেয়ারে বসে। আমি তার পাশের একটা চেয়ারে বসি। গেরিলা তাকে একটা সেলফোন দেয়।

গেরিলা বলে — এইটা হচ্ছে কন্ট্রোল সেলফোন।

র‍্যাঁবো ফোনটা হাতে নেয়। সেলফোনে কিছুক্ষণ পর পর কল আসে। ফিল্ড মার্শাল খোকা।

গেরিলা আমাদের ছেড়ে দূরে চলে গেলে আমি র‍্যাঁবো কে জিজ্ঞাসি —নিউ বিপ্লবী সার্কাস পার্টির যুব ব্রিগেডের মাহামান্য প্রেসিডেন্টনির্বাচিত হয়ে কেমন লাগতেছে, আর্তুর র‍্যাঁবো?

র‍্যাঁবো বলে—মাও সেতুং বলেছেন—কথা হবে কম। সো। চুপ।

আমি বলি — ওকে। তবে এখন না একটু পর। আমিও মনিটরে চোখ রাখি। ষাটটা মনিটরে ষাটটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের ছবি ফুটে ‌ওঠে। ফেনি নদীর পাড়ের বর্ডার এলাকার সেট করা ক্যামেরার সাতটা মনিটরে দেখা যায় পীর মজ্জুব টাইপের লেবাস ও কাদেরিয়া, চিশতিয়া, মুজাদ্দেদিয়ার ফ্ল্যাগ হাতে নিয়ে লংমার্চ করে আসছে অনেকগুলা দল। পীরের কাফেলাগুলা সুশৃঙ্খল, মজ্জুবের কাফেলাগুলা বিশৃঙ্খল। পীরের কাফেলায় আছে পীরের ডিরেক্ট  মুরিদান আর মজ্জুবের কাফেলায় আছে তার ফ্যানরা।

র‍্যাঁবো গেরিলাকে ডাকে। গেরিলা কাছে আসলে র‍্যাঁবো বলে—কন্ট্রোল ফোনটা নিয়ে মার্শাল খোকাকে ডায়াল করে আমার হয়ে অর্ডার দেন — শুট।

গেরিলা র‍্যাঁবোকে বলে — কমরেড লিডার, এই যে পীর মজ্জুব এরা তো ক্ষতিকর না। তাদের তো ঢুকতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট চলবে পার্টির নির্দেশে। আর পার্টির প্রেসিডেন্ট হচ্ছে কমরেড বলরাম। কমরেড বলরাম বলে দিয়েছেন এদেরকে যেন ঢুকতে দেয়া হয়।

র‍্যাঁবো বলে — টুএলএস কী জানেন?

গেরিলা বলে — এইটা আবার কী?

র‍্যাঁবো বলে — আপনে মাও সেতুং পইড়া আসেন ভাল করে, দ্যান আসেন কথা বলি। আমি জানি কমরেড বলরাম কর্মকার আমার লিডার। আমারে আমার মত কাজ করতে দেন।

র‍্যাঁবো মনোযোগ দিয়ে মনিটর দেখে।

একটা মনিটরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেন — চট্টগ্রাম যে স্বাধীন হয়েছে এইটা একটা ভার্চুয়াল রিউমার।

র‍্যাঁবোর ফোন বাজে। ফিল্ড মার্শাল খোকার কল।

খোকা বলে—কী করবো? প্রেসিডেন্টের কথা শুনে বাংলাদেশ না খালি ইন্ডিয়া থেকেও পীর ফকিররা এই রাষ্ট্রে চলে আসতে চায়।

র‍্যাঁবো বলে — আমি দশ মিনিটের মধ্যে কল দিয়ে জানাচ্ছি কী করতে হবে।

র‍্যাঁবো বলরাম কর্মকারকে কল করে।

বলরাম কর্মকার বলে — এইসব ঢুকতে দেয়া হোক।

মনিটরে দেখা যায় পীর মজ্জুবেরা বর্ডারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তাদের বর্ডারে ঢুকতে দিতে। বর্ডারের এই পাশে বিপ্লবী সরকারের সশস্ত্র গেরিলারা তাদের অস্ত্র তাক করে রাখে পীর মজ্জুবদের দিকে। বর্ডার গরম হয়ে ওঠে।

র‍্যাঁবো ফিল্ড মার্শালকে কল করতে ফোন হাতে নেয়। কিন্তু তার ভয় লাগে অর্ডার দিতে। র‍্যাঁবোর হাত কাঁপে।

র‍্যাঁবো আমাকে বলে — ব্রো, অবস্থা তো খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। মঞ্জুরে যেখানে বন্দি রাখা হয়েছে ওইখানে যাও। দশ ট্রাক অস্ত্রের খবর নাও।

আমি বলি — ট্রু। অস্ত্রগুলা সিস্টেম করে ফেলে সিন থেইকা সরে পড়তে হবে ।

র‍্যাঁবো বলে — অবশ্য সিন থেকে সরারও কিছু নাই। দশ ট্রাক অস্ত্র দিয়া কী হবে? মারজিয়ার তো এনগেইজমেন্ট হয়ে গেছে। স্বপ্নে দেখলাম বিয়েও হয়ে গেছে।

আমি বলি — সেটাও ঠিক।

র‍্যাঁবো বলে — না। ব্রো। আমার মনে হয় আমারে চেতাইতে মারজিয়া আমারে হুদাই এনগেইজমেন্টের গল্প দিছে। তুমি খবর নাও।

আমি বলি — এটাও ঠিক। একটু ব্ল্যাক কফি খাই। দ্যান যাই।

র‍্যাঁবো এক গেরিলাকে বলে — কমরেড ব্রো, আমাদের দুইটা ব্ল্যাক কফি দিয়া যান।

গেরিলারা যুব ব্রিগেডের প্রেসিডেন্টের চা বানানোর মহান দায়িত্ব নিয়ে চলে যায় প্রেসিডেন্ট ভবনের কিচেনের দিকে।

র‍্যাঁবোর ফোন বাজে। ফিল্ড মার্শাল খোকা।

র‍্যাঁবো আমাকে জিজ্ঞাসে—আচ্ছা, ব্রো, এই খোকারে কী বলব বলো।

আমি বলি — একদম গুলি করে দিতে বলো।  

র‍্যাঁবো ফিল্ড মার্শাল খোকাকে ফোনে বলে — ফায়ার… অল ঘোড়া কন্ট্রোল।

খোকা জিজ্ঞাসে—অল ঘোড়া আবার কী?

র‍্যাঁবো উত্তরে বলে — চারু মজুমদার বলেছেন — কথা হবে কম। আপনি আধা ঘণ্টার মধ্যে বর্ডারে সাউন্ড সিস্টেম বসান। আমি ডিরেক্ট ওই মজ্জুবগুলারে নির্দেশ দিতে চাই।

খোকা বলে — ওকে, কমরেড।

র‍্যাঁবো ফোন রেখে আমাকে বলে — ব্রো, চলো মঞ্জুকে ধরি।

৫.

প্রেসিডেন্ট ভবনের একটা বদ্ধ রুম। রুমের বাইরে চারজন সশস্ত্র গেরিলা। মঞ্জু এক রুমে বন্দি। আমরা সেই রুমে প্রবেশ করি। মঞ্জুবিষণ্ন মুখে বসে আছে একা।

র‍্যাঁবো মঞ্জুকে জিজ্ঞাসে — আচ্ছা আমাদের চার ট্রাক অস্ত্রগুলা কই?

মঞ্জু বলে — আমি জানি না।

র‍্যাঁবো বলে — র‍্যাবকে কল করছিলাম আমি। তারপরের ঘটনা বলেন। র‍্যাবের হাত থেকে এইটা নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির হাতে গেল?

মঞ্জু বলে — আমি জানি না।

র‍্যাঁবো — মঞ্জু ব্রো, আমি এই মূহুর্তে চট্টগ্রাম সরকারের যুব ব্রিগেডের ম্যাট্রিক্স। আমি চাইলেই আপনারে তূরীয় লেভেলের মাইর দিয়ে রিভেন্জ নিতে পারি। কিন্তু রিভেন্জ আমি নিবো না।

মঞ্জু বলে — আমি জানি না।

র‍্যাঁবো বলে — আমি আপনারে মুক্ত করে দিবো।

মঞ্জু বলে — দশ ট্রাক অস্ত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে সারা চিটাগং টাউনে ছড়িয়ে গেছে।

র‍্যাঁবো বলে — ব্রো, আমি রিভেন্জ নিবার মত পোলা না। কিন্তু ঘটনা কীভাবে বাইর করতে হয় সেইটা না জানার পোলাও আমি না। বলেন ব্রো, বলেন। আমি আপনারে মারলে ব্যাপারটা কি কিউট হবে?

মঞ্জু বলে — বাবলু…।

র‍্যাঁবো বলে — বাবলু না, আমি র‍্যাঁবো।

মঞ্জু আমাকে বলে — ভায়া, সিগারেট আছে?

আমি সিগারেট ও লাইটার এগিয়ে দিই। সিগারেট ধরিয়ে লাইটার আবার পকেটে ঢুকিয়ে মঞ্জু র‍্যাঁবোকে বলে—অস্ত্র চিটাগং ক্যান্টনমেন্টে।

র‍্যাঁবো আমাকে বলে — ব্রো, চলো, চিটাগং ক্যান্টনমেন্ট।

আমি মঞ্জুকে বলি — আমার লাইটার দাও।

মঞ্জু বলে — লাইটার আপনাকে দিয়ে দিছি।

র‍্যাঁবো বলে — ব্রো, আপনি ভুলে পকেটে নিয়ে নিছেন।

মঞ্জু পকেট থেকে লাইটার বের করে দিয়ে র‍্যাঁবোকে জিজ্ঞাসে — আমি কি ফ্রি?

র‍্যাঁবো বলে — না। এখন না। এখন ফ্রি করে দিছি এই কথা বলরামের কানে গেলে বলরাম যা বুঝার বুঝে ফেলবে। অস্ত্র বেহাত হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।

দরজা বন্ধ হয় মঞ্জুর মুখের উপর।

৬.

আমরা আবার হলরুমে ফিরে আসি। মনিটরে দেখা যায় পীর মজ্জুবের ঢল দুপুরের রোদে। তারা বর্ডারের বাইরে তাঁবু গেঁড়ে লান্চ করে। দুপুর। র‍্যাঁবো তার সেলফোন আমার হাতে দিয়ে বলে এইখানে ডিস্কো শফির নম্বর আছে। নম্বরটা বের করো তো।

আমি র‍্যাঁবোকে তার ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলি — ডিস্কো শফি।

র‍্যাঁবো ফোন হাতে নিয়ে ডিস্কো শফিকে ডায়াল করতে যাবে এমন সময় র‍্যাঁবোকে দেয়া কন্ট্রোল ফোনটা বেজে ওঠে। র‍্যাঁবো কল রিসিভ করে।

র‍্যাঁবো বলে — হ্যালো।

ওই প্রান্ত বলে — আই অ্যাম ফ্রম আসাম।

র‍্যাঁবো আমার দিকে তাকায়। সাথে সাথে বুঝে ফেলি দশ ট্রাক অস্ত্র আসামের যে পার্টির জন্য যাচ্ছিল সেই পার্টি অস্ত্রগুলা ফিরে চায়।

র‍্যাঁবো ফোনে বলে — কোনো অস্ত্র ফেরত দেয়া যাবে না।

ওই প্রান্ত বলে — আপনারা বিপ্লবী সরকার গঠন করেছেন। আপনারা তো বুঝবেন…।

র‍্যাঁবো বলে — ব্রো, কমরেড অ্যান্ডি ওয়ার্হোল বলেছেন বিপ্লব একটা ব্যবসা। অন্য সব ব্যবসার মতো বিপ্লবেও খালি নিজের কৌমের ভাগ বুঝে নিতে হবে।

ঐ প্রান্ত বলে — তাইলে আপনারা কি অস্ত্র ফেরত দিবেন না? আমরা কি হার্ড লাইনে যাবো?

র‍্যাঁবো বলে — তোর আসাম লিবারেশন আর্মিরে আমি তিন তিরিক্কে নব্বই বার চুদি। কোনো অস্ত্র ফেরত দেয়া যাবে না।

র‍্যাঁবো ফোন কেটে দেয়। র‍্যাঁবো তার ফোন থেকে ডিস্কো শফিকে কল করে।

র‍্যাঁবো — ব্রো, আমি নোমান বদ্দার ছোট ভাইটা। চিনছেন?

ডিস্কো শফি বলে — হ। চিনছি।

র‍্যাঁবো বলে—আমি আপনাকে একটা ইনফর্মেশন দিবো। ইনফর্মেশন দিবার আগে আমারে এক কোটি টাকা দিয়ে দিতে হবে।

ডিস্কো শফি — ইনফর্মেশনটা কী?

র‍্যাঁবো বলে — অস্ত্র কই আছে ঐ ইনফো।

ডিস্কো শফি হাসে।

ডিস্কো শফি বলে — অস্ত্র যে চিটাগং ক্যান্টনমেন্টে পইড়া আছে এই ইনফরমেশন আমার কাছেও আছে।

র‍্যাঁবো বোকা হয়ে ফোন কেটে আমার দিকে তাকায়।

র‍্যাঁবো কন্ট্রোল ফোন হাতে নিয়ে ফিল্ড মার্শাল খোকার ফোন নম্বর বের করে কল করে খোকাকে জিজ্ঞাসে—সাউন্ড সিস্টেম রেডি?

খোকা বলে — রেডি।

র‍্যাঁবো বলে—আমার কল লাউডস্পিকারে দিয়ে মাইক্রোফোনে দেন।

খোকা বলে — জাস্ট ওয়ান সেকেন্ড। ওকে কমরেড লিডার। অর্ডার প্লিজ।

র‍্যাঁবো বলে — হেই ম্যান, লিসেন টু মি। এখন থেকে আগামি পাঁচ মিনিট পরে কোনো পীর মজ্জুব যদি দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে ননস্টপ পনেরো মিনিট গুলি চলবে পাঁচশো রাইফেল থেকে। হ্যাভ ইউ গট মাই পয়েন্ট, ডার্লিং?

সাথে সাথে র‍্যাঁবোর হাতে থাকা কন্ট্রোল ফোন বেজে ওঠে। বলরামের ফোন।

বলরাম জিজ্ঞাসে — আমাদের কি হার্ড লাইনে যাওয়া ঠিক হচ্ছে। আপনি নাকি ফায়ার করে দিতে নির্দেশ দিচ্ছেন!

র‍্যাঁবো বলে — কমরেড চারু মজুমদার তার তিন নম্বর দলিলের চার নম্বর পয়েন্টে বলছেন—দেরি করা যাবে না। দেরি করলেই খেলা শেষ। আর পীর মজ্জুবরা সব আনপ্রোডাক্টিভ মাল। এদের একদম টলারেট করা যাবে না। এরাও শ্রেণিশত্রু।

বলরাম বলে—না না কমরেড। গুলি করা যাবে না।

র‍্যাঁবো বলে — ওকে।

র‍্যাঁবো ফোন রাখে। র‍্যাঁবো আবার কল করে ফিল্ড মার্শাল খোকার ফোনে। খোকা ফোন কানেক্ট দেয় বর্ডার এরিয়ার স্পিকারে।

র‍্যাঁবো বলে — জিরো বলার সাথে সাথে গুলি চলবে। ফাইভ, ফোর, থ্রি, টু…।

ওয়ান  বলার সাথে মজ্জুবরা সব ছুটাছুটি করে মূহুর্তেই পালিয়ে যায়। শুধু দাঁড়িয়ে থাকে একজন। লোকটাকে দেখে র‍্যাঁবো টাসকি খায়।

লোকটার হাতে হ্যান্ডমাইক, মাইকের স্পিকারে থুতু ছিটিয়ে আজিজ বলে—আমি যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। আমি সোহেল। অল ঘোড়া কন্ট্রোল।

র‍্যাঁবো ফিল্ড মার্শালকে কল করে বলে — এই মালটাকে আমি চিনি। শুধু এই মালটারে ঢুকতে দেন, কমরেড ব্রো। 

৭.

মনিটরে দেখা যায় চিত্রকলা সোহেলের পিছে পিছে বর্ডার দিয়ে ঢুকে পড়ে পালিয়ে যাওয়া পীর মজ্জুবরাও। মজ্জুবরা নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে ভাসতে ভাসতে আবার কেউ কেউ একদম সাইলেন্ট চোখ মাটির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ে চট্টগ্রাম শহরে। তাদের আশেকান ও মুরিদেরা জিইসি মোড় পাস করার সময় জিইসি মোড়ের মেয়েদের দিকে তাকায় এবং তাদের ধারণা আজ তারা এই শহরের যে কোনো মেয়েকে বললেই প্রেম হয়ে যাবে। এক মুরিদ এই আত্মবিশ্বাস কলিজায় নিয়ে এক মেয়েকে বলে—চলেন প্রেম করি।

মেয়েটাকে দেখে স্যামুয়েল গেরিলাকে ডাক দেয় — একটু জুম ইন করেন তো।

গেরিলা জুম ইন করে।

র‍্যাঁবো বলে — ব্রো, ব্রো, দেখো, ঐটা মারজিয়া।

র‍্যাঁবো মারজিয়ার ফোনে কল দিবে এমন সময় র‍্যাঁবোর ফোন বেজে উঠে। মারজিয়ার কল।

মারজিয়া বলে—বাবলু, কুত্তার বাচ্চা তুই কই? তোর চাকরি কই?  

র‍্যাঁবো কিছু বলতে পারে না। মারজিয়া বলে — কুত্তার বাচ্চা কথা বল। তুই বাটপার, তুই খানকি, তুই শুয়ার কথা বল। দুই দিন ধরে আমি তোর গলা শুনি না, খানকি, আই মিস ইউ, টক টু মি।

র‍্যাঁবো জিজ্ঞাসা করে — ঠিক আছো তুমি?

মারজিয়া বলে — চিটাগঙের পলিটিক্যাল সিচুয়েশন ভাল না। কোথাকার কোন পাগল ছাগল ভইঙ্গা এসে চিটাগং দখল করে ফেলেছে। তুই আমার জানের দুশমন, তুই বিশ্ববেকুব আমার সাথে যোগাযোগ করস নাই কেন?

র‍্যাঁবো বলে — তুমি তো ফোওন অফ করে রাখছো। কীভাবে জানাবো?

মারজিয়া বলে — আমার বাসায় চলে আসতে পারতি না?

র‍্যাঁবো বলে — এখন আসি?

মারজিয়া বলে — কুত্তার বাচ্চা, চাকরি জোগাড় করার আগে আমার সাথে দেখা করতে চাইলে আমি তোর কলিজা খায়া ফেলবো।

র‍্যাঁবো কিছু বলার আগেই মারজিয়া ফোন রাখে। এবার র‍্যাঁবো কল করে।

র‍্যাঁবো মারজিয়াকে বলে—তুমি না কইলা তোমার এনগেইজমেন্ট হয়ে গেছে?

মারজিয়া বলে — এনগেইজমেন্ট মানে তো বিয়া না। আর এনগেইজমেন্ট হয় নাই।

বলে ফোন কেটে দেয় মারজিয়া।

র‍্যাঁবো আমাকে বলে—বলরামের এই সেটাপ থেকে দূরে চইলা যাইতে হবে। বিপ্লব টিপ্লব এগুলা আমার জীবন না। আমার জীবনের নাম — মারজিয়া।

আমি বলি — ট্রু।

এমন সময় বাইরে গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়। একটু পর বলরাম কর্মকার ও প্রেসিডেন্ট ফরিদ শাহ এসে হলরুমে ঢোকে।

বলরাম র‍্যাঁবোকে বলে — তোমার অনেক সম্ভাবনা আছে। যাও এখন। আজিজকে বরণ করে নিয়ে আসো।

রাত দশটা বাজে।

র‍্যাঁবো বলে — ডিস্কো শফি আসবে ওয়ার সিমেট্রিতে। চলো…।

আমি বলি — চলো।

র‍্যাঁবো বলে — না, আগে লান্চ করে নিই।

৮.

প্যাকেট বিরিয়ানি খেতে খেতে ওয়ার সিমেট্রিতে মিটিং। আমি, র‍্যাঁবো ও ডিস্কো শফি। ডিস্কো শফি বিকাল পাঁচটার মধ্যে ক্যাশ এক কোটি টাকা দিয়ে যাবে আমাদের হাতে। আমরা তারপর চিটাগং ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে সাহায্য করবো ডিস্কো শফির লোকজনকে।

৯.

ওয়ার সিমেট্রি থেকে বের হয়ে সার্সন রোডে ঢোকার মুখে চিত্রকলার সাথে দেখা হয় আমাদের।  

র‍্যাঁবো হ্যান্ডশেক করে চিত্রকলাকে জিজ্ঞাসে—আমাকে চিনছেন?

চিত্রকলা বলে — চিনা বা না চিনার মধ্যে কোনো ভেদ নাই।

র‍্যাঁবো পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে। মানিব্যাগের চিপা থেকে একটা ছবি বের করে চিত্রকলাকে দেখায়।

চিত্রকলা জিজ্ঞাসে — প্রেসিডেন্ট ভবন কোনোদিকে।

চিত্রকলার পিছনে হাজার হাজার আশেকান ও মুরিদান। প্রেসিডেন্ট ভবনের সিঁড়িতে নেমে এসে প্রেসিডেন্ট ফরিদ শাহ খুব তাজিমের সাথে চিত্রকলার সাথে মোলাকাত করে।  

চিত্রকলা বলে — অ্যাই! অল ঘোড়া কন্ট্রোল মানে কী বল।

সোহেলের এমন রুঢ় ব্যবহার প্রেসিডেন্ট ফরিদ শাহের ইগোতে লাগে, প্রেসিডেন্ট বলে—”এক নম্বর কথা হলো, অ্যাই অ্যাই করবা না, বাবা ডাকবা বাবা, যদি বাবা ডাকতে লজ্জা লাগে তাইলে স্যার ডাকবা, দুই নম্বর কথা হলো…।”

বলার আগে আগে ফরিদ শাহকে ঘুষি মেরে ফ্লোরে শুইয়ে দেয় সোহেল।

বলরাম কর্মকার তার গেরিলাদের কয়েকজনসহ র‍্যাঁবোকে ডেকে একটা ছোট মিটিং করে।

বলরাম বলে — কমরেডরা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী সবাই চট্টগ্রাম দখল করতে আসছে। আমাদের হাতে তাদের সাথে ফাইট করার মত ইনাফ অস্ত্র থাকলেও, এই অস্ত্র চালানোর মানুষ নাই। পার্টি এগিয়ে গেছে কিন্তু জনগণ অনেক পিছনে। আমাদের ডিসাইড করতে হবে এই মুহূর্তে কী করা যাচ্ছে, আর কী করা যাচ্ছে না। কোনটা মৌলিক দ্বন্দ্ব…।

র‍্যাঁবো কান অফ করে ফেলে।

বলরাম বলে — আমাদের এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে পালিয়ে যাওয়া। পালিয়ে জনগণের সাথে মিশে যাওয়া।

এক গেরিলা বলে — কমরেড, আপনি এই বিপ্লবের সাথে বিট্রে করছেন। বলরাম কর্মকারকে এই মুহূর্তে পার্টি থেকে বহিস্কার করা হলো। এখন থেকে পার্টির প্রেসিডেন্ট আর্তুর র‍্যাঁবো।

র‍্যাঁবো বলে—আমি না।

গেরিলাটি বলে — এখন থেকে পার্টির প্রেসিডেন্ট আমি বদি আলম। আর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কমরেড সোহেল।

সোহেল বলে—আমার নামের আগে কমরেড, টমরেড বসানো যাবে না।

কমরেড বদি আলম নির্দেশ দেয় — আর্তুর র‍্যাঁবো, বলরাম কর্মকার ও এই প্রতিবিপ্লবী চক্রের সাথে জড়িত সবাইকে অ্যারেস্ট করা হোক।

কিছুক্ষণ নীরবতা। হঠাৎ কয়েকটা গেরিলারা রাইফেল ঘুরিয়ে দেয় গণপ্রজাতন্ত্রী চট্টগ্রাম সরকার এই প্রোডাক্টের ইন্জিনিয়ার বলরাম কর্মকারের দিকে। আমাদের ঘিরে ফেলে সশস্ত্র গেরিলারা।

১০.

রাত। একটা গরম বদ্ধরুমে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে আমাদের। মঞ্জু ও বলরাম কর্মকার এক দিকে কানে কানে কথা বলে।

আমি র‍্যাঁবোকে বলি—ব্রো, প্রেসিডেন্ট সোহেল তোমার পরিচিত বললা না। একটা গেরিলা ডাইকা প্রেসিডেন্টের কাছে বলো, প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাও। আমরা আজিজ প্রেসিডেন্টের লোক হয়ে জেলে আটকে আছি?

র‍্যাঁবো এক গেরিলাকে ডেকে বলে — প্রেসিডেন্টকে বলেন, আমি তার একজন ক্লায়েন্ট।

সৈন্য চলে যায়। একটু পর সৈন্য ফিরে আসে। তারা গারদের লক খুলে ভিতরে আসে। আহ! মুক্তি। সৈন্যটা এসে র‍্যাঁবোকে পিটায় ও দূরে দাঁড়িয়ে মঞ্জু হাসে।  

মঞ্জু বলে — ব্যাঙ মরে গালের দোষে।

র‍্যাঁবো আবার সৈন্যটাকে ডাকে — খোদার কছম ভাই, আমার কাছে প্রেসিডেন্টের আঁকা একটা ছবি আছে।

গেরিলা বলে — তুই চুদানির ফোয়ারে হন চুদানির ফুয়াই চুদানির বুদ্ধি দিয়িদে মাইর হাইবাল্লাই?

বলে সৈন্য ঢুকে আবার র‍্যাঁবোকে পিটায়। হঠাৎ র‍্যাঁবো চেপে ধরে গেরিলার বিপ্লবী বিচি। মঞ্জু ও বলরাম কর্মকার এসে সৈন্যকে ফ্লোরে ফেলে পিটায় ও তার রাইফেল কেড়ে নেয়। এক গেরিলার চিৎকার শুনে অন্য গেরিলারা আসে। র‍্যাঁবো আমাকে ডাক দেয়। পালাতে হবে, দৌড় দেয়। পিছন থেকে এক গেরিলা গুলি করে। বদ্ধ রুম থেকে বের হয়ে আমরা বের হয়ে করিডোর বেয়ে চলে যাই প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে।

জেলখানার এই সেল থেকে আমরা সবাই হঠাৎ দৌড় দিই। আমার পাশ থেকে হঠাৎ ঝরে যায় একজন। পিছনে তাকিয়ে দেখি মাথায় গুলি লেগেছে বলরামের। বলরাম মুখ থুবড়ে পড়ে। 

১১.

দৌড়াতে দৌড়াতে ডিসি হিল চলে আসি। রাত দশটা এগারোটা বাজে। ডিসি হিলে একটু জিরাই। দূরে পাথঘাটার দিক থেকে দৌড়ে আসছে নোমান বদ্দা। নোমান বদ্দাও আমাদের দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। নোমান বদ্দা প্রেসিডেন্ট ভবনের আরেকটা রুমে আটকে ছিল। পালাতে গিয়ে মারা গেছে নিগারের বাকি দুই আশেক — বক্কর ও টুটুল।

র‍্যাঁবো নোমান বদ্দাকে জড়িয়ে ধরে বলে — দুনিয়াতে সবাই আমার ব্রো, আপনিই খালি ভাই, নোমান বদ্দা।

কর্ণফুলি ব্রিজ পার হবার সময় আমাদের ধরে ফেলে বাংলাদেশ পুলিশ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন শাখা।

১২.

কত রাত। দুইটা তিনটা। কোতোয়ালি থানাতে ভিড়। হাজতে ঢুকে র‍্যাঁবো ভেঙে পড়ে।

নোমান র‍্যাঁবোকে জড়িয়ে ধরে বলে—বদ্দা, সোয়াবিরিন, সোয়াবিরিন আমি আছি, নো টেনশান। সব ঠিক হয়ে যাবে। মার্লে বদ্দার গান শুনো নাই? এভরিথিংস গনা বি অলরাইইট।

র‍্যাঁবো বলে — কিচ্ছু ঠিক হবে না ব্রো। আমাদের ফাঁসি হয়ে যাবে।

ফাঁসি শুনে ভয় হয়। থানা হাজতে প্রেস আসছে, র‍্যাঁবোকে ফোকাস করে ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠে, নিভে যায়। আমি ও মঞ্জু মাথা নিচু করে বসে আছি, নোমান বদ্দা দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত নয়নে সব দেখে।

এক মেয়ে জার্নালিস্টকে দেখিয়ে র‍্যাঁবো নোমানকে বলে — মালটা জাস্তি না বদ্দা?

নোমান বদ্দা র‍্যাঁবোর এই কথা পছন্দ করে না — বদ্দা, আমি কিন্তু মাইন্ড করলাম।

বাবলু আবার বলে — কেন?

নোমান বদ্দা বলে—মিয়া তোমার মারজিয়ারে ফাইতে দেশে কত বড়ো ঘটনা ঘটে গেল। কতো জন শহীদ হয়ে গেল, আর তুমি লুচ্চাদের মতো অন্য মেয়েরে জাস্তি বল! জাস্তি খুব বাজে একটা শব্দ। আঁর নিগারর মিক্কে চাই হনো হানকির ফোয়া জাস্তি হইলে আঁইতো ইতের মুখ সেলাই গরি দিতাম।

নোমান বদ্দা চাঁটগাইয়া বলছে। এখন কোনো কথা হবে না। এই মুহূর্তের নোমানকে চিটাগঙের টপ রকস্টার থেকে শুরু করে টপ টেরর সবাই ভয় পায়।

নোমান বদ্দা এক পুলিশকে ডাক দেয়। পুলিশ আসে।

নোমান পুলিশকে বলে — একটা নম্বর লিখেন।

পুলিশ তার সেলফোন বের করে বলে — বলেন।

নোমান একটা নম্বর বলে। পুলিশ ফোনে নম্বরটা সেইভ করে।

নোমান বলে — বদ্দা, আমার চাচার নাম্বার এইটা। আমার চাচারে কল দিয়ে বলেন আমি কই আটকে আছি। পুলিশ নোমানের কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে চলে যায়। থানা হাজতের টিভি থেকে খবর ভেসে আসে—গণপ্রজাতন্ত্রী চট্টগ্রাম সরকারের গেরিলারা ট্যাংক রাইফেল ছেড়ে পালাচ্ছে।

থানা হাজতের পুলিশ আরেক পুলিশকে বলে—র‍্যাব এই সর্বহারা সাইজ করে দিছিল। এখনো দুই একটা আছে। শেষ মাইর চলতেছে।

টিভিতে দেখা যায় প্রথম প্রেসিডেন্ট কমরেড ফজলে রাব্বি, দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট ফরিদ শাহ ও তৃতীয় প্রেসিডেন্ট সোহেল চিত্রকলাকে অ্যারেস্ট করার খবর নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

একটু পর থানা হাজত ভরে তোলে নোমানের খুলশি এলাকার মানুষজন। নোমান বদ্দাকে হাজত থেকে বের করে পুলিশ। নোমান র‍্যাঁবোকে বলে—বদ্দা, আমি তোমাদের না নিয়ে বের হবো না।

নোমান বদ্দা হাজত থেকে বের হবার একটু পর আবার পুলিশটা আসে। আমাদের ওসির সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। দেখি ওসির সামনে চেয়ারে বসে আছে নোমান বদ্দা। থানার টিভিতে দেখা যায় দশ ট্রাক অস্ত্র কুমিল্লায় আটক করেছে র‍্যাব।

১৩.

ভোর হয়ে আসছে। আলো ফুটছে। আমরা কোতোয়ালি থানা থেকে বের হই। কোতোয়ালি থানা থেকে গেট থেকে বের হবার পথ ব্লকড করে দাঁড়িয়ে থাকে একটা মেয়ে।

বাবলু কাছে আসলে মেয়েটা বাবলুর গায়ের উপর হামলে পড়ে — কুত্তার বাচ্চা, সিনিয়র অফিসারের চাকরি জোগাড় করছস?

মেয়েটা মারজিয়া।

এপিলোগ

আরো অনেক অনেক অনেক দিন পর রিকশা নিয়ে আমি এসেছি দেবপাহাড়ে। বাস থেকে নেমে দেবপাহাড়ের রাস্তা ধরে উপরে উঠি, বৌদ্ধ মন্দিরে পৌঁছে যাই, বৌদ্ধ মন্দিরের দরজা দিয়ে দেখা যায় ধ্যানরত অলিফলিরা। আমি ঢুকে যাই মন্দিরের বিপরীতে লিলি খালার বাসায়। লিলি খালা জেল থেকে বের হয়েছে এক মাস হয়ে গেছে। জেল থেকে বের হয়েই লিলি খালা সোজা চলে গেছে দুবাই। দুবাই বসে আবার তার নেটওয়ার্ক চালু করে দিয়েছেন। আমি আবার ফিরে গেছি চাকরিতে। লিলি খালার অর্ডারে রেয়াজউদ্দিন বাজারের নূর আলমের দোকান থেকে পনেরো লাখ টাকা তুলে আমি দেবপাহাড়ে এসেছি বাবলুকে টাকা দিতে।

বাবলুকে কি বাবলু ডাকা যাবে?

বাবলু দরজা খোলে। আমি টাকা দিই। বাবলু পনেরো লাখ টাকা গোনে।

বাবলু চাকরিদাতা দৌলতকে কল করে। দৌলত কল রিসিভ করে না।

বাবলু আমাকে বলে—যে পাঁচ লাখ দিছিলাম দৌলত কি ঐটাও মেরে দিয়েছে নাকি, ব্রো?

কয়েকবার কল করার পর কল রিসিভ করে দৌলত।

আমি বলি — হইতে পারে, খালাতো ভাই।

বাবলু বলে — না না, মারবে না। চলো টাকা দিয়ে আসি।

আমি বলি — চলো।

বাবলু টাকা ব্যাগে ভরে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আমি বাবলুকে ফলো করি। ও এপিলোগ লেখি। কিন্তু বাবলু এতো জোরে হাঁটে যে ইন্সটিংকট ও ইন্টেলেক্টের সীমা থেকে তাকে আমি হারিয়ে ফেলি। ইন্সটিংক্টের কাছে অস্ত্র বেচে ইন্টেলেক্ট থেকে যারা আফিম কিনে খায় তারা আমারে অর্ডার দেয়—ইন্সটিংক্ট ও ইন্টেলেক্টের কন্ট্রোল থেকে বের হও। আমি থেমে যাই। বাবলুকে আর দেখা যায় না।

তানভীর চৌধুরী: ফিল্মমেকার এবং লেখক। প্রচারিত শর্টফিল্ম: ডিয়ার ট্রটস্কি, এবং এসো সুসংবাদ এসো।

অল ঘোড়া কন্ট্রোল এখনো বই হিসাবে প্রকাশিত হয় নাই যদিও লেখা সমাপ্ত হয়েছে ২০১৫ সালে।

কাভার ছবি: ফ্রেঞ্চ স্ট্রিট আর্টিস্ট কাশিঙ্কের (Kashink) স্মোকড ফিশ লাভ (Smoked Fish Love) অবলম্বনে করা হয়েছে। ছবির ফটোগ্রাফ এবং কাভার ডিজাইন করেছেন শামীমা বিনতে রহমান